অমিত ভট্টাচার্য
এই লেখা পড়ে বামপন্থী বন্ধুরা ক্ষেপে যেতেই পারেন। তবু কয়েকদিন ধরেই কথাগুলো বালর তাগিদ অনুভব করছি। সাম্প্রতিক বনধ ও ডিএ বিতর্কের পর সেই তাগিদ আরও কিছুটা বেড়েছে। মনে হল, বেঙ্গল টাইমসের ওপেন ফোরামে একটা লেখা পাঠানো দরকার। ছাপা হবে কিনা জানি না।
বাম আমলেও সরকারি চাকরি করেছি। এই আমলেও করছি। সেই আমলেও কোঅর্ডিনেশন করেছি। এই আমলেও করছি। সেই আমলেও নিজের সংগঠনে সংখ্যালঘু ছিলাম। এই আমলেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। তখন সবাইকেই মনে হত, তাঁরা বোধ হয় কার্ল মার্কসের থেকেও ভাল মার্কসবাদ বোঝেন। সামান্য ভিন্ন কণ্ঠস্বর বা আত্মসমালোচনা হলেই রে রে করে তেড়ে উঠতেন। সেই বিপ্লবীদের এখন মমতা ব্যানার্জির সমর্থনে মিছিল করতে দেখি। তাঁদের সঙ্গে ঝগড়া করি না, বরং তাঁদের দেখে মুচকি হাসি। এটুকু কটাক্ষ বোধ হয় তাঁদের প্রাপ্য।
কিন্তু এখনও যাঁরা বাম শিবিরে রয়ে গেছেন, তাঁরাই বা কতটুকু বাম মনস্ক , কতটুকু সমাজ মনস্ক, তাই নিয়েও প্রশ্ন জাগে। সারাক্ষণ শুধু একটাই আলোচনা, ডিএ বাড়ানো হচ্ছে না। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হত, ডিএ দিলেই এই সরকার ভাল। এই সরকার খুব খারাপ, তার একমাত্র কারণ ডিএ দেওয়া হচ্ছে না। খবরের কাগজের অন্য খবরে তাঁদের তেমন আগ্রহ দেখিনি। কিন্তু ডিএ নিয়ে এক কোণে তিন লাইনের খবর থাকলেও তাঁরা ঠিক খুঁজে নেবেন।
আগেই জানতাম, যতই বিপ্লব করুন, বনধের দিন সবাই গুটি গুটি পায়ে ঠিক হাজির হয়ে যাবেন। মুখ্যমন্ত্রী সার্কুলার দিয়ে বোধ হয় তাঁদের সুবিধাই করে দিলেন। অফিস করার একটা মোক্ষম অজুহাত পেয়ে গেলেন। কী হত, না হয় একদিনের মাইনে কাটা যেত। না হয় শোকজ করা হত। এই সার্কুলারের যে কোনও আইনি ভিত্তি নেই, সে তো জানাই ছিল। সচেতন শিক্ষক বা সচেতন সরকারি কর্মীরা সামান্যতম সাহস দেখাতে পারলেন না ? আমার বাড়ি থেকে অফিস খুব কাছে (আগে অনেকটাই দূরে ছিল, যেতে চার ঘণ্টা, আসতে চার ঘণ্টা লেগেই যেত)। সেদিন ইচ্ছে করেই যাইনি। অফিসের বস ফোন করে একটা বিশেষ কারণে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। একটি শর্তে গিয়েছিলাম, যেতে পারি, কিন্তু হাজিরা খাতায় সই করব না, একদিনের মাইনে কাটতে হবে, এবং যেহেতু সরকারিভাবে আসিনি, তাই নিয়ম অনুযায়ী শো-কজ করতে হবে। আমার অদ্ভুত দাবি শুনে তিনি কিছুটা উৎসাহিতই হলেন। সব শর্তই মেনে নিলেন। মূলত তাঁর আবদারেই অফিস গেলাম। হাজিরা খাতায় সই করিনি। নিয়ম মেনে শো কজের উত্তরও দিয়েছি। সেখানে লিখেছি, যে বনধ ডাকা হয়েছে, তাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করি। সেই কারণেই অফিসে আসিনি। একদিনের মাইনে হয়ত কাটা যাবে। কিন্নাতু তার মধ্নাযে একটা আনন্দ আছে। আমার সেই বামপন্থী বন্ধুদের জন্য করুণা হচ্ছে, যাঁরা সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলেন।
সেই রেশ কাটতে না কাটতেই এসে গেল ডি এ বিতর্ক। কেন্দ্রের জন্য ছ কিস্তি। ব্যাস, সেদিন তো সব কাজই মাথায় উঠল। সারা পৃথিবীতে যেন একটাই ঘটনা ঘটেছে। এবার মুখ্যমন্ত্রীকেও কিছু একটা করতেই হত। নেতাজি ইনডোর। দলে দলে যোগ দিন। সবাই কী সুন্দর হাজির হয়ে গেলেন নেতাজি ইনডোরের সভায়। ফাকা অফিসে সেদিন একটু বেশিই কাজ করেছি। যারা গেলেন না, তাদেরও সারাক্ষণ চোখ ছিল টিভির পর্দায়। এই বুঝি ঘোষণা হল। দশ শতাংশ ডিএ ঘোষণা হতেই নেতাজি ইনডোরে হাততালির ঢেউ। সেই হাততালি কি শুধু ইনডোরে ? কত অফিসে, কত স্কুলে যে অদৃশ্য হাততালি ছিল, তার হিসেবে নেই। অদৃশ্য হাততালিতে সামিল ছিলেন কত বামপন্থী বন্ধু!
একটু পরেই জানা গেল, ওটা এখন নয়, কার্যকর হবে জানুয়ারিতে। আচ্ছা, হাততালি দিলে তা কি প্রত্যাহার করা যায় ! সমর্থন প্রত্যাহারের কথা শুনেছি। কিন্তু হাততালি প্রত্যাহারের কথা কখনও শুনিনি। যথারীতি, পরের দিন থেকে আবার বিপ্লব। আবার মুখ্যমন্ত্রীর মুণ্ডপাত। বলা হল, আমাদের দিকে উচ্ছিষ্ট ছুঁড়ে দেওয়া হল। আমরা কি ভিখারি নাকি ? আবার মনে হল, পৃথিবীতে আর কোনও সমস্যা নেই, একমাত্র সমস্যা এই ডিএ না পাওয়া।
বেকার ভাতা বন্ধ, বিধবা ভাতা বন্ধ, বার্ধক্য ভাতা পাওয়া যাচ্ছে না, একশো দিনের কাজের টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। বেকাররা কর্মসংস্থানের লোন পাচ্ছেন না। শিক্ষিত বেকাররা চাকরি পাচ্ছে না, শিক্ষাঙ্গন প্রতিদিন আক্রান্ত, থানা যেন প্রহসনের ঠিকানা- এসব কোনওকিছুই আমাদের ভাবায় না। আমরা ডি এ পেলেই খুশি।
আমাদের আর কেউ চিনুক আর না চিনুক, মুখ্যমন্ত্রী ঠিক চিনেছেন। বুঝেছেন, উচ্ছিষ্টই আমাদের প্রাপ্য। বুঝেছেন, যে হাততালি একবার দিয়ে ফেললাম, সেই হাততালিই আমাদের দিয়ে যেতে হবে। দাসত্বের আর আত্মকেন্দ্রীকতার সেই তালি থেকে আমাদের মুক্তি নেই।