ব্যোমকেশ যেন কমপ্লিট প্যাকেজ, বাড়তি পাওনা ডুয়ার্স

শহরজুড়ে ব্যোমকেশ। শীতের নরম রোদে ডুয়ার্সের লোকেশান। বুদ্ধি, সাসপেন্স, বেড়ানো, বিনোদন–‌সবমিলিয়ে কমপ্লিট এক প্যাকেজ। ব্যোমকেশ পর্ব দেখে সেই অনুভূতির মেলে ধরলেন অন্তরা চৌধুরী। 

 

উঠল বাই তো সিনেমা যাই। এখন আর বাঙালির বারো মাসে তেরো নয়, বহু পার্বণের ছড়াছড়ি। যেমন সিনেমা পার্বণ। ব্যোমকেশ হোক বা ফেলুদা, দেখতে হবেই। আট থেকে আশি, বুঝে বা না বুঝে- কেতাদুরস্ত বাঙালির কাছে এটা এখন স্ট্যাটাস সিম্বল। এটা না দেখা মানে একটা ইয়ে ডাউনের ব্যাপার। প্রথম দিনেই প্রথম শো দেখা মানে বেশ একটা দিগ্বীজয়ী ব্যাপার। যারা হলের বাইরে একটা টিকিটের প্রত্যাশায় চাতক পাখিকেও হার মানাচ্ছে, তাদের প্রতি একটা করুণার দৃষ্টি। তার পর যদি সিনেমা হলটা নন্দন হয়, তাহলে পুরো জমে ক্ষীর। কোন কথা হবে না। নিজে নিজেই কেমন একটা বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিজীবী মনে হয়।

দিন গুনছিলাম। কবে আবার স্বমহিমায় ব্যোমকেশবাবুর কীর্তিকলাপ দেখতে পাবো। ‘অমৃতের মৃত্যু’ এমনিতেই খুব পছন্দের গল্প, তার ওপর সেটা যদি সিনেমা রূপে দেখা যায় তাহলে তো কথাই নেই। সিনেমার শুরু থেকেই বেশ একটা রহস্যময় পরিবেশ। আলো- আঁধারির ঘেরাটোপে বন্দি জঙ্গল। কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার। তারপরেই ব্যোমকেশ, অজিত আর সত্যবতী। মূল গল্পে সত্যবতী নেই, এখানে আছে, একেবারে কমপ্লিট প্যাকেজ। এই শীতে নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে সকলেরই বেড়াতে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায়টা সব ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে অরিন্দম শীল আমাদের বেড়াতে যাওয়ার সাধ মিটিয়ে দিয়েছেন। ঝকঝকে সুন্দর চোখ জুড়োনো সবুজ ডুয়ার্স আমাদের উপহার দিয়েছেন। শীতের সময় নন্দনে বসে ডুয়ার্স দর্শন, মন্দ কী!‌

byomkesh3

সময় হিসেবে ধরতে চেয়েছেন ১৯৪৮ সালকে। সদ্য এসেছে স্বাধীনতা। তেভাগা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ের পটভূমিতে সুন্দর চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। সরকারের বিশেষ অনুরোধে উত্তরবঙ্গে বে-আইনী অস্ত্র উদ্ধার করতে আসেন সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ। একের পর এক জটিল আবর্ত তৈরি হতে শুরু করে। গোটা সিনেমাটা অদ্ভুত রহস্যে মোড়া। সবাইকেই মনে হয় সন্দেহভাজন। আর সেই রহস্য ঘনীভূত হয়েছে রাতের অন্ধকারে এক অশরীরীর কালো ঘোড়ায় চেপে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোকে কেন্দ্র করে। এক এক সময় যেন নিজের অজান্তেই নিজের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

‘স্বহৃদয় হৃদয় সংবাদী’ বলে সাহিত্যে একটা কথা আছে। অর্থাৎ, নিজের দেশ–‌ কালের সীমানা ছাড়িয়ে বর্ণনীয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হওয়া। এই সিনেমা দেখতে দেখতে নিজেই কখন নিজের থেকে হারিয়ে গেলাম, বুঝতেই পারিনি। ডুয়ার্সে না গিয়েও ব্যোমকেশবাবুর সৌজন্যে ডুয়ার্সটা সুন্দরভাবে ঘুরে নেওয়াই যায়। পদ্মনাভ দাশগুপ্তর চিত্রনাট্যটা এতটাই টানটান যে জল তেষ্টা বা জলবিয়োগ- কোনওটাই আপনার করতে ইচ্ছে করবে না। আবিরের স্মার্ট অভিনয়, বুদ্ধিদীপ্ত অভিব্যক্তি, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এগুলোর পাশাপাশি সিনেমায় কমিক রিলিফ, গান, ইংরেজ দারোগা সব মিলিয়ে ভাললাগার এক কমপ্লিট প্যাকেজ। গোয়েন্দার সঙ্গী মানে, তাকে কিছুটা বোকা বোকা হতে হয়। এখানে ঋত্বিকের চোখ, মুখ, অভিব্যক্তিতেও বুদ্ধির ছোঁয়া। ঋত্বিককে বোকা না বানিয়েও ব্যোমকেশকে আরও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ দেখানো গেছে, এটাও কিন্তু কম সাফল্য নয়।

byomkesh

সিনেমার নাম ব্যোমকেশ পর্ব। গল্পের প্রতি পরতে পরতে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে মহাভারতের বিরাট পর্বকে মিশিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। শরদিন্দুর গল্পেও দেখা যায়, রহস্যের জট উন্মোচন করতে গিয়ে ব্যোমকেশ বারবার পরশুরামের মহাভারতের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
সমালোচনা বরং থাক। নাই বা করলাম। সমালোচনার জন্যই যদি সমালোচনা করতে হয় তবে অবশ্য আলাদা কথা। মোটকথা সিনেমাটা দেখে বেশ ভাল লেগেছে। এই সিনেমা দেখার পর মনটা অনেক দিন বেশ ভাল থাকতে বাধ্য, সে কথা বলাই যায়। অপেক্ষা করব পরবর্তী ব্যোমকেশের জন্য।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.