স্বরূপ গোস্বামী
(আজ, ৩০ অক্টোবর মারাদোনার জন্মদিন। ঠিক এক সপ্তাহ আগে পেরিয়ে গেছে পেলের জন্মদিন। দুই কিংবদন্তিকে বেঙ্গল টাইমসের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কাল্পনিক আড্ডায় উঠে এল কলকাতা। সেই আড্ডায় আপনিও সামিল হতে পারেন।)
সাত সকালে মারাদোনার বাড়িতে ফুল নিয়ে হাজির ফুটবল সম্রাট পেলে। আগে থেকে কোনও খবর ছিল না। একেবারেই চমকে দিতে চেয়েছিলেন। দরজা খুললেন স্বয়ং মারাদোনা। প্রথমেই চমকে গেলেন পেলেকে দেখে। হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে পেলে বললেন, হ্যাপি বার্থ ডে।
মারাদোনা ইংরাজি তেমন না বুঝলেও হ্যাপি বার্থ ডে টুকু বোঝেন। স্প্যানিশ বা পর্তুগিজে কাজ চালানো আড্ডা হতেই পারত। ওঁরা ঠিক করলেন বাংলাতেই কথা বলবেন।
মারাদোনাঃ শুভ বিজয়া।
বলেই প্রণাম করতে যাচ্ছিলেন।
পেলে থামিয়ে দিলেন। আমি বয়সে বড় ঠিক কথাই। তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছি তাও ঠিক। কিন্তু প্রণাম করতে হবে না। কারণ, আমার শ্রেষ্ঠত্ব তুমি কোনওদিনই মানোনি। যেখানেই যাও, আমাকে গালমন্দ করো। মন থেকে শ্রদ্ধা যখন করো না, তখন প্রণাম নাই বা করলে।
দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন।
মারাদোনা চাইলে পাল্টা দু’চার কথা শুনিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু ঘরে আসা অতিথি, তার উপর ফুটবল সম্রাট পেলে। তার উপর জন্মদিনে ফুল নিয়ে এসেছেন। তাই সৌজন্য দেখিয়ে মুচকি হাসলেন।
মারাদোনাঃ দিন কয়েক আগে তো আপনারও জন্মদিন গেল।
পেলেঃ হ্যাঁ, নানা প্রান্ত থেকে অনেক ফোন, মেসেজ পেয়েছি। কিন্তু তোমার কাছ থেকে কিছু আসেনি। এলে ভালই লাগত। পঁচাত্তর বছর হল। জানি না, আর কতদিন বাঁচব।
মারাদোনাঃ আপনার সব খবরই আমি রাখি। শুনলাম, পুজোর আগে কলকাতা থেকে ঘুরে এলেন।
পেলেঃ এই প্রথম নয়। আমি আগেও একবার গিয়েছিলাম, সাতাত্তরে। তখনও তুমি দেশের হয়ে খেলোনি।
মারাদোনাঃ আমি গিয়েছিলাম বছর সাতেক আগে। সে কী উন্মাদনা! রাত বারোটায় রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। মেয়েরা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছিল আমাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
পেলেঃ হ্যাঁ, আমার এজেন্ট বলছিল। বলেছিল, তুমি দারুণ আতিথেয়তা পেয়েছো। আমিও তেমনই পাব। কিন্তু বিশ্বাস করো, সেই উন্মাদনা পেলাম না। সবটাই যেন সাজানো ব্যাপার। কেমন যেন কর্পোরেট কর্পোরেট ব্যাপার। সেই উন্মাদনা ছিল না।
মারাদোনাঃ আপনি তো সেটাই পছন্দ করেন। সব সময় কোট-টাই পরে থাকেন। তাই আপনাকে হয়ত কাছের মানুষ ভাবতে পারেনি। আমি ছিলাম একেবারে ওদের মতো পোশাকে। ওদের সঙ্গে ওদের মতো করেই পাগলামি করেছি। গাড়ির বনেটে উঠে নেচেছি। ওরাও খুব আনন্দ পেয়েছিল। বারবার মনে পড়ে সেই মুহূর্তগুলো।
পেলেঃ আমার কি আর সেই বয়স আছে ভাই! তাছাড়া, তুমি যেটা করে অভ্যস্থ, আমি কখনই তেমনটা করিনি। খেলোয়াড় জীবনে গোল করে ওই একটু ছুটে যাওয়া। এর বেশি উচ্ছ্বাস কখনই দেখাইনি।
মারাদোনাঃ আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এক প্রবীণ কিংবদন্তির বাড়িতে। তিনি নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু। তাই আমারও বন্ধু। এখন উনি কেমন আছেন ?
পেলেঃ তুমি বোধ হয় জ্যোতিবাবুর কথা বলছ। এখন তিনি আর নেই। সত্যিই এক কিংবদন্তি মানুষ ছিলেন।
মারাদোনাঃ ওখানকার স্পোর্টস মিনিস্টার। মাথায় পানামা হ্যাট। তিনি কেমন আছেন ?
পেলেঃ তিনিও নেই। তিনি জ্যোতিবাবুরও আগে মারা গেছেন। তিনি থাকলে আমার এমন দুর্গতি হত না। ওখানে বিভিন্ন লোকের কাছে যা শুনলাম, তিনি প্রাণখোলা মানুষ ছিলেন। তিনি থাকলে আমাকে এভাবে কর্পোরেটদের খপ্পরে পড়তে হত না। কিছুটা প্রাণের স্পন্দন টের পেতাম।
মারাদোনাঃ আপনি নাকি পুজো উদ্বোধনে গিয়েছিলেন ?
পেলেঃ হ্যাঁ, জোর করে ধরে নিয়ে গেল। এক মন্ত্রী, নাম ববি হাকিম। অনেকদিন ধরে ওখানে পুজো করছে। বলল, চলুন, একটু ঘুরে আসবেন। সে কী ভিড়। মানুষ যত না, পুলিশ তার থেকে ঢের বেশি। দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
মারাদোনাঃ কাগজের ছবিতে এক মহিলাকে দেখলাম।
পেলেঃ উনিই এখন বাংলা চালাচ্ছেন। আমার জন্মদিনের দশ দিন আগেই জন্মদিন পালন করে ফেললেন। কেক কেটে আমাকে খাইয়েও দিলেন।
মারাদোনাঃ এই মহিলা কি বামপন্থী?
পেলেঃ আমি ওসব বুঝি না বাপু। তবে কেউ কেউ বলে উনি নাকি বামেদের থেকেও বেশি বামপন্থী। এমনই জঙ্গি নেত্রী, কোনও শিল্পপতি নাকি রাজ্যে আসতে চায় না।
মারাদোনাঃ আর কে ছিল ?
পেলেঃ সৌরভ নামে এক ছোকরা। আগে ক্রিকেট খেলত। নিশ্চয় ভালই খেলত। নইলে আমার পাশের চেয়ারে ওকে বসাবে কেন ? এখন নাকি ফুটবলের দল কিনেছে। দেখলাম, সবাই ওকে দাদা বলছে। যদিও আমার থেকে বয়সে ছোট। তবু আমিও বললাম। যে মুখ্যমন্ত্রী, তাকে নাকি সবাই দিদি বলে। সেও বয়সে আমার থেকে ছোট। তবু আমিও দিদি বললাম।
মারাদোনাঃ বলেন কী? খেলত ক্রিকেট। আর ফুটবলের দল চালাচ্ছে ?
পেলেঃ হ্যাঁ, টাকা থাকলে, গ্ল্যামার থাকলে অনেককিছুই হয়। স্পন্সররা ওকে সামনে রেখেছে। অথচ, তোমার বা আমার নাম তো খুব কম নেই। আমাদের কেউ ক্রিকেট বা হকিতে ডাকল না।
মারাদোনাঃ ছেলেটা নিশ্চয় তোমার খেলা দেখেছে।
পেলেঃ না, না। কী করে দেখবে ? ওর জন্মই তো তিয়াত্তরে। তার আগে আমার তিনবার বিশ্বকাপ জেতা হয়ে গেছে। আমার সামনে আমাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে শুনলমা, ও নাকি তোমার ফ্যান। প্রকাশ্যেই নাকি বলে, তার প্রিয় ফুটবলার মারাদোনা। তবে আমার সামনে অবশ্য বলেনি। যাক, লোকজনের সামনে সম্মানটুকু অন্তত রেখেছে।
মারদোনাঃ আমাকে ওখানকার শতাব্দীপ্রাচীন মোহনবাগান মাঠে নিয়ে গিয়েছিল। আপনাকে নিয়ে যায়নি?
পেলেঃ মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল কোথাও নিয়ে যায়নি। এমনকি যে ইডেনে খেলেছিলাম, সেখানে পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। স্টেডিয়ামে একটা ম্যাচ দেখিয়েছে। পুজো উদ্বোধনে নিয়ে গেছে। আর টুকটাক দু একটা অনুষ্ঠানে। একটা অনুষ্ঠানে প্রাক্তন খেলোয়াড়দের ডাকা হয়েছিল। সবাই এমন করছিল, যেন সবাই আমার বাল্যবন্ধু। আরে বাবা, সেই কোনকাল আগে একবার খেলে এসেছি। এত কি মনে রাখা সম্ভব ? তবু এজেন্ট বলে দিয়েছিল, এমনভাবে হাসবেন, যেন মনে হয়, সবাইকে চিনতে পারছেন। আমাকেও তাই করতে হল।
মারাদোনাঃ আমার সেই অ্যাকাডেমির কী খবর ?
পেলেঃ আর বোলো না ভাই। তুমিও ফিরেছো। তোমার অ্যাকাডেমিও দেহ রেখেছে। এরা অনেককিছুই ঘোষণা করে। কিছুই করে না। করলে কি আর ১৬৭ নম্বরে থাকত?
মারাদোনাঃ পেলে বড় না মারাদোনা বড়- এই প্রশ্ন শুনতে হয়নি?
পেলেঃ হয়নি আবার! এর বাইরে বাঙালির আর কোনও প্রশ্নই নেই। আমি অবশ্য বারবার পাশ কাটিয়ে গেছি। নিজের ঢাক পিটিয়েছি। তবে তোমাকেও ছোট করিনি। শুনলাম, তুমি নাকি আমার নামে খুব গালমন্দ করে এসেছো।
মারাদোনাঃ ওরা বোধ হয় এগুলোই শুনতে চাইছিল। ওদের টিআরপি বাড়াতে কী সব বলেছিলাম, সব কি মনে আছে ? আমি কি আর আপনার মতো হিসেব কষে কথা বলি? যখন যা মুখে আসে, বলে ফেলি। কে কী ভাবল, অত ভাবি না। তাছাড়া, তখন নানা কারণে আপনার উপর কিছুটা রেগেও ছিলাম। তবে ওখানে নাকি ব্রাজিলের অনেক সমর্থক আছে। সেই তুলনায় আর্জেন্টিনার সমর্থক কম।
পেলেঃ আমিও সেরকমই শুনেছিলাম। কিন্তু শহরের যা চেহারা দেখলাম, তাতে মনে হল, ওটা আর্জেন্টিনার একটা শহর।
মারাদোনাঃ মানে ? ঠিক বুঝলাম না।
পেলেঃ গোটা শহরটাই নীল সাদা রঙে মোড়া। বিল্ডিং থেকে সেতু। সবকিছুই নীল-সাদা। গোটা রাজ্যটাই তোমার আর্জেন্টিনার জার্সির রঙে। এখন তুমি গেলে ভাল লাগবে।
মারাদোনাঃ বাহ। তাহলে তো যেতেই হয়।
পেলেঃ তুমি চাইলেই কি হবে? সে তো আমারও তিন বছর আগে যাওয়ার কথা। সব ফাইনাল। পরে শুনলাম, আমার যাওয়া চলবে না। কারণটা না হয় নাইবা বললাম। তোমার গায়ে আবার সিপিএমের গন্ধ। দেখো, তোমাকে ঢুকতে দেয় কিনা।
মারাদোনাঃ আরও একবার যাওয়ার ইচ্ছে আছে। লাল বাংলাকে দেখেছি। এবার নীল-সাদা বাংলাকে একটু দেখার ইচ্ছে আছে।
পেলেঃ এবার উঠি ভাই। দেখো, বাংলায় গিয়ে আবার আমার নামে উল্টো-পাল্টা বলে এসো না। আমি কিন্তু ভাল ভাল কথাই বলে এসেছি।
মারাদোনাঃ অনেকদিন পর কলকাতা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বললাম। আমি ফিরে এসে আমার অভিজ্ঞতা আপনাকে শুনিয়ে আসব।