মধুজা মুখোপাধ্যায়, ম্যানহাটন
“Never having seen a Satyajit Ray film is like never having seen the sun or the moon.” —Akira Kurosawa
আজ আবার নতুন করে এই কথাটা অনুভব করলাম Brooklyn এর BAM Rose Cinemas এর দু নম্বর থিয়েটার এ বসে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত পথের পাঁচালী দেখতে গিয়ে। এমন নয় যে এই ছবি এই প্রথম বার দেখলাম। এ কথাও ঠিক যে এমন খুব কম বাঙালিই আছেন, যিনি এই ছায়াছবি দেখেননি। তবু আজকের অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন রকমের ।
কারণগুলোতে আসার যাক। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছায়াছবিগুলি রবি ঠাকুরের লেখার মতো – তারা বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে এবং সেগুলি একেক বয়সে বা জীবনের নানা স্তরে একেক রকম এর উপলদ্ধি নিয়ে আসে। আজ ঘর থেকে বহু দূর চেনা গন্ডির বাইরে বিদেশের এই থিয়েটার ছিল ‘House full’. বাঙালি বা ভারতীয় প্রায় চোখে পড়ে না বললেই চলে । যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় শুধু মার্কিনিদের ভিড়। নানান বয়সী পুরুষ ও মহিলা বোদ্ধারা মনযোগ দিয়ে উপভোগ করলেন ছবিটির শুরু থেকে শেষ।
ইন্দির ঠাকরুন যখন রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাঁর সম্বল ছেঁড়া কাঁথা, ময়লা কাপড়ের পুঁটুলি, ছেঁড়া মাদুর আর লোটা নিয়ে বেড়াতে গিয়ে বাড়ির পোষা বেড়াল ছানার ওপর তার পুঁটুলি ছুঁড়ে ওটিকে সম্পূর্ণ ভাবে ঢেকে দেন তখন যেমন হাসিতে ফেটে পড়ে গোটা থিয়েটার, তেমনি দুর্গার মৃত্যুসংবাদ দেবার সময় সর্বজয়ার কান্নার সাথে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ছবির শেষে বিদেশিনী দের দেখি চোখ মুছতে মুছতে থিয়েটার থেকে বেরোচ্ছেন। স্ক্রিন জুড়ে “সমাপ্ত” কথাটি ভেসে উঠতেই হাততালি তে ভরে ওঠে Rose Cinemas এর গোটা দু নম্বর থিয়েটার। বলা বাহুল্য ছবির subtitle এর মান বেশ উন্নত এবং ইংলিশ ভাষায় । কিন্তু এছবির বিশেষত্ব তার ভাষায় নয়, বরং তার ভাবে । তাই পৃথিবীর যে প্রান্তই হোক না কেন, আজও সে সমান জনপ্রিয়। থিয়েটারে কাটানো সময়টা বেশ গর্ব বোধ হচ্ছিল নিজে বাঙালি বলে। আর সেই কালজয়ী বিশ্ব বরেণ্য চিত্র পরিচালকের কথা ভেবে। মনে মনে তাঁকে আবার জানালাম “মহারাজা তোমারে সেলাম”! ছবিটি মুক্তি পাওয়ার এবং পরিচালকের মৃত্যুর বহু বছর পরও আজও রুপোলি পর্দায় তাঁর আঁকা নিশ্চিন্দিপুরের সেই ছবি সারা পৃথিবীর কাছে বড় প্রিয়।
১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৫৮ সালে লাগাতার প্রায় ৮ মাস New York এর Fifth Avenue Playhouse এ ছবি বহু বিদেশি দর্শকের মনোরঞ্জন করেছে । ১৯৯৩ সালে (সত্যজিৎ রায় Oscar পুরস্কার পাবার দু বছর পর) London এর Henderson’s Film Laboratories এ ছবির সাথে সাথে তাঁর আরও অনেক ছবির অরিজিনাল প্রিন্ট আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়ে যায় । সেই থেকে শুরু হয় হারানো ছবি গুলিকে পুনর্জীবন দানের প্রচেষ্টা । অনেক্ গুলির মধ্যে Apu Trilogy র তিনটি ছবি পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার ছবিগুলির অরিজিনাল প্রিন্ট কে প্রযুক্তির মাধ্যমে পুনঃ প্রাণ প্রদানের কাজ শুরু হয় । যে কাজ সম্মিলিত ভাবে ২০১৩ সালে Criterion Collection এর সাথে Academy Film Archive শুরু করেন তাকে সফল করেন Bologna র L’Immagine Ritrovata । প্রায় হাজার ঘন্টা কাজ করে Janus Films, The Academy, The Harvard Film Archive ও The British Film Institute এ সংরক্ষণে রাখা ছবিটির ডুপ্লিকেট নেগেটিভ থেকে অংশবিশেষ নিয়ে আসল প্রিন্ট টিকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা অনেকটাই সফল হয়। লাগাতার প্রায় ছমাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর Criterion Collection restoration lab সফল হয় এই কাজে।এবছরের ৮ ই মে থেকে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে Apu Trilogy র ছবিগুলির প্রদর্শণ চলছে। অসাধারণ ছবির প্রিন্ট এবং শব্দ সংরক্ষণ এর মানও অতুলনীয় তাই সাধুবাদ জানাই সেই সব technician দের, যাঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে সফল হযেছেন। ফলে পূর্ণ মর্যাদা পেয়েছে চলচিত্র জগতের ঐতিহাসিক এই মুহূর্ত গুলি। তাঁরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে আবার প্রমাণ করলেন Akira Kurosawa র কথাগুলি কতটা সত্য।
ছবি শেষে একদিকে মন ভারাক্রান্ত এই ভেবে যে বিদেশে বসে এই ছবি দেখার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটল আজ। অন্য দিকে এটা ভেবেও উত্তজনার অনুভূতি টের পেলাম যে বিশ্ব জুড়ে আমার বাংলার জয়জয়কার আজ বর্তমান। থিয়েটার পেছনে ফেলে Brooklyn থেকে Manhattan ফেরার পথে মোবাইল এ তারিখ দেখলাম ১২ই সেপ্টেম্বর , মনে পড়ে গেল আরে, আজ তো বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের জন্মদিনও বটে, যাঁর কালজয়ী উপন্যাস পথের পাঁচালীকে কেন্দ্র করে চলচিত্র ও প্রযুক্তি জগতে এত কর্মকান্ড বছরের পর বছর ঘটে চলেছে ! জয় বাংলার জয় , জয় বাঙালির জয় বলে মেট্রো স্টেশনে পা বাড়ালাম।