যত বুদ্ধিজীবা মেলা, সব কি কলকাতার জন্য!‌

অন্তরা চৌধুরী
‘দাদা পায়ে পড়ি রে মেলা থেকে বউ এনে দে’। কিন্তু মুশকিল হলো যে দাদার পায়ে পড়লেই কি দাদা বউ এনে দিতে পারবে? কারণ বইমেলা হয়, বউমেলা, বা বরমেলা তো কোথাও হয় না। অবশ্য অদূর ভবিষ্যতে হতেও পারে।আচ্ছা, মেলা বলতে প্রথমেই আমাদের মনে কোন ছবিটা ভেসে ওঠে? পাঁপড় ভাজা, জিলিপি, নাগরদোল্লা, ডিম লটারি, ঘুগনি, মেলার মাঠে হরেক রকম বাঁশীর আওয়াজ, নাখে সিন্নি পড়া সুকু মিত্তিরের তেরোটা এঁড়িগেঁড়ি ছানাপোনার মুগ্ধ দৃষ্টি, বায়না, চিনা মাটির কাপ ডিশ, মাটির পুতুল, ঘর সাজাবার জিনিস, হরেকমাল পাঁচসিকা আগে ছিল, এখন পাঁচটাকা । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন গোটা মেলাটাই যদি কিনে নিতে পারতাম! জানি না রবীন্দ্রনাথ এখন বেঁচে থাকলে আর গোটা মেলাটা কেনার কথা বলতেন কি না!
এতদিন মফঃস্বলের একরকম মেলা দেখতেই অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু কলকাতায় থাকার সুবাদে এখন বুদ্ধিজীবী মেলা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। রাজ্য সরকার একের পর এক মেলা আমাদের উপহার দিয়েই চলেছেন। উপহার পেতে পেতে ক্লান্ত হয়ে যাবেন, তাও উপহারের বিরাম নেই। সংবাদপত্র থেকে রাস্তার মোড়, সর্বত্রই এইসব মেলার বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন হোর্ডিং যা চুম্বকের মতো আমাদের মনকে আকর্ষণ করে। কত্ত মেলা। দিনে মেলা। রাতে মেলা। সারা শীত বললে ভুল হবে, সারা বছর ধরেই মেলা চলছে। সরস- নিরস, সবলা-অবলা, থেকে শুরু করে হস্ত শিল্পমেলা, খাদি মেলা, খাদ্য মেলা, মৎস মেলা, বাণিজ্য মেলা, সংস্কৃতি মেলা (অপসংস্কৃতি মেলাটা আর বললাম না), নাট্য মেলা, বাউল মেলা, লিটিল ম্যাগাজিন মেলা, আর চিরাচরিত বইমেলা তো বাঙ্গালীর আছেই। এছাড়াও সারা বছর ধরেই চলতে থাকে বস্ত্র মেলা। অর্থাৎ, বিনোদনের বিভিন্ন উপায়, এবং শিল্পযাপন করার বিভিন্ন মাধ্যম এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু শুধু কলকাতার লোকরাই যদি একা বুদ্ধিজীবী হয় তাহলে অন্যান্য জেলার লোকরা কি দোষ করল? তাদেরও তো একটু শিল্পযাপন করার ইঁদুরদৌড়ে সামিল হতে ইচ্ছে করে না কি!
hasta-shilpa
যে যাই বলুক এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ‘‌সবেধন নীলমণী’‌ শহর সেই কলকাতাই। কে বলে সরকারের টাকা নেই। আমি কুৎসা মোটেও করছি না। কিন্তু এই যে সবাই চ্যাঁচাচ্ছে টাকা নেই, টাকা নেই বলে , মেলার চরিত্র কিন্তু সেকথা বলছে না। সেখানে দিব্যি সবাই মনের আনন্দে ঘুরছে। জিনিসও কিনছে।
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, আগের মতো অত বেশি আর কিনছে না। কিন্তু কিনছে তো। সব মেলাতে না গেলেও অধিকাংশ মেলাতেই গেছি। একটা বিষয়ে মিল কিন্তু সব মেলাতেই আছে। কথায় বলে, ভোজনরসিক বাঙালি। সেই যে গোপাল ভাঁড় বলেছিলেন, বাড়িতে সন্দেশ থাক আর না থাক সন্দেশ আমি চাইই। সেরকম নমোবাবুর কৃপায় পকেটে টাকা থাক আর না থাক বাঙালি খাবেই। ফুড পার্কগুলোয় তাই ভিড় চোখে পড়ার মতো। অন্যান্য সব স্টলের চেয়ে এখানেই মানুষের যাবতীয় আবেগ ঝরে ঝরে পড়ছে। কিছুদিন আগেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় গিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে সায়েন্সসিটি চত্বরে বসেছিলাম। সেখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই একটা না একটা খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেট ঠিক আছে।
mela2
তাহলে যাবতীয় গবেষণা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল যে…. আমি কেন বলব? আপনারা ভাবুন।
আশা ভোঁসলের সেই গানটার প্রাসঙ্গিকতা বোধহয় হারিয়ে গেছে-
গতবার বলেছিলি মেলাতে নিয়ে যাবি
শাড়ি না দিয়ে আমায় কেবলই ছোলা মুড়ি…।
সেই ছোলা আর মুড়ি কোনওটাই আর এখন এই বুদ্ধিজীবী মেলায় পাওয়া যায় না।
Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.