পশ্চিমবঙ্গ ! ঠিকই তো আছে, বদলাতে হবে কেন?

ময়ূখ নস্কর

বাবা না মা ? কার মুখে পশ্চিমবঙ্গ শব্দটা প্রথম শুনেছিলাম ? মনে নেই। শোনার পর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মনে?

তাও মনে নেই। অনেক ছোট ছিলাম তো ! কিন্তু একটু বড় হয়েই সেই অমোঘ প্রশ্নটি মনে এসেছিল। যেমন সবার আসে। ভারতের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত রাজ্যের এমন নাম কেন? নামের আগে পশ্চিম কেন ?

উত্তর পেলাম। সেই প্রথম জানলাম, ১৫ আগস্ট মানে শুধু স্বাধীনতা নয়। ১৫ আগস্ট মানে দেশভাগ, বাংলাভাগ। ১৫ আগস্ট মানে শুধু ফুল-পতাকা-মিষ্টি নয়, নর্দমা দিয়ে বয়ে যাওয়া রক্তের স্রোত, পচাগলা বেওয়ারিস লাসের দুর্গন্ধ। ১৫ আগস্ট মানে স্বজনহারানো কান্নাও।

আরও বড় যখন হলাম, রবীন্দ্রনাথের একটা গান শুনলাম। “তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে। …আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে, বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে।” জানি, এটা প্রেম পর্যায়ের গান। জানি, রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতা, দেশভাগ কিছুই দেখে যেতে পারেননি। তবুও মনে হল, এ যেন দেশভাগের দুঃসহ বেদনার গান।
bangla2

১৪ আগস্ট “সুপ্ত রাতে” আমাদের স্বাধীনতা এল। এল “কোন ভাঙনের পথে।” আর আমরা খণ্ডিত ভারতের, খণ্ডিত বাঙলার বাসিন্দারা “রক্তমণির হারে গেঁথে” রাখলাম। কাকে ? পশ্চিমবঙ্গ শব্দটাকে। ওই শব্দটাই তো সাক্ষাৎ রক্তমণি। যার সর্ব অঙ্গ থেকে রক্ত ঝরছে। দেশভাগের রক্ত, ভিনধর্মী ভাইয়ের রক্ত। যতবার এই
শব্দটা উচ্চারিত হবে, ততবার সেই রক্তমণির হার আমাদের “বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে।” ফাল্গুন হাওয়ায় হাওয়ায় সুরহারা মূর্ছনাতে হাহাকার করে ফিরবে সেই শব্দ।

কেউ বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ নামটার জন্য প্রশাসনের কাজে অসুবিধা হয়। কেউ বলছেন, এই নাম দেশভাগের দুঃখ বহন করে। তাই এই নাম বদলানো দরকার। কিন্তু প্রশাসনের সুবিধার জন্য কি ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় ? নাকি করা উচিত ? নাম বদলে কি দেশভাগের ইতিহাসকে বদলানো যাবে ? ইতিহাস অপরিবর্তনীয়। ইতিহাস মানবজাতির সর্বোত্তম শিক্ষক। অতীতের ঘটনা তুলে ধরে সে শিক্ষা দেয়। তর্জনী তুলে বলে, “দ্যাখো দ্যাখো, মানুষের ভুলের এই পরিণাম। ধর্মান্ধতার এই পরিণাম।”

পশ্চিমবঙ্গ শব্দটি প্রতি মুহূর্তে আমাদের শাসন করে। জানান দেয়, নোয়াখালীর দাঙ্গা, বিহারে পাল্টা দাঙ্গা, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং, শিয়ালদা স্টেশনে শরণার্থীর ভিড়, বেলেঘাটায় গান্ধীজীর অনশন। সব, সব, ইতিহাস লুকিয়ে আছে ওই একটা শব্দের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ামাত্রই সেই ইতিহাস সামনে আসে। রাজ্যের নাম বদলে গেলে কি আর তা হবে?

bangla

জ্ঞান হওয়ার পরেই কোনও শিশু কি জানতে চাইবে, এমন নাম কেন হল? এমনিতেই তো আমরা ইতিহাস বিস্মৃত জাত। পশ্চিমবঙ্গ নামটা ভুলে গেলে হয়তো দেশভাগকেও ভুলে যাব। হয়তো আবার এগিয়ে যাব, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার দিকে। ভয় হয়। সময় বড় অশান্ত। “চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।” এখনই তো পশ্চিমবঙ্গকে বেশি করে আঁকড়ে ধরার সময়। দেশভাগের স্মৃতিকে মনে করার সময়।

দোহাই, রাজ্যের নাম বদলাবেন না।

(রাজ্যর নামবদল নিয়ে নানা স্তরেই চলছে বিতর্ক। সুস্থ বিতর্ক সবসময়ই স্বাগত। বেঙ্গল টাইমসও নানা মতকে তুলে ধরবে। এই বিষয়ে আপনার মতামত যুক্তিসহ লিখে পাঠান। )

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.