একটি চপের দোকান। কত ইতিহাসের নীরব সাক্ষী! এখানেই নিয়মিত চপ, পেঁয়াজি খেয়ে যেতেন নেতাজি। তাই নেতাজির জন্মদিনে এই দোকানে সব কিছু ফ্রি। শতবর্ষের দোরগোড়ায় থাকা সেই দোকানকে নিয়ে লিখলেন স্বরূপ গোস্বামী।
ছেলেটির বয়স তখন কতই বা হবে! বড়জোর কুড়ি। এমন কত ছেলেই তো রোজ আসে! কেউ চপ, কেউ পেঁয়াজি, কেউ–বা ফুলুরি নিয়ে যায়। সেই ছেলেটিও আসে, কখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চপ–বেগুনি খায়। কখনও ঠোঙায় করে নিয়ে যায়। ওদের কথাবার্তা কানে আসে।
সামনেই স্কটিশচার্চ কলেজ। ওখান থেকেই আসে ছেলেটি। সঙ্গে বন্ধুরাও। কিন্তু আর দশজনের থেকে ওদের কথাবার্তার সুর কেমন যেন অন্যরকম। আস্তে আস্তে চেনামুখ হয়ে উঠল ছেলেগুলি। জানা গেল, এই ছেলেটি কটক থেকে এসে আই এ পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথম হয়েছে। এই ছেলেটিই প্রেসিডেন্সিতে ওটেন সাহেবের মুখে ঘুসি মেরে বিতাড়িত। খোদ আশুতোষ মুখার্জি দাঁড়িয়েছিলেন এই ছেলেটির পাশে। এ তো যেমন–তেমন ছেলে নয়!
একটু একটু করে তৈরি হল আগ্রহ। কেমন যেন ভাল লেগে গেল খেঁদু সাউয়ের। একটু একটু করে গড়ে উঠল একটা বিশ্বাসের সম্পর্ক। তারও পরে সেই সুভাষচন্দ্র পড়তে গেলেন কেমব্রিজে। আই সি এস পেয়েও অবলীলায় ছেড়ে দিলেন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশের কাজে। ততদিনে বেশ পরিচিত নাম। তবু এই চত্বরে এলেই ঢুকে পড়তেন ওই সাউয়ের দোকানে। ততদিনে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এই দোকানটিও। অনেকেই জানতেন, এই দোকানের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কের কথা। কেউ এসে তাঁর উদ্দেশে রেখে যেতেন চিঠি। আবার সুভাষচন্দ্রও সতীর্থদের জন্য রেখে যেতেন বার্তা। কেউ এসে বলে গেলেন, সুভাষ এলে বলে দেবেন, আমি অমুকের বাড়িতে আছি। আবার কখনও সুভাষ এসে বলে যাচ্ছেন, অমুক এলে বলে দেবেন, আমি অমুক মাঠে আছি। আবার কখনও কারও বাড়িতে চলছে গোপন সভা। কতজন আছেন, জানা নেই। খেঁদুবাবু ঠিক সেখানে পৌঁছে যেতেন চপ, পেঁয়াজি নিয়ে। কখনও দাম নিতেন, কখনও নিতেন না। পুলিশও জেনে গেল এই দোকানের কথা। তাই কখনও কাউকে খুঁজতে এসে এই দোকানের ওপর নজরদারি চালাত। দুবার তো কাউকে না পেয়ে খেঁদুবাবুকেই তুলে নিয়ে গেল। এভাবেই চপের দোকানটাও জড়িয়ে গেল ইতিহাসের সঙ্গে।
দোকানের ইতিহাসের দিকে একটু তাকানো যাক। বিহারের গয়া জেলা থেকে রুজির সন্ধানে কলকাতায় চলে এলেন খেঁদু সাউ। প্রথমে থাকতে শুরু করলেন হাওড়ায়। পরে উত্তর কলকাতায় এসে চালু করলেন একটি চপের দোকান। কয়েকদিন চলার পর ১৯১৮ নাগাদ উঠে এলেন স্কটিশচার্চ কলেজিয়েট স্কুলের উল্টোদিকে। প্রথমে ছোট্ট একটি দোকান। কিন্তু খেঁদুবাবুর চপ, পেঁয়াজি, ফুলুরির সুনাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গোটা উত্তর কলকাতা জুড়ে। এই চত্বরে যিনিই আসেন, একবার এই দোকানের চপ খেয়ে যান। খেঁদুবাবুর পাশাপাশি তাঁর পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ সাউও দ্রুত দোকানের দায়িত্ব বুঝে নিলেন। তিনিও বাবার সঙ্গে এখান–ওখানে যেতে লাগলেন। খেঁদুবাবু মারা যাওয়ার পর পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের ওপর। তিনিও বেশ কয়েকবার নেতাজিকে পেঁয়াজি ও ফুলুরি খেতে দেখেছেন।
দোকানের নাম ততদিনে লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ এন্ড সন্স। এ তল্লাটে যিনিই আসেন, একবার না একবার এই দোকানে ঢুঁ মেরে যান। সামনেই স্টার, রঙমহল, বিশ্বরূপা। বিকেল হলেই থিয়েটার লেগেই থাকত। উত্তম কুমার থেকে উৎপল দত্ত, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে জহর রায়, সত্যেন বসু থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, কে ছিলেন না সেই তালিকায়? গায়ক রামকুমার চট্টোপাধ্যায় তো আর এক ধাপ এগিয়ে। আসা–যাওয়ার পথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চপ–ফুলুরি খাওয়া তাঁর রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভক্তের তালিকা আরও বেশ লম্বা। এখানে বাম–ডানে কোনও ভেদাভেদ নেই। জ্যোতি বসু থেকে মমতা ব্যানার্জি, সবাই অন্তত একটি বিষয়ে একমত। আলিমুদ্দিনের সভায় যেমন এই দোকানের চপ যায়, তেমনি মমতার বাড়িতে মিটিং হলেও চপের বরাত আসে এই দোকানেই। বেশ গর্বের সঙ্গেই সেইসব ছবি দেখাচ্ছিলেন কৃষ্ণকুমার সাউ। লক্ষ্মীনারায়ণবাবু মৃত্যুর পর তাঁর এই ছেলেই দোকানের দায়িত্বে, সঙ্গে সহকারীর ভূমিকায় আরেক ছেলে মোহন।
দোকানের নিয়নবোর্ডে মাঝে মাঝেই ফুটে ওঠে একটি ছড়া। সেই ছড়ার ইতিহাসে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। প্রায়ই আসতেন কৌতুকশিল্পী জহর রায়। একদিন লক্ষ্মীবাবু বললেন, জহরদা, আপনি তো রোজ এখানে চপ খান। কেমন লাগে, দু লাইন লিখে দিন। অমনি জহর রায় কাগজ টেনে খসখস করে লিখে ফেললেন— ‘চপ খাব আস্ত/তৈরি করব স্বাস্থ্য/বেগুনি খাব গোটা/ আমরা সবাই হব মোটা/পেঁয়াজি হবে শেষে/খাব ভালবেসে।’
আবার নেতাজিতে ফেরা যাক। ততদিনে সবাই জেনে গেছেন, এই দোকানে নেতাজি আসতেন। নেতাজিও এই চত্বরে এলেই চপ–ফুলুরি নিয়ে ঠিক পৌঁছে যেতেন লক্ষ্মীবাবু। নেতাজিও বেশ তৃপ্তি করে খেতেন, সতীর্থদের খাওয়াতেন। কিন্তু অন্তর্ধানের পর থেকেই মুষড়ে পড়লেন লক্ষ্মীবাবু। মাঝে মাঝে কাগজে আজাদ হিন্দ ফৌজের খবর দেখতেন। বিশ্বাস করতেন, নেতাজির বাহিনী ভারতে ঢুকে দেশকে স্বাধীন করবে। কিন্তু হঠাৎ খবর ছড়িয়ে গেল, নেতাজি আর বেঁচে নেই। বিমান দুর্ঘটনায় নাকি তাঁর মৃত্যু হয়েছে। মানতে পারেননি। কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকতেন। দেশ স্বাধীন হল। লক্ষ্মীবাবু তখনও বিশ্বাস করতেন, নেতাজি একদিন ঠিক ফিরে আসবেন। ঠিক করলেন প্রতিবছর নেতাজির জন্মদিন পালন করবেন। ১৯৪৮ নাগাদ শুরু হয়ে গেল সেই জন্মদিন পালনের প্রক্রিয়া। ঠিক করলেন, ওই দিন বিনা পয়সায় সবাইকে চপ–পেঁয়াজি এসব খাওয়াবেন। তারপর থেকে প্রতিবছর চলে আসছে এই ট্রাডিশন। ১৯৫৮ নাগাদ তৈরি করলেন নেতাজি তরুণ সঙ্ঘ। তিনদিন ধরে চলে নানা উৎসব। এখনও কি চপ বিলি হয়? শুনে নেওয়া যাক দোকানের কর্ণধার কৃষ্ণবাবুর কাছে, ‘প্রতিবছর ওই সময় রীতিমতো উৎসব চলে। সারা রাত ধরে কাজ হয়। সকাল থেকেই দোকানের সামনে লাইন পড়ে যায়। কোনও একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি উদ্বোধন করেন। তারপরই শুরু হয়ে যায় চপ, পেঁয়াজি, ফুলুরি, বেগুনি বিতরণ। একসঙ্গে তিন জায়গায় এসব বাজার কাজ চলে। আগে শালপাতায় দেওয়া হত। এখন ঠোঙা তৈরি থাকে। ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য দুটো করে, আর বড়দের জন্য চারটে করে ঠোঙায় ভরাই থাকে। প্রতিবছর প্রায় আড়াই হাজার লোক লাইন দেন। নেতাজির সম্মানে ওই দিন কোনও পয়সা নেওয়া হয় না।’
কিন্তু এই দোকানের বিশেষত্ব কী? আর দশটা দোকানের থেকে কোথায় আলাদা? কৃষ্ণবাবুর দাবি, ‘অন্য দোকানের সঙ্গে এই দোকানের আকাশ–পাতাল তফাত। সেটা আমাদের মুখে বলতে হয় না। এই তল্লাটের সবাই জানে। তাই বারবার আসে। আমার দাদু সবসময় কোয়ালিটি বজায় রাখতেন, বাবাও সেই ট্রাডিশন ধরে রেখেছিলেন। বাবার কাছ থেকে আমরাও শিখেছি, খদ্দের বিশ্বাস করে আসছে, তার সঙ্গে কখনও প্রতারণা করা উচিত নয়। এখানে তেল, ঘি সব বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ড থেকে নেওয়া হয়। কোনও বাসি জিনিস ব্যবহার করা হয় না। ছোলা থেকে নিজেরা বেসন তৈরি করি। বিভিন্ন মশলা নিজেরা বাড়িতে তৈরি করি। তাই এখানে একবার যাঁরা আসেন, তাঁরা বারবার আসেন।’
একটু দাঁড়ালেই বোঝা যাবে, কথাটা মিথ্যে নয়। বিকেল থেকে সন্ধে গড়াচ্ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভিড়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বদলে যায়। চপের দুনিয়াতেও এসে যায় নানা বৈচিত্র্য। মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছেন নেতাজি।