এটা আপনার দেশ নয়!‌

বৃষ্টি চৌধুরি

এই দেশে এতগুলো শীত, এতগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেল। এখনও শুনতে হয়, আপনি বিদেশিনী। কত অনায়াসে এখনও আমরা এই তকমা এঁটে দিই। একবারও ভাবি না আপনার মনের উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে চলেছে।
উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখছি, আপনার বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৮ তে। আমরা ২০১৬–‌র শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। আর তের মাস পরেই ২০১৮ এসে যাবে। দেখতে দেখতে এই দেশে আপনার পঞ্চাশ বছর হয়ে যাবে। ছেলে রাহুলের বয়স ৪৬, মেয়ে প্রিয়াঙ্কার বয়স ৪৪। এই দুই সন্তানকে একেবারে ভারতীয় সনাতন রীতি মেনেই বড় করেছেন। তবু আপনি বিদেশি!‌
হ্যাঁ, আপনার অনেক সীমাবদ্ধতা। এত বছর এই দেশে থাকার পরেও হিন্দিতে তেমন সড়গড় নন। এখনও দেখে দেখে ভাষণ দিতে হয়। এখনও দেশটাকে সেভাবে চিনতে পারেননি।

soniya4
এগুলো নতুন কিছু নয়। অনেকদিন ধরেই শোনা যায়। কিন্তু আপনার ত্যাগ, আপনার সংযম এগুলো আমাদের চোখেই পড়ে না। সোনিয়া গান্ধী মানে শুধু যেন গান্ধী পরিবারের উত্তরাধিকার। ইন্দিরার পুত্রবধূ, রাজীবের স্ত্রী এছাড়া যেন আপনার আর কোনও পরিচিতি নেই।
যেদিন রাজীব গান্ধী মারা গেলেন, পরেরদিনই আপনার কাছে এসেছিল দলের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব। আবার কংগ্রেস ফিরতে চলেছে, দেওয়াল লিখনটাও স্পষ্টই ছিল। বাকি দু দফার ভোটে সারা দেশজুড়ে সহানুভূতির হাওয়া বয়ে যাবে, সেটাও ভালই বোঝা যাচ্ছিল। অর্থাৎ, আপনিই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। অথচ, এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে আপনার একমুহূর্তও সময় লাগেনি। প্রধানমন্ত্রীত্ব নয়, বেছে নিয়েছিলন স্বেচ্ছা নির্বাসন। আত্মত্যাগ নয়?‌

রাজনীতি থেকে দূরে দূরেই থাকতেন। কিন্তু দলের লোকজনের আসা যাওয়া শুরু হল। নরসীমা রাওয়ের বিরুদ্ধে কান ভাঙানি দেওয়া শুরু হল। পরে সীতারাম কেশরী সভাপতি হলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও নানা লোকে গিয়ে নানা নালিশ। খুব যে জড়াতে চাইতেন, এমন নয়। কিন্তু শুনতে হত। এভাবেই একদিন এসে গেলেন মূলস্রোতে। হঠাৎ করে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। লোকসভায় জিতেও এলেন স্বামীর হারানো আসন থেকে। বিরোধী নেত্রী, সরকারকে আক্রমণ করছেন, কিন্তু কখনই তা শালীনতার সীমা ছাড়ায়নি। ২০০৪। আবার এসে গেল প্রধানমন্ত্রীত্বের সুযোগ। গোটা দেশ ধরেই নিয়েছিল, আপনিই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। আপনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, এটা জানার পরেও গোটা দেশ রায় দিয়েছিল কংগ্রেসের পক্ষে। হঠাৎ দিলেন মাস্টারস্টোক। শোনা গেল সেই তিনটে শব্দ, ‘‌অন্তরাত্মা কী পুকার’‌ যা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এভাবে কখনও শোনা যায়নি। আপনার ইচ্ছেয় দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। হ্যাঁ, আড়াল থেকে সেই সরকার চালানোয় আপনার একটা ভূমিকা নিশ্চয় ছিল। কিন্তু কখনই নিজেকে সেভাবে সামনে আনতে চাননি। মনমোহনকে আপননি চালাচ্ছেন, এটা কখনও বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেননি। চাইলেই রাহুলকে মন্ত্রী করতে পারতেন। এমনকি ২০০৯ এ আবার যখন কংগ্রেস ক্ষমতায়, আপনি চাইলেই রাহুল দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। আড়ালে আবডালে দু চারজন দু–‌এক কথা বলতেন। সময়ের প্রবাহে তা চাপাও পড়ে যেত। প্রধানমন্ত্রী না হোক, নিদেনপক্ষে যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট মন্ত্রী করতেই পারতেন। না, সে চেষ্টাও করেননি। চেয়েছেন, ছেলে আরও পরিণত হোক, উপযুক্ত হয়ে উঠুক।

soniya5

অবাক লাগে, এই সোনিয়াকে আমরা দেখতে পাই না। এই সোনিয়াকে আমরা তুলেও ধরি না। আজ জন্মদিনে দু একটা টুইটার আসবে। কেউ কেউ ফুল পাঠাবেন। কিন্তু সত্তরতম জন্মদিনে নিজেদেরই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, সোনিয়া গান্ধীর ঠিকঠাক মূল্যায়ণ কি সত্যিই আমরা করতে পেরেছি ?‌

flipkart-bigshoppingdays-banner

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.