সত্যি হলেও গল্প

রবি কর

বেঙ্গল টাইমস পড়বেন না। আমি বলছি, পড়বেন না। যে কাগজের এডিটর সাংবাদিকদের দিয়ে মিথ্যে কথা লেখায়, সেই কাগজকে বয়কট করুন।
সত্যি বলছি দাদা, এই এডিটরের কাছে অপমানিত হতে হতে আমার জীবনটা বিষ হয়ে গেল। সারাদিন অফিসের ফাই ফরমাস খাটি, মাঝে মাঝে লেখা কম পড়লে, কেউ লেখা পাঠাবে বলেও না পাঠালে, আমার ওপর হুকুম হয় যা হোক কিছু একটা লিখে জায়গা ভরানোর। কিন্তু কাজের বেলায় আমি কাজী, আর কাজ ফুরলেই পাজি। কোনও ভালো অ্যাসাইনমেন্ট আমাকে দেওয়া হয় না।
এই যে কলকাতায় পেলে এল, প্রথমবার যখন এল তখন আমার বয়স ১০, আমার বড়মামা খেলা দেখে এসে বলেছিল, “দূর থেকে পেলেকে ভালো দেখতে পেলাম না। তবে গায়ের রঙটা আমাদের রবির মতো।” সেই কথা মাথায় রেখে এডিটরকে বললাম, “স্যার, পেলের সঙ্গে আমার মিল আছে। পেলের ইন্টারভিউ আমাকে করতে দিন।”

pele7

শুনে এডিটর চোখ বড়বড় করে বললেন, “আপনার সঙ্গে পেলের মিল? পেলে এই কথা শুনলে গলায় দড়ি দেবে। তখন আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার দায়ে আপনার জেল হবে।”
জেলের কথা শুনে আমার মনে পড়ল দাদার কথা। দাদাকে চেনেন তো? সেই যে দাদার জেলে থাকার কথা কিন্তু শরীর খারাপ বলে হাসপাতালে আছেন। কিছু দিন আগেও দাদা ছিলেন খেলাধূলার সর্বেসর্বা। কিন্তু আজ? “পেলের পাশে ববি, দাদা কি কেবলই ছবি।’’
পেলেকে নিয়ে হইচইয়ের মধ্যেই দাদার জামিনের আবেদন আরও একবার নাকচ হয়ে গেল, কেউ খবর রাখল না। ভাবলাম যাই, পেলের সঙ্গে যখন দেখা করতে পারলাম না, তখন দাদার সঙ্গেই দেখা করে আসি। আজকাল তো দাদার কাছে কেউ যায়ই না।
হাসপাতালের কেবিনে দাদা আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেন। বললেন, “এডিটর পাত্তা দেয় না বলে দুঃখ করিস না। আমিও তো দিদির কাছে পাত্তা পাই না। অথচ দিদির জন্য আমি কি না করেছি। এই যে পেলে এসে দিদির সঙ্গে দেখা করল, আমি তো তিনবছর আগেই পেলেকে দিদির কাছে আনার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিলাম।
“দাদা এবার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুমি তিন বছর আগেই পেলেকে দিদির কাছে এনে ফেলেছিলে?
বিশ্বাস না হয় সঞ্জয় বোসকে জিজ্ঞেস কর। সঞ্জয় বোসকে চিনিস তো ? মোটু বোসের ছেলে। ওই যে হাতির মতো চেহারা। আগে আমাদের দলে ছিল। ও গোটা ঘটনার সাক্ষী।
পুরো গল্পটা বলো দাদা।
গল্প নয়, সত্যি। বছর তিনেক আগের কথা। এবার যেমন একটা বেসরকারি সংস্থা পেলেকে কলকাতা নিয়ে এসেছে, সেবারেও তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল। সবকিছু প্রায় পাকা। কিন্তু আমাদের জমানায় আমরা অনুমতি না দিলে কর ছাড়, স্টেডিয়ামের বুকিং পাওয়া এসমস্ত হবে না। তাই তারা আমার দ্বারস্থ হয়েছিল।
আমার দ্বারস্থ হওয়া মানেই দিদির দ্বারস্থ হওয়া। আমি তখন দিদির খাস লোক। আই অনুরোধ করলেই দিদি হ্যাঁ করে দেবে। তাই একদিন দিদির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিল সঞ্জয়।
দিদি তখন ছবি আঁকায় খুব ব্যস্ত। বড় একটা ক্যানভাসে ভ্যান গঘের মতো ছবি আঁকছে। শিল্পীদের কাজের সময় বিরক্ত করতে নেই। তাই আমি সঞ্জয়কে ঠেলি, সঞ্জয় আমাকে ঠেলে। দুজনেই দুজনকে বলছি, তুই বল, তুই বল।
দিদি সেটা শুনতে পেলেন। আঁকা থামিয়ে বললেন, দু কোটি টাকার ছবি আঁকতে আমার তিন মিনিট লাগে। আঁকা হয়ে গেছে। কী বলবি, বল।
আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, দিদি, পেলে কলকাতায় আসছে। সব ব্যবস্থা পাকা।প্লেএর টিকিটও কাটা হয়ে গেছে। তোমাকে অনুষ্ঠানে থাকতে হবে।
শুনে দিদি তেলেবেগুনো জ্বলে উঠে বললেন, ‘পেলে ? কে পেলে? তার কথামতো আমাকে অনুষ্ঠান ঠিক করতে হবে ? জানিস না, ওইদিন আমি জঙ্গল মহলে যাব ? পেলেকে বলবি এরপর আমার কর্মসূচি জেনে তারপর টিকিট কাটতে।

writers4

না দিদি। লোকের কাছে একটা বার্তা যেত, দিদির সঙ্গে দেখা করত কলকাতায় এলেন পেলে।
ঠিক আছে, ওকে বল, এক সপ্তাহ পরে আসত। তখন আমার সঙ্গে দেখা হবে।
দিদি, পেলে খুব ব্যস্ত মানুষ, ফুটবলের স্রমাট।
ঠিক আছে, আমি বাইচুংকে বলে দেব। পেলেকে যেন এক সপ্তাহ পরে আসতে বলে। বাইচুংয়ের কথা পেলে ফেলতে পারবে না।
গল্প শেষ করে দাদা বললেন, কী আর বলব বল। দিদির কাছে পেলের চেয়ে বাইচুং বড়, আমার থেকে ববি বড়। অবশ্য তখন ববি সিনে আসেনি। আমাকেই লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ঘোষণা করতে হয়েছিল, পেলের শরীর খারাপ। ডাক্তাররা প্লেনে উঠতে মানা করেছে। তাই আসতে পারবে না।
দাদা, যা বলছ, সব সত্যি?
বললাম তো, সঞ্জয় বোসকে জিজ্ঞেস কর। ও গোটা ঘটনার সাক্ষী।
পুনশ্চঃ অফিসে ফিরে আমি দাদার মুখে শোনা কথাগুলো এডিটরকে বললাম। এডিটর কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, এত বড় একটা এক্সক্লুসিভ নিউজ। আর আপনি বসে বসে আড্ডা দিচ্ছেন? যান, আমাকে যা যা বললেন, সব লিখে ফেলুন।
আমি বললাম, কিন্তু এই খবরের কোনও প্রমাণ নেই, সোর্স নেই। এইসব লেখা যায় নাকি ?
কিন্তু এডিটর চাকরি খেয়ে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে এই খবর লিখিয়েছে। বিশ্বাস করুন দাদা, যা লিখেছি, সব মিথ্যে। সব এডিটরের ভয়ে লিখেছি। তবু যদি আপনারা বিশ্বাস করেন, তার দায় আপনাদের। আমি এসবের মধ্যে নেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.