এই দিনে কতকিছু! এই পনেরোই আগস্ট ভারতের বুকে চলতে শুরু করেছিল ট্রেন। বম্বে থেকে থানে। সেই রেলযাত্রা ও তার বিবর্তনের কথা তুলে ধরলেন ময়ূখ নস্কর ।।
ভারত হয়তো নব্বই বছর আগেই স্বাধীন হয়ে যেত। হল না এক সর্বনেশে ১৫ আগস্টের জন্য।
১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ব ভারতে চালু হল রেল চলাচল। প্রথম দফায় সেই রেলের যাত্রাপথ ছিল হাওড়া থেকে হুগলী। মধ্যপথে রেল থেমেছিল বালি, শ্রীরামপুর আর চন্দননগরে। এর এক বছর আগেই বম্বে থেকে থানে রেল চালু হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতার লাগোয়া হাওড়ায় রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার গুরুত্বই ছিল আলাদা।
দেশ জুড়ে রেলপথ পাতার সুবিধা ইংরেজরা পেয়েছিল কয়েক বছর পরে। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময় দ্রুতগতিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সেনা পাঠাতে পেরেছিল। আধুনিক প্রজুক্তির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বিদ্রোহী সিপাহিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
দেশ স্বাধীন হল না বটে, কিন্তু ভারতের সমাজ জীবনের খোল নলচে বদলে দিল রেল। এই পরিবর্তনের তার বিবরণ পাওয়া যায় রমাপদ চৌধুরির “প্রথম প্রহর” উপন্যাসে। প্রথম প্রথম সবাই ভেবেছিল “ও গাড়িতে উঠলে জাত যাবে সকলের। বামুন বাগদির তফাত নেই, সব গায়ে গা দিয়ে নাকি বসতে হয়।” সবাই ভেবেছিল, ওই গাড়ির জন্যই নাকি কলেরার মড়ক লেগেছে। তারপর আস্তে আস্তে প্রয়োজনের তাগিদে কুসংস্কার উড়ে গেল। “তারপর ক্রমশ দেখা গেল গ্রামের মেয়েরা রেলগাড়ির পুজো করে ঘরে ঘরে, রেলের দৌলতেই নাকি দুর্ভিক্ষ গেছে দেশ থেকে, খেয়ে পরে বেঁচেছে তারা।“
শুধু সামাজিক পরিবর্তন নয়, পরবর্তী কালে এই রেলকে কাজে লাগিয়েই ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। নেতাজি সুভাষচন্দ্র কলকাতার বাড়ি থেকে অন্তর্ধান করে সোজা চলে গিয়েছিলেন, ধানবাদের কাছে অখ্যাত গোমো স্টেশনে। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর বিখ্যাত অজ্ঞাতবাস পর্ব।
একই ভাবে লাহোর থেকে রেল পথে কলকাতায় চলে এসেছিলেন বিপ্লবী ভগত সিং। ভগত সিং যে দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই হিন্দুস্তান রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন অস্ত্র কেনার জন্য ট্রেন লুট করেছিল। ট্রেনে ছিল ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব। উত্তরপ্রদেশের কাকোরি নামক স্থানে ঘটেছিল সেই ঘটনা।
রেল স্টেশনের সাথে জড়িয়ে আছে, দুই বাঙালি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকির নাম। মুজফফরপুরে বোমা ছোড়ার পর ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল আলাদা আলাদা ভাবে পালিয়েছিলেন। পরদিন ট্রেনে উঠে পালানর সময়, মোকামাঘাট স্টেশনে ধরা পড়ে যান পর প্রফুল্ল চাকি। আত্মহত্যা করেন তিনি। আর অন্য একটি স্টেশনে (বর্তমানে ক্ষুদিরামের নামেই ষ্টেশনটির নামকরণ করা হয়েছে) জল খেতে গিয়ে বন্দী হন ক্ষুদিরাম। বন্দী ক্ষুদিরামকে ট্রেনে করে নিয়ে আসা হয়, মুজফফরপুরে। পরদিন স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা হয়, “বালকটিকে দেখার জন্য স্টেশন ভিড়ে ভেঙে পড়েছিল। ১৮ বা ১৯ বছরের একটি সামান্য বালক, দেখে মনে হয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল বাইরে রাখা ফিটন গাড়ির দিকে, যেটা তার জন্যই রাখা ছিল। আনন্দের সঙ্গেই গেল, যেন কোনও উদবেগ নেই। গাড়ির আসনে বসে চিৎকার করে সে বলল বন্দেমাতরম। ”