মৌতান ঘোষাল
‘মাঝখানে একটা প্রায় চার আনির সাইজের ঝলমলে পাথর – নিশ্চয়ই হীরে – আর তাকে ঘিরে লাল নীল সবুজ সব আরও অনেকগুলো ছোট পাথর’ – এমনই একটি আংটির হদিশ পেতে ১৯ ডিসেম্বর থেকে নামছেন ফেলুদা। সব ঠিকঠাক থাকলে এই শীতটা বাঙালির মগজাস্ত্র খাটাবার পালা। ইন্টালেকচুয়ালিটির অহঙ্কারে কলার তোলা বাঙালির বুদ্ধিমত্তার সেরা বিজ্ঞাপন এই দুই যুবক, ফেলুদা আর ব্যোমকেশ। ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এই দুই গোয়েন্দাই কিনা হাজির হচ্ছেন এবার একই দিনে! বঙ্গবাসী আর যায় কোথায়! চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে একেই যা পরিস্থিতি, তাতে স্বভাব-সন্ধিহান বাঙালি কারও বিগ পারচেস দেখলেই মনে মনে বলছে “হাইলি সাস্পিশিয়াস”। তার উপর আবার জোড়া রহস্য রোমাঞ্চ ছবির আবির্ভাব, একেবারে জমে দই।
রহস্য তো থাকবেই, তবে ছুটির সঙ্গে ফেলুদা’র এক অসাধরণ মেলবন্ধন। রসনা ‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ’। ছুটি এলেই খাদ্যরসিক বাঙালির মন আরো বেশি খাই খাই করে। আর সঙ্গে যাই যাই – মানে দু-এক দিন ছুটি পেলেই টুক করে কোথাও বেড়িয়ে আসা। ফেলুদা’র অধিকাংশ কান্ডকারখানায় সত্যজিৎ রায় বাঙালির এই দুই প্যাশানকে সম্মানের সঙ্গে জায়গা দিয়েছেন। ‘বাদশাহী আংটি’তে ফেলুদা’র ডেস্টিনেশন লক্ষ্ণৌ। টাঙ্গা থেকে খানাপিনা – ফেলুদা’র সঙ্গে বাদশাহী মেজাজে ছুটি কাটানোর দুরন্ত সুযোগ। গল্পে প্রদোষ মিত্র যদিও পুজোর ছুটিতে লক্ষ্ণৌ গেছিলেন, দর্শকরা লক্ষ্ণৌ দর্শন করতে পারবেন ক্রিসমাস ভ্যাকেশনে। আরে বাবা দুটোই তো ছুটি। হলই না হয় একটু অদলবদল। ১৯৬৬ সালে যখন ‘বাদশাহী আংটি’ প্রকাশিত হয় তখনও মধ্যবিত্তর শীতের আগমন মানে নলেন গুড়ের কড়াপাক। এখনকার কেক-চকলেট-ওয়াইন ক্রিসমাস নয়। কাজেই পুলওভার চাপিয়ে পুজোর ছুটির হ্যাংওভার নিয়ে ফেলুদা’র পুজাবার্ষিকী লক্ষ্ণৌ মন্দ কী!
ফেলু দা সিরিজ গুলে খাওয়া প্রজন্মের কাছে গল্পটা জানাই। আর যারা পড়েননি ‘বাদশাহী আংটি’ তাদের অনেকেই ছবি মুক্তি পাওয়ার আগে-পরে গল্পটা পড়ে নিতে চাইবেন। কারণ কলেজ স্ট্রিটের হিসেব বলে কোনও গল্প নিয়ে ছবি তৈরি হলে সে গল্পের বইয়ের বিক্রিও রাতারাতি বেড়ে যায়। তাই রহস্য উদ্ঘাটনের বাইরে আকর্ষণের বিষয় অবশ্যই আরও অনেক থাকবে।
ফেলুদা’র ভূমিকায় প্রথমবার আবির চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্র চ্যাটার্জি, সব্যসাচী চক্রবর্তীর পর এই জনপ্রিয় চরিত্রে আবার নতুন কেউ। গল্পটি ফেলুদা সিরিজের দ্বিতীয় গল্প তাই এই ২৭ বছরের উঠতি গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্রকে দর্শকরা রূপোলী পর্দায় আগে দেখেননি। এখানে ফেলুদা অনেকটাই ছেলেমানুষ, ভোজনরসিক। তোপসের সঙ্গে খুনসুটিও করে সে। তাই আবিরের মধ্যে আগের দুই ফেলুদা’র ছাপ খুঁজতে যাওয়া ভুল হবে দর্শকদের। কারণ আগের যেকটি গল্প নিয়ে ছবি হয়েছে সবেতেই ফেলু মিত্তির বেশ পোড় খাওয়া গোয়েন্দা। তবে একটি জায়গায় দর্শকদের হয়ত কিছুটা ফাঁকা লাগবে। সেই লালমোহনবাবু, ওরফে জটায়ু নেই। আসলে, শুরুর দিককার ফেলুদা সিরিজে জটায়ু ছিলেনও না। তাঁর আবির্ভাব তো সেই সোনার কেল্লা থেকে। আসলে, জটায়ু খোঁজার অনেক ঝামেলাও আছে। সেই সন্তোষ দত্ত নেই, নেই রবি ঘোষ, এমনকি বীভূ ভট্টাচার্য! তিনিও নেই। জটায়ু হলেই নাকি তাঁকে আর ইহ জগতে বেশি দিন পাওয়া যায় না। এরকম একটা মিথ ঘোরাফেরা করে টলিউডে। কে চাইবেন জটায়ু হতে! জটায়ু ছাড়া গল্প নিয়ে এখনও সিনেমা হয়নি। এটিও একটি অন্যরকম চ্যালেঞ্জ। জটায়ু ছাড়া ফেলুদাকে কেমন লাগে, সেটাও একবার দেখুন।
গল্পের অন্যতম আকর্ষণ বনবিহারী বাবুর চিড়িয়াখানা অবশ্য বর্তমান আইনের কারণে ছবিতে দেখা যাবে না। তবে তার জায়গায় সাপ আছে,আছে বিষাক্ত ব্লু স্করপিয়ন স্পাইডার। আর লক্ষ্ণৌ’র সঙ্গে আছে হরিদ্বারও। ছবির ট্রেলার দেখে বোঝা যাচ্ছে দর্শকদের গল্পের সঙ্গে সিনেমার দৃশ্যগুলোকে মিলিয়ে দেখার প্রবণতার কথা যথেষ্ট মাথায় রেখেছেন পরিচালক সন্দীপ রায় । অবশ্য ফেলুদা’র গল্প নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখতে যাওয়ার আগে ছবি ভাল হবে না মন্দ, খুব একটা ভাবেন কি দর্শকরা ? গল্পের নামই যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কাজেই ১৯ ডিসেম্বর থেকে ছোটরা হলমুখো হবেই। বেচারাদের জন্য ক’টা ছবিই বা তৈরি হয় এই দেশে ? তাই শীতের ছুটিতে একবার ‘বাদশাহী আংটি’ ওদের আউটিংয়ের লিস্টে থাকছেই। আর বড়রা ? ফেলুদা’র হাত ধরে নস্ট্যালজিক হতে কার না ভাল লাগে!