মা দুর্গার চিঠিঃ এখন থেকে শুধরে নে

অয়ন দাস

বাপেরবাড়ি(মর্ত্য)বাসী,

এলাম কৈলাসে।বড্ড ক্লান্তি লাগছে, তবুও তোদের পৌঁছে চিঠি দেবো বলেছিলাম বলে বসেই পড়লাম চিঠিটা লিখতে। পুজোর চারটে দিন ভালোই কাটল। যদিও এবার মাত্র তিনদিন ছিল, তবুও তোদের টানে আরো কটা দিন কাটিয়েই এলাম।কি বলতো, বছরে এই চারটে দিনই তো বাপের বাড়িতে থাকার সুযোগ পাই, আমারও আসতে ইচ্ছা করে না।কিন্তু আমার বর কিছুতেই চারদিনের বেশি ছাড়বে না।তবুও এখন ‘ম্যানেজ’ করি দু-একদিন।বেশ নতুন নতুন স্টাইল(থিম) করলি আমার। স্বর্গে তো সেই একই স্টাইল থাকে সারাবছর, বছরের এই কটা দিন বেশ নিত্যনতুন সাজগোজ করা যায়।তবে তোদের ওই কলকাতার উত্তরে আমায় কিনা ‘বার্বি ডল’-এর সাজিয়ে দিল ।মানছি একটু পুরানো ধরণের আমি, আমায় তোরা আধুনিক করতে চাস। তাই বলে ‘বার্বি’র মতো স্টাইল করলি আমার!আমার অমন সুন্দর কালো চুল কিনা রঙ করে সোনালী করে দিলি!
deshpriya park6

তারপর তোরা দেশপ্রিয় পার্কে কি করলি! আমার সব অবতারদের মিলিয়েও এতো ‘হাইট’ নয় আমার, আর তোরা ৮৮ফুট করে দিলি আমায়।গঙ্গাজলের সাথে ‘কমপ্ল্যান’ মিশিয়ে দিয়েছিলিস নাকি যে এতো ‘লম্বা’ হয়ে গেলাম! অত উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকালেই বুকটা দুরু দুরু করে উঠছিল, ভাবলাম লোকজন এলে ভয় কমে যাবে। কিন্তু তাতেও তো গোল বাঁধালি।‘বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো দূর্গা’ বলে এতো চিৎকার যখন করলি তখন তো বুঝবি অনেক লোক আমায় দেখতে আসবে, ঠিক করে নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা তো করবি। উল্টে আমার দর্শন বন্ধ করে দিলি। আর ওদিকে আমি দুরুদুরু বুকে অতোদিন ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম চারটে ‘বাচ্চা-বাচ্চা’ ছেলেমেয়েকে নিয়ে।ওদের কি অবস্থা হয়েছিলো জানিস!শিব এসব শুনলে না তোদের ছাল-চামড়া গুটিয়ে দিত। আর বাঘছাল পরতো না। এই দু-একটা ‘বেয়াদপই’ ‘চোনা’ ফেলে দিল।ওই তো অষ্টমীর দিন একটা ফুটফুটে বছর খানেকের বাচ্ছা আমায় দেখে গেল। এগুলো মনকে কত ‘স্যাটিসফেকশন’ দেয় জানিস! এইজন্যই তো ‘বাপের বাড়ি’কে আমি এতো ভালোবাসি।
আরো একটা ‘বেয়াদপি’ করিস আমায় কৈলাসে পাঠানোর সময়ে। মানছি ‘ঘরের মেয়ে’ কে বিদায় জানানোর সময়ে যাতে আমার বেশি মনখারাপ না হয় তাই গান চালিয়ে হুল্লোড় করিস, তা বলে ও কি গান-‘ম্যাঁ অ্যালকোহোলিক হুঁ’ তাও ‘মাতাল’ হয়ে রাস্তায় শুয়ে নাচতে নাচতে!
তারপর ভাসান দেবার সময়ে নিজেরা পাকামো মেরে আমায় টানা- হ্যাঁচড়া করছিলিস কেন!হাত-পা’তে কি ব্যথা হয়েছে জানিস!লক্ষ্মীর মুকুট ভেঙ্গে গেছে,গণেশের ‘শুঁড়’ উল্টো দিকে ঘুরে গেছে, সরস্বতীর বীণা দু-টুকরো হয়ে গেছে,কার্তিকের গোঁফ অব্দি তোরা রেহাই দিসনি। এরকম করলে ওরা ‘মামারবাড়ি’ যাবে আর! পুরসভার তো আলাদা কুলি ছিল,ওদের দিতে পারতিস।এবার থেকে এরকম যদি করেছিস আগে থেকে ‘ভলিনি’ কিনে দিবি।

durga3
তারপর আমাদের গায়ে এই সীসাযুক্ত রঙ লাগিয়ে তোরা ‘স্কিন ডিজিজ’ করে দিয়েছিস।কি ভাবিস তোরা-অসুরকে বধ করেছি মানেই আমার ‘স্কিন ডিজিজ’ হবে না! এই তো সরস্বতী বলছিলো একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে কলকাতার মাত্র ৩০ শতাংশ দূর্গার গায়ে সিসামুক্ত রঙ লাগাস।পরেরবার থেকে যদি না সিসামুক্ত রঙ ব্যবহার করেছিস তাহলে দেখিস বছরের চারটে দিন যে ‘বাপেরবাড়ি’তে যাই সেটাও যাব না।
তোরা যে আমায় ভাসান দেবার সময়ে এতো দূষণ করিস, তারজন্য কৈলাসে আমায় নিয়ে কতো ঠাট্টা করে তার হিসেব রাখিস??প্রতি বছর পরিবেশবিদদের কথা না শুনে গঙ্গায় আমায় ভাসিয়ে দিস, তারজন্য কতো দূষণ হয় সেটা জানিস!আমার গায়ে যেসব সীসাযুক্ত রঙ দিস বা এই যে বর্জ্র্র্য পদার্থগুলো জলে ফেলিস তাতে জলের তো ক্ষতি হয়, জলে যেসব প্রাণী থাকে তারা মারা যায়।এই তো বড়ো বড়ো কথা বলিস যে আমি ধরাধামকে রক্ষা করি আর আমার পুজোর জিনিস দিয়েই এরকম দূষণ করিস। তারপর এই যে আমার গায়ে যেসব ফুলমালা,চাঁদমালা দিস পুজোর সময়ে সেগুলোও ভাসানের সময়ে খুলিস না, একে এগুলো জলকে দূষিত তো করেই তার উপর টানা চারদিন এগুলো আমার গায়ে রাখা যায় নাকি! একটু ‘ফ্রি’ থাকতে তো দিবি।
এই যে বাবুঘাটে এবার দেখলাম প্রথা মেনে ভাসান দিয়ে সাথে সাথে আমায় ‘ক্রেনে’ করে তুলে ঘাটের পাশে রেখে দিলো।এটাই তো ভালো,শিবের মাথার গঙ্গাকে নোংরা করার কি দরকার তোদের!লাফালাফি না করে সব জায়গাতেই এরকম ভাবে ভাসান দিবি।জলে ভেসে যেতে যেতে ‘ঠাণ্ডা’ও লাগবে না (‘সিজন চেঞ্জের’ সময়ে একেই) আর তোদের জন্য নোংরা হয়ে যাওয়া ‘গঙ্গাজল’ গায়ে লেগে ‘স্কিন ডিজিজ’ও হবে না।

durga4
কথাগুলো ভালো করে শোন।শিবকে তো জানিসই তোরা।একেই আমাকে ‘বাপেরবাড়ি’ যেতে দেয় না।তারপর তোরা যদি শিবের জটাকে নোংরা করিস, আমার জ্বর-‘স্কিন ডিজিজ’ করাস তাহলে ওই চারদিনও যেতে দেবে নাকি…।!শিব উদ্দাম নৃত্য শুরু করলে সেই তো আমার কাছেই ভয়ে আসবি,তাই আগে থেকে শুধরে নে নিজেদের।পরিবেশবিদরা যে বলছে গঙ্গাদূষণ বন্ধ করার জন্য গঙ্গায় আমার ভাসান না দিতে সেটাই শোন। প্রথা বলে লাফাস না তোরা,তারপর দেখবি যাকে নিয়ে এতো প্রথা সে এই চারদিনও ‘বাপেরবাড়ি’তে আসছে না।
ইতি
তোদের ‘মা’

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *