আরণ্যক ঘোষ
তখন দরজায় সবে কড়া নাড়ছে সাতের দশক। চার বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়েছিল পালামৌ জঙ্গলে। সেখানে একটি স্টেটসম্যান কাগজে আগুন ধরিয়ে একজন বলেছিল, সভ্যতার সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ। নিশ্চয় অরণ্যের দিনরাত্রির কথা মনে পড়ছে !
ঠিক তিরিশ বছর পর। সেই চরিত্রগুলো এখন কে কেমন আছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল আরেকটি ছবি- আবার অরণ্যে। এবারও লেখক সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তবে পরিচালক গৌতম ঘোষ। এবার আর পালামৌ নয়, উত্তরবঙ্গের জঙ্গল। জয়ন্তী নদীর সেই ভাঙা ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে শাশ্বত-র সেই সংলাপটা মনে পড়ছে ? ‘সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছি।’ আসলে, ওই ভাঙা ব্রিজ থেকে সেদিন মোবাইলের নেটওয়ার্ক পেয়েছিলেন শুভেন্দু-পুত্র শাশ্বত।
সেটা ২০০৩। মোবাইল নামক জিনিসটা কলকাতার গন্ডি ছেড়ে তখনও সেভাবে বাইরে পা রাখেনি। তখনই নাকি জয়ন্তীর ভাঙা ব্রিজ থেকে নেটওয়ার্ক পেয়েছিলেন। কিন্তু এই ২০১৫ তে, যখন প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছে মোবাইল পরিষেবা, তখন জয়ন্তী কিন্তু প্রায় পরিষেবার বাইরেই। কখনও নদীর ধারে বা কখনও সেই ভাঙা সেতুর কাছে গিয়ে হয়ত নেটওয়ার্ক খুঁজতে হবে। আর নেটওয়ার্ক পেলে শাশ্বত-র মতোই বলতে হবে, সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছি। কয়েকমাস আগে মুখ্যমন্ত্রী থেকে গেলেন। তখন সাময়িকভাবে টাওয়ারের ব্যবস্থা হয়েছিল। এখন আবার সেই কলড্রপের সমস্যা।
আসলে, যে কথা বলতে দুটি সিনেমার উপমা টানা, তা হল, জয়ন্তীতে এখনও পর্যটনের পরিকাঠামোই গড়ে ওঠেনি। ডুয়ার্সের রানি বলা হয় এই জয়ন্তীকে। সাহিত্যে, সিনেমায় বারবার উঠে এসেছে এই জয়ন্তী। ডুয়ার্সে বেড়ানোর কথা উঠলেই অনেকের মন ছুটে যায় জয়ন্তীতে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও বারবার জয়ন্তীকে ঘিরে টুরিজম সার্কিট গড়ে তোলার কথা বলেছেন। কিন্তু কথাই সার। পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে গেলে যা যা পরিকাঠামো লাগে, তার অধিকাংশই নেই এই জয়ন্তীতে।
কী কী নেই, সেই তালিকায় না হয় আগে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
১) সারা বাংলা জয়ন্তীর নাম জানে। অথচ, এখানে কোনও এটিএম কাউন্টার নেই। পর্যটকদের অনেকেই সঙ্গে হয়ত তেমন টাকাপয়সা আনেননি। ভেবেছেন, জয়ন্তীতে গিয়ে এটিএম থেকে তুলে নেবেন। কিন্তু এটিএম না থাকায় কত লোককে যে কত অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়!
২) বেশ এটিএম না হয় নেই। ব্যাঙ্ক থাকলেও অন্তত চেক থেকে টাকা তোলা যেত। অন্তত হোটেলের বিল বা গাড়ির বিল মেটানো যেত। হায়! ব্যাঙ্কও নেই।
৩) সবার গাড়িতে আসার সামর্থ্য থাকে না। আলিপুরদুয়ার থেকে তেমন দূরও নয়। মোটামুটি তিরিশ কিমির মতো। কিন্তু একটি বাস। সকালে যায়, বিকেলে ফিরে আসে। আর যাতায়াতের কোনও উপায় নেই। সকালের বাস মিস করলে তাঁর গাড়ি ভাড়া করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
৪) জঙ্গলে এসে হঠাৎ যদি রোগ অসুখ হল! বা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। না, কোনও নার্সিংহোম বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। এমনকি ডাক্তারও নেই।
৫) যাঁরা মিনারেল ওয়াটার গাড়িতে লোড করে আনলেন, তাঁদের কথা আলাদা। দু একটা দোকানে সেই বোতল পেতেও পারেন। কিন্তু এছাড়া পরিশ্রুত পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থাই নেই।
৬) বেশিরভাগ এলাকাই ফরেস্টের জায়গা। ফলে হোটেল করার সরকারি অনুমতি নেই। তবু লিজ নিয়ে যাঁরা করেছেন, সেখানেও নির্দিষ্ট কোনও রেট কার্ড নেই। যার যা খুশি, সে তাই ভাড়া নেয়।
৭) গাড়ির ক্ষেত্রেও তাই। নির্দিষ্ট কোনও রেট নেই। যার যা খুশি, তাই নেয়। সেটা না দিয়ে উপায়ও থাকে না। গাইডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একেক জন একেক রকম রেট হাঁকবেন। আবার গাইড না নিয়ে আপনি জঙ্গলে ঢুকতেও পারবেন না।
৮) জঙ্গল সাফারি। যে কোনও পর্যটকই এই সাফারিতে যেতে চান। জলদাপাড়ার মতো এখানে হাতি সাফারির ব্যবস্থা নেই। বন দপ্তর বারবার বলছে, গাড়িতে কমার্শিয়াল নম্বর নিতে। কিন্তু চালকদের আগ্রহ নেই। তাই গভীর জঙ্গলে এইসব গাড়ি ঢুকতেও পারে না। অথচ, জলদাপাড়া বা চিলাপাতায় এই ব্যবস্থা আছে।
৯) সরকারি পরিষেবা তেমন নেই। যে বাংলো আছে, তার বুকিংয়ে নানা ঝামেলা। দরও আকাশছোঁয়া। বন দপ্তরের উদ্যোগে কয়েকটি কটেদজকটেজ করার কথা অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এখনও সেই কটেজ তৈরি হয়নি। কবে হবে, তার কোনও নিশ্চয়তাও নেই।
মুখ্যমন্ত্রীকে এটিএম খুঁজতে হয়নি। ডাক্তারখানায় যাওয়ার দরকার পড়েনি। এমনকি পাবলিক বাসেও আসতে হয়নি। সঙ্গে এত বড় বাহিনী। তাই নেটওয়ার্ক খোঁজারও দরকার নেই। জলের ব্যবস্থাও নিশ্চয় ছিল। তবু তিনি চলে গেলেন। তাহলে সাধারণ পর্যটকদের অবস্থা কী হতে পারে, একটু ভেবে নিন।
আসলে, সভ্যতার সঙ্গে এখনও বোধ হয় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।