দেশপ্রেম : ভিতরে ? না বাইরে ?

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম এটা নিয়ে কিছু লিখবো। যেভাবে দেশে এখন “দেশপ্রেম” নিয়ে লোকদেখানো আদিখ্যেতা করছে একদল “স্বঘোষিত দেশপ্রেমী” তাতে এক এক সময় মনে হয় দেশটা শুধু তাদেরই। বাকিরা সব অবাঞ্ছিতভাবে এদেশে রয়েছে। কিন্তু দেশটা কি শুধু একটা বিশেষ জাতি বা ধর্মের বা বর্ণের বা সম্প্রদায়ের মানুষের নাকি? দেশটা তো প্রতিটি ভারতবাসীর। তবুও এতো “দেশপ্রেমের আদিখ্যেতা” কেন ?
দেশে নাকি এখন দেশপ্রেমের জাগরণ ঘটেছে !! দেশাত্মবোধের স্ফূরণ ঘটেছে !! জাতীয়তাবাদের বান ডেকেছে !! এমনই সেই বান,তাতে সবাইকে হাত তুলে স্রোতের অভিমুখে ভেসে চলতে হবে। আপনার বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়স্বজন,প্রতিবেশী সবার কাছে প্রকাশ করতে হবে যে আপনি দেশপ্রেমী। আপনি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ। আর তা না করে মানে বাহ্যিকভাবে এই দেশপ্রেমের আদিখ্যেতা না দেখালেই একদল আপনাকে আখ্যা দেবে “দেশদ্রোহী”। আপনি যদি মনে মনে দেশকে ভালোবেসেও এদের এই মেকি দেশপ্রেমের আদিখ্যেতাতে আপত্তিও জানান, তবুও আপনি তাদের চোখে “দেশদ্রোহী” বা “দেশের শত্রু” বলে গণ্য হবেন। এবং বলা বাহুল্য ভারতবর্ষের বহু বিশিষ্টজন আজকে এই “স্বঘোষিত জাতীয়তাবাদীদের” কাছে সেই আখ্যাই পেয়েছেন । একথাও দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে বর্তমানে কেন্দ্রের সরকারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই মেকি জাতীয়তাবাদীদের মদত জোগাচ্ছে।

modi4
ভারতবর্ষ এক সুবিশাল দেশ। এখানে নানা ভাষা,নানা জাতি,নানা ধর্ম,নানা বর্ণের মানুষের সমাহার। তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ আচার-বিচার, সংস্কৃতি রয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা প্রত্যেকেই ভারতবাসী। ভারতবর্ষই তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান জোগাচ্ছে। ভারতবর্ষই তাদের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্র। তাই প্রত্যেকেই হয়তো নিজ নিজ আচার, বিচার, সংস্কৃতি অনু্যায়ী দেশকে পূজা করেন বা দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। সেটা ভিন্ন ভিন্ন ঊপায়ে হতে বাধ্য কারণ এই দেশ বিভিন্ন ধর্ম,বর্ণ,জাতির মানুষের মিলনক্ষেত্র। কিন্তু তাই বলে তাদের এক অনুশাসনে, এক রীতিতে আবদ্ধ করার প্রয়াস কেন ? কেন ধর্মান্তকরণ ? কেন তাদের একটি বিশেষ ধর্মের আচারে, বিচারে বেঁধে ফেলার প্রচেষ্টা ? তারাও তো ভারতবাসী। তাদের নিজস্ব আচার, অনুষ্ঠান থাকতেই পারে। ভারতবাসী হিসাবে তাদের মৌলিক অধিকারে, তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে, রীতি নীতিকে আরেকদলের হস্তক্ষেপ করাই কি “দেশপ্রেম” দেখানো ? নিজেদের “জাতীয়তাবাদী” প্রতিপন্ন করা ?
সম্প্রতি দেশের একজন খ্যাতনামা অভিনেতার সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ঘিরে এই “মেকি জাতীয়তাবোধ” আবার ঘি ঢালা আগুনের মত জেগে উঠেছে। সেই ছবি নাকি এক তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীর জীবন কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। আর সেই তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী নাকি ভারতবর্ষের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের এক মৌলবাদীর সঙ্গে অশুভ আঁতাত রেখেছিল। সুতরাং তার জীবন নিয়ে নির্মিত কাহিনীর নায়ক, নায়িকা ও অন্যান্য কলা কুশলীরা সবাই এই ছবিতে কাজ করে দেশের প্রতি চরম অবমাননা করেছেন। তাদের দেশাত্মবোধ নেই। তারা দেশদ্রোহী। ইত্যাদি ইত্যাদি। বছর দুই আগে দেশের আরও একজন স্বনামধন্য অভিনেতা একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন যেখানে নাকি হিন্দু দেবদেবীদের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন বলে সেই ছবিকেও একদল উগ্র ধর্মান্ধ লোক নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল এবং সেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা “দেশদ্রোহী” র আখ্যা পেয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেক সদস্যই এই ব্যাপারের সহমত পোষণ করেছিল এবং এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করেছিলো বা ইন্ধন ও জুগিয়েছিলো। অথচ সেই ছবিটি বিদেশের মাটিতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিলো আর বিদেশের মাটিতে ব্যবসা করে তার লাভের সূচকটাওবেশ উঁচু যা দেশের অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধির পক্ষেই অনুকূল। আর এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণ নিজেদের সুচিন্তিত মতামত ব্যাক্ত করেছিলেন বিভিন্ন মিডিয়া তে বা সংবাদপত্রে। তাদের প্রত্যেকেরই মতামত ছিল প্রধানমন্ত্রীর এই “তুঘলকি সিদ্ধান্ত” একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতির মূলে কুঠারাঘাত, তেমনি দেশের সিংহভাগ মানুষ যারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত, তাদের দৈনন্দিন জীবনেও এই সিদ্ধান্ত বিস্তর প্রভাব ফেলবে,স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে। সেখানে নোবেলজয়ী বরেণ্য অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যেমন ছিলেন, তেমনি কৌশিক বসু,অসীম দাশগুপ্ত, প্রভাত পট্টনায়কের মত লব্ধপ্রতিষ্ঠ অর্থনীতিবিদও তাঁদের মতামত দিয়েছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, একদল অশিক্ষিত, অসভ্য, নিম্নরুচির কিছু ‘স্বঘোষিত দেশপ্রেমী” তাঁদেরকেও মিডিয়াতে বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল আক্রমণ করতে দ্বিধাবোধ করেনি। সেই সমস্ত অর্বাচীন, নির্বোধদের চোখে এঁরা সবাই “দেশদ্রোহী” বা দেশের শত্রু। শুধু বর্তমানে কেন্দ্রের সরকার, প্রধানমন্ত্রী আর তাঁদের সদস্য আর এঁরাই হল ভারতবর্ষের প্রকৃত নাগরিক, প্রকৃত জাতীয়তাবাদী।

modi5
প্রশ্ন হচ্ছে কীসের জন্য এই দেশপ্রেমের আদিখ্যেতা করা ? একটা চলচ্চিত্র-সেটা একটা চলচ্চিত্রই। তার সঙ্গে বাস্তব জীবনের মিল থাকলেও তার সীমা প্রেক্ষাগৃহের পর্দাতেই বা টেলিভিশনের পর্দাতেই। মানুষ চলচ্চিত্র দেখতে যায় গতানুগতিক ব্যাস্ত জীবনে একটু বিনোদনের স্বাদ নিতে। বিনোদন টাই সেটাকে মুখ্য। সেই চলচ্চিত্রের ওপরেও কেন এত নিষেধাজ্ঞা ? এটা তো প্রকারান্তরে দেশের একজন শিল্পীর পেশাগত ক্ষেত্রে আঘাত হানা। আর ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র, বিদেশের বহু জায়গায় সমাদৃত। সুতরাং বাণিজ্যিক কারণে এবং দেশের অর্থনীতির পক্ষেও তা বহুলাংশেই লাভজনক। তাহলে দেশের একজন নাগরিক হয়ে আর একজন নাগরিকের রুটি-রুজির ওপরে আঘাত হানা বা তার পেশাগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করাটা কেমন দেশপ্রেম ? আর জাতীয়তাবোধের উদ্বুদ্ধ এইসব ‘‌গৌরবময় সন্তান’‌দের এ কেমনতরো জাতীয়তাবোধ, যে বিদেশের মাটিতে সমাদৃত হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নকারী একটি চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পারতপক্ষে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির দুয়ার রুদ্ধ করা ?
সমস্যা একটাই। প্রকৃত শিক্ষার অভাব। সংস্কৃতির অভাব। তাই চেতনারও অভাব। একবিংশ শতকে এসেও যারা ধর্মীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, কুসংস্কার-বিচ্ছিন্নতাবাদী মনস্ক যারা প্রকৃত জাতীয়াতাবোধের উন্মেষ তাদের মধ্যে বিকশিত হওয়া কখনই সম্ভব না। বরং যা বিকশিত হয়, তা একপ্রকার বিষই বটে। দেশের গুণীজন দের অশ্লীল আক্রমণ করে জাতীয়তাবাদের প্রমাণ দেওয়া যায় না কোনদিন। দেশের মানুষের পেশার ওপর আঘাত হেনে জাতীয়তাবোধের পরিচয় দেওয়া যায় না। দেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ, জাতি-সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভাজন ঘটিয়ে দেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া যায় না। কারণ প্রকৃতপক্ষে তা দেশের মহামান্য সংবিধান কেই অবমাননা করা। দেশের সংবিধান এক জাতি এক রাষ্ট্রের কথা বলে। দেশের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা লেখা আছে সেই সংবিধানে। তাকে না মেনে চললে দেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া তো যায়ই না, বরং দেশ ও দশের চোখে তারাই “দেশদ্রোহী”, তাদেরকেই দেশের শত্রু আখ্যা দেওয়া উচিত। তাই প্রশ্ন জাগে এইসব “দেশপ্রেমী” দের দেশপ্রেম কি অন্তরে ? না কি পুরোটাইএকটি রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে লোক দেখানো,বাহ্যিক একটা আড়ম্বর মাত্র ?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.