বাজেটেও ছাপ ফেললেন তরুণতম ভিক্টর

বেঙ্গল টাইমস প্রতিবেদনঃ বিধানসভায় তিনি বলতে উঠলেই শাসক থেকে বিরোধী, সবাই সতর্ক। তিনি বিধানসভার কনিষ্ঠতম সদস্য। সুদর্শন, স্মার্ট। বাগ্মিতায় প্রতিদিন নজর কাড়ছেন আলি ইমরান। অবশ্য ভিক্টর নামেই বেশি পরিচিত। সমীহ আদায় করে নিচ্ছেন শাসক থেকে বিরোধী সব পক্ষের। মঙ্গলবার বললেন রাজ্য বাজেট নিয়ে। বললেন সূর্যকান্ত মিশ্র, বললেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও। কিন্তু দিনের শেষে সবাইকেই যেন ছাপিয়ে গেলেন তরুণ ভিক্টর।
মূলত, হিন্দিতেই বলেন। পরিসংখ্যানের কচকচানি নয়, যুক্তির সঙ্গে মিশে থাকে শ্লেষ। প্রশংসার ছলে ছুঁড়ে দেন কটাক্ষ, যা সবার কাছেই বেশি উপভোগ্য। বেঙ্গল টাইমসের পাঠকদের জন্য সেই ভাষণের কিছু নির্বাচিত অংশ তুলে দেওয়া হল। পড়ুন, ভাল লাগবে।

আলি ইমরান (ভিক্টর)
ডক্টর অমিত মিত্রর পান্ডিত্য নিয়ে আমার মনে কোনও প্রশ্ন নেই। তাঁর বাজেটের ভুল ধরব, সেই ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই। অর্থনীতি বুঝতে গেলে যাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হয়, সেই অর্থনীতিবিদ বা শিল্পপতি বা চিটফান্ড মালিক, কারও সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা নেই। তাই অর্থনীতি নিয়ে আমার জ্ঞান নিতান্তই সামান্য। কেউ কেউ আছেন, যাঁরা কবিতা লেখা থেকে ছবি আঁকা, মাওবাদি ধরা থেকে শুরু করে ডাক্তারি, সব বোঝেন। সেই বিরল প্রতিভাও আমার নেই। তাই শুরুতেই নিজের অজ্ঞতা জানিয়ে রাখছি। আমি গ্রামীণ এলাকার বিধায়ক। সাধারণ মানুষের সঙ্গেই মেলামেশা করি। আমার সীমিত বুদ্ধি দিয়ে খোলামনে ভাবার চেষ্টা করি। কতগুলো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন জাগে। বিধানসভার বাজেট আলোচনায় সেগুলোই তুলে ধরছি।

১) শিল্পস্থাপন দিয়েই শুরু করি। প্রচুর বিনিয়োগ আসছে, প্রচুর শিল্প হচ্ছে বলে সরকার দাবি করছে। বাজেটেও তাই লেখা আছে। কিন্তু কোথায় শিল্প, কী জাতীয় শিল্প, তার কোনও উল্লেখ নেই। অন্য জেলার কথা বাদ দিলাম। বেশ, আমার জেলা উত্তর দিনাজপুরে গত চার বছরে কোন কোন শিল্প এসেছে, কোথায় কী কারখানা হল, দয়া করে বলবেন ? কোথায় কী বিনিয়োগ হল, একটু পরিষ্কার করে দিলে সুবিধা হয়। প্রশ্নটা শুরু আমার নয়, প্রায় সব জেলার বিধায়কদেরই একই প্রশ্ন। এমনকি আপনাদের বিধায়করাও বুঝতে পারছেন না, মানুষকে বলতে পারছেন না, কোথায় কী শিল্প হচ্ছে। কিন্তু এই চরম সত্যিটা তাঁরা বিধানসভায় বলতে পারছেন না। বাস্তব সত্যিটা জানার পরেও আপনিও বলতে পারছেন না। রাজ্যে শিল্পের করুণ দশাটা আপনার থেকে ভাল কে জানে ? তা সত্ত্বেও আপনাকে বাজেটে অন্য কথা বলতে হয়েছে। এমন প্রবীণ একজন মানুষকে দিয়ে এমন অবাস্তব কথাগুলো বলানো হল, এটা ভেবে খারাপই লাগছে।

২) শিল্পের পর আসি কর্মসংস্থানে। বাজেটে দাবি করেছেন, এই বছর ষোল লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। সামনের বছর নাকি আরও সাড়ে সতেরো লক্ষ কর্মসংস্থান হবে। বেশ, ধরেই নিলাম। এক বছরে ষোল লাখ হলে, একেকটা বিধানসভায় কত হয় ? ৫ হাজার ৪৪২। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। আমার বিধানসভা এলাকায় কারা চাকরি পেয়েছেন, আমি জানি না। বেশ, আমরা না হয় বিরোধী বিধায়ক, আমাদের এলাকায় চাকরি বা কর্মসংস্থান হয়নি, তাও না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু তৃণমূলের বিধায়ক তো কম নেই। এই সভায় একজন বিধায়ক উঠে দাঁড়িয়ে বলুন, তাঁর এলাকায় পাঁচ হাজার লোকের চাকরি হয়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনার এলাকায় হয়েছে ? মুখ্যমন্ত্রীর ভবানীপুর এলাকায় হয়েছে ? প্লিজ, মুখ্যমন্ত্রী আমার এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করুন। আমার ভুল হলে সেই বিভ্রান্তি দূর করে দিন। তবু বাজেটে এমন অবাস্তব দাবি কেন করা হল, কে জানে !

?????????

৩) একশো দিনের কাজে আপনি নাকি দেশের একনম্বর। দু’বছরে ৭২ হাজার কোটি টাকা নাকি খরচ করেছেন। কিন্তু রাজ্যে কতটুকু সম্পদ তৈরি হয়েছে, তার কোনও বর্ণনা নেই। কটা পুকুর, কুয়ো খোঁড়া হয়েছে ? কটা নদী সংস্কার হয়েছে ? কতটা রাস্তা হয়েছে ? এখানেও সেই হাওয়ায় ভাসানো পরিসংখ্যান। যদি এটা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় কোনও ‘জগাই মাধাই’ মামলা করে বসেন, তখন হয়ত দেখা যাবে, এই কেলেঙ্কারি সারদাকেও ছাপিয়ে যাবে। জগাই মাধাই চৈতন্যদেবকে আঘাত করলেও পরে কিন্তু তাঁরই শিষ্য হয়ে গিয়েছিলেন। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, যাঁদের ‘জগাই মাধাই’ বলে চিহ্নিত করেছেন, তাঁরা আপনাদের দলে নাম লেখাবেন না।

৪) এবার আসি সংখ্যালঘু উন্নয়ন প্রসঙ্গে। আমি সংখ্যালঘু এলাকা থেকে নির্বাচিত। আমার ইসলামপুর মহকুমায় রাজ্যের সবথেকে বেশি সংখ্যালঘু মানুষ বাস করেন। কিন্তু সেখানে তো উন্নয়নের কর্মকান্ড চোখে পড়ছে না। অথচ, আপনার বাজেট বই দেখে মনে হবে, সংখ্যালঘুদের বোধ হয় আর কোনও সমস্যাই নেই। একটা গল্প মনে পড়ে গেল। গণেশ আর কার্তিক দুই ভাই। কিন্তু কে বড়, তা নিয়ে বিতর্ক। তখন বলা হল, যে আগে পৃথিবী ঘুরে আসবে, সে বড়। কার্তিক তো বেরিয়ে পড়ল। গণেশ একটু চালাক। সে শিব আর দুর্গার চারপাশে একবার ঘুরে নিয়ে বাবা মায়ের কোলে বসে পড়ল। এই গল্পের গণেশের সঙ্গে আপনাদের অনেক মিল খুঁজে পাই। সংখ্যালঘু এলাকায় স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা, হাসপাতাল, রাস্তা, এসব করার অনেক ঝামেলা। তার থেকে ফুরফুরা শরিফে ত্বহা সিদ্দিকির কাছে চলে যাওয়া অনেক সোজা। আপনি যেদিন বাজেট পেশ করলেন, সেইদিন সন্ধেবেলাতেই আমাদের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম চলে গেলেন ফুরফুরা শরিফে। শনিবারের কাগজে আপনার বাজেট বক্তৃতার ছবি যে পাতায় ছাপা হয়েছে, সেই পাতাতেই ফিরহাদ হাকিমের ফুরফুরায় যাওয়ার ছবি ছাপা হয়েছে। যদি সত্যিই গ্রামের মুসলিমদের উন্নয়ন করতেন, তাহলে ত্বহা সিদ্দিকির কাছে ছুটে যেতে হত না।

৫) আবগারী থেকে আপনি অনেক রাজস্ব তুলবেন বলে গতবছর আশ্বাস দিয়েছিলেন। একটা ব্যাপারে আপনাদের সাফল্য মানতেই হবে। শিল্প হোক বা না হোক, আপনারা আসার পর থেকে রাজ্যে মাতাল অনেক বেড়ে গেছে। সন্ধেবেলায় স্বাভাবিক লোক পাওয়াই কঠিন। আপনার আবগারী অফিসাররা মদের দোকানদারদের রীতিমতো হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আরও মদ বিক্রি করতে হবে, নইলে লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। অধিকাংশ পরিবারে অশান্তি। প্লিজ, রেভিনিউ তোলার জন্য পরিবারগুলো এভাবে ভেঙে দেবেন না। এতকিছু করার পরেও সেই রেভিনিউ আসেনি। কারণ, মাতালরাও চালাক হয়ে গেছে। তারাও জেনে গেছে, কীভাবে সরকারকে ফাঁকি দিতে হয়। এই রাজ্যের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি নাকি জেলের ভেতরেও দিব্যি পুরানো অভ্যাস বজায় রেখেছেন। জেল সুপার বা প্রশাসনের কেউ বুঝতেও পারলেন না।

৬) সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। প্রথম বছরেই বললেন, চল্লিশটা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হবে। আগেরবার রাজ্যপালের ভাষণে বলা হল, সেগুলো নাকি তৈরি হয়ে গেছে। চল্লিশটা তো দূরের কথা, একটাও দেখাতে পারবেন ? একসঙ্গে চল্লিশটা যদি নাও পারেন, অন্তত একটা করুন। তাহলে মানুষ বাকিগুলোর ক্ষেত্রে ভরসা রাখতে পারবে। যেমন, একটা সারদা তদন্তের পর মানুষ বেশ বুঝছে, বাকি চিটফান্ডগুলোর তদন্ত হলে কী হতে পারে।

bidhansabha2

৭) বিমানবন্দর। মুখ্যমন্ত্রী যেখানেই যাচ্ছেন, বলে আসছেন বিমানবন্দর গড়বেন। কোচবিহার, হলদিয়া, অন্ডাল, দুর্গাপুর, দীঘা- সব জায়গাতেই এই প্রতিশ্রুতি। এখানেও সেই একটা কথা বলব, আগে অন্তত একটা চালু করুন। কোচবিহারে ব্রিটিশ আমলেও বিমান চলত। সেটা আপনাদের তৈরি নয়। যদিও বা চালু হল, এক সপ্তাহের মধ্যেই বন্ধ। চার বছর ধরে প্রতিটি বাজেটেই শুনি, এবার চলবে। কবে চলবে, কে জানে! তবে মাঝে মাঝে হেলিকপ্টারের কথা শুনি। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী চড়েন। সঙ্গে আরও কেউ কেউ চড়েন। তাঁদেরই কাউকে কাউকে বিমানবন্দর থেকে প্রতারণার জন্য অ্যারেস্ট করা হয়। আরেকজন দিল্লি-কলকাতা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আগামীদিনে আর কেউ চাপতে চাইবেন বলে মনে হয় না।

৮) আপনি হঠাৎ প্রবেশ কর (এন্ট্রি ট্যাক্স) বসালেন। আমি আগেই বলেছি, অর্থনীতির ছাত্র নই। তবে আইন নিয়ে পড়েছি তো। তাই সেটা কিছুটা বুঝি। আমাদের সাধারণ বুদ্ধি থেকেই বুঝতে পারছিলাম, এটা কোর্টে আটকে যাবে। ঠিক তাই হল। আপনাদের এত বড় বড় আইনজীবী। সারদার সিবিআই তদন্ত আটকাতে এগারো কোটি টাকা খরচ করলেন, তাঁরা সঠিক পরামর্শটুকুও দিতে পারেন না! আইনি পরামর্শদাতারাও বুঝে গেছেন, সঠিক পরামর্শ দিলে তাঁর চাকরি যাবে। কী দরকার, মুখ্যমন্ত্রী যেটা শুনতে চাইছেন, সেটা বলাই ভাল। আপনার বাজেট পড়তে গিয়েও বারবার সেটাই মনে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী যা শুনতে চাইছেন, আপনি ঠিক সেটাই শুনিয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু আপনার কাছে তো এমন প্রত্যাশা ছিল না। আপনি ফিকির দায়িত্ব নিয়ে যথেষ্ট সফল। সারা ভারতের শিল্পমহল আপনাকে একডাকে চেনে। এখনও বিশ্বাস করি, আপনি স্বাধীনভাবে বাজেট করতে পারলে এর থেকে অনেক ভাল বাজেট করতেন। আপনার যে সুনাম, তা আপনাকে অর্জন করতে হয়েছে। প্লিজ, সেই সুনাম রক্ষা করুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.