ইংরাজিতে ভুল মানে অশিক্ষিত, বাংলা একটু বেশি ঠিকঠাক মানে আনস্মার্ট

কৃতিষ্ণু সান্যাল

পৃথিবীতে যে কোন কিছু করতে গেলেই একটা যোগ্যতা থাকা উচিত। মতপ্রকাশ করতে গেলেও। কোন কোন জাতের ভুট্টার জিন মিলিয়ে মিশিয়ে বড়সড়, উচ্চফলনশীল, রোগপ্রতিরোধক, খরা বা বন্যা জয়ী ভুট্টা বানানো যাবে সে বিষয়ে আমার যেমন মতামত দেবার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা নেই। সমস্যা হল কোন জিনিস করবার, বলবার বা নিদেন দেখানোর পেছনেও থাকা যোগ্যতাকে সম্মান দেবার মত সাধারণ বোধশোধও অনেকের থাকেনা। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে দক্ষিণ এশীয়দের বোধহীনতাটা একটু বেশিই। দক্ষিণ এশিয়ার সব জাতিকে তো আমি চিনিনা, যেখানে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি সে সম্পর্কে দু একটা কথা বলতেই পারি। যোগ্যতা টোগ্যতা কিছু না। জিভের জোর চাই স্রেফ। কলমের(বা এখন কী বোর্ডের) জোর হলে তো সোনায় সোহাগা। আমার ক্রিকেট খেলার অন্তিম অধ্যায় ক্যাম্বিস বল, জিন্দেগীতে বাইশ গজ কতটা লম্বা হেঁটে দেখিনি কিন্তু অফ স্টাম্পের বল ছাড়ায় ধাওয়ানের দুর্বলতা কাটবে কীসে, সে টোটকা আমার কাছে পাওয়া যেতেই পারে।
এমন একটি বাঙালি খুঁজে পেলাম না – যে ক্রিকেট, রাজনীতি আর কালচারটা (আজ্ঞে না, সংস্কৃতি নয়, বাঙালিদের কালচারটাই আছে) বোঝেনা। বাদবাকি বিষয়ে তাও ক্ষমাঘেন্না করে ওয়াকওভার দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে, কিন্তু এসব দিকে আমরা পুরো রবীন্দ্রনাথ-বিসমার্ক আর হর্ষ ভোগলের খিচুড়ি। অবশ্যই নুন ছাড়া।

bangla2
আজ ভাষাদিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সকাল থেকে ফেসবুক উথলে ওঠা ন্যাকামি দেখে চোখের জল ধরে রাখা দায়। ভণ্ডদের মাঝে বাস করবার বৃহত্তম সুবিধে এটাই যে নিজের ভণ্ডামিগুলোকেও বাস্তবতা – পরিবর্তিত পরিস্থিতি – প্রাজ্ঞতা ইত্যাদির নামে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কেউই কারুর ব্যাখ্যাটা বিশ্বাস করেনা অবশ্য কিন্তু ধান্দাবাজি আর আত্মসম্মানহীনতার অপূর্ব যুগল সম্মিলন যার মধ্যে ঘটেছে, তার কাছে এসব তুসচু ব্যাপার।
বাংলায় থেকে প্রাণপণে হিন্দি বলে যাব, “আমার বাচ্চার স্কুলে না – বাংলা বললেই ডাইনোসর দিয়ে কামড়িয়ে দেয়” বলে আহ্লাদে আত্মহারা হব আর আমার মত চারটে ছিঁচকের সাথে বসে “ইসস…আর বোধহয় কেউ বাংলাটা পড়বেই না” বলে চুকচুক করব, এত্ত ঠকবাজি রাখি কই? একটু যদি পড়াশোনা থাকে (মূল বইয়ের আশা করাও দুরাশা, অন্তত মলাটটুকুন) তাহলে ভাষার রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে দু এক কথাও দিব্যি হাঁকড়ে দিতে পারি। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। আপনার তিনকুল মিলিয়ে এ প্রজন্মের কজন মাধ্যমিক দিয়েছে বা দেবে হে ন্যাকাচন্ডী বাবু/বিবি? আপনার আপন ছানা?? অবশ্য যে জাতি প্রাক্তন রায়সাহেবকে দেশভক্ত নেতা কিম্বা পাঁড় জোতদারকে পার্টিদরদী হয়ে যেতে দেয় , এসব দ্বিচারিতা তো তাদের কাছে জলভাত।

bangla3
কথা হচ্ছিল যোগ্যতা নিয়ে। ব্যাপার হল এই যে এখন আর বাংলা ভাষাটা কোন যোগ্যতা দাবি করেনা। বানানের মা মাসি এক করে আমি জ্বালাময়ী পোস্ট দিতে পারি আর তাতে অনুরূপ ভুল বানানসহ চক্ষু চমৎকারক মন্তব্যেরও অভাব ঘটবে না। ইংরাজিতে ভুল মানে অশিক্ষিত, বাংলা একটু বেশি ঠিকঠাক মানে আনস্মার্ট। এর সাথে আরেকটা জিনিসও আমরা দাদু-নাতি-হাতি সক্কলে মিলে করে ফেলেছি, বাংলা ব্যাকরণের সার্বিক ষষ্ঠীপুজো। এই সার্বজনীন অশিক্ষাটা অ্যাদ্দুর পৌঁছেছে যে বাংলার শিক্ষক অবধি বুক ফুলিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন যে – এখন সব বানানে সব ঈ-কার পাল্টে ই-কার করে দেওয়া হয়েছে। যেন বাংলা বানান ওনার বাড়ির পোষা টিভিটি, কাল অবধি কটকটিকে দেখেছেন, আজ থেকে চটপটিকেই দেখবেন। দু চারজন বিরল বোদ্ধা আবার এ প্রসঙ্গে আমেরিকান ইংলিশ টেনে আনেন। তার বানানের নাকি সে অর্থে কোন নিয়ম নেই, কেবল বানান সোজা করাই একমাত্র লক্ষ্য। এই কথাটা যে কতখানি ফালতু সেটাও একটু খোঁজ নিলেই জানা যেত কিন্তু “অত টাইম নেই”।
আসলে সহজ কাজ করাটাই সহজ। বাংলা আকাদেমির যুক্তি অনুধাবন করা, তাদের যুক্তির ভুল দেখান, তা নিয়ে তর্ক করা, আলোচনা করা, জনমত গঠন – ভীষণ ভীষণ ভীষণ শক্ত। তারচে বাবা দোষ ধরি। বাংলা আকাদেমির পরিভাষাগুলো সব ভুলভাল – ওদের কাজের মানে বোঝা দায়! মিডিয়াতে এত ভুলভাল বানান দেয় ওই দেখেই দেখেই তো লোকের… সাহানা বাজপেয়ীর উচ্চারণে “বাংলাদেশি টান”। আমাকে অবশ্য কথায় কথায় বাট, অ্যাকচুয়ালি, ইউ নো বলতেই হয় কেন কী ওটাই আমায় সস্তায় স্মার্টনেস পাইয়ে দেয়। একান্ত ঘাড় তেড়া কেউ যদি জিগোয় – তুমি কেন ঠিক করে বাংলাটা বল না? লেখনা? ধারে কাছে আর দু চারজনের ভুল শুধরে দাওনা ? তখন আমরা এসব দুর্জন লোকের সঙ্গ পরিহার করে আপন ইঁদুরগর্তে পুনঃ প্রবেশ করব। ঠিক যেমন বাংলা সিনেমার বর্তমান দুর্দিনের চিন্তায় ক্লিষ্ট হয়ে – মানিকবাবু আর ঋত্বিকের ( সত্যজিৎ রায় আর ঋত্বিক ঘটক বলে ডাকে যত মূর্খে) জন্য আরেকবার আফসোস করে আমরা বাড়ি ফিরে বাংলা সিরিয়াল দেখি। ভাবনাতেই আসে না যে “আশা যাওয়ার মাঝে”র মত সিনেমাও আমি নেটে ফ্রীতে পাবার পর তবেই দেখেছি নইলে আড্ডায় মান থাকছিলনা।
পুনশ্চঃ- ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে মেহদী হাসান সংক্রান্ত একটা পোস্ট ইউটিউব এ ঘুরছে। অনেক লাইক আর শেয়ার হয়েছে। যারা এখনো জানেন না তিনি কে, কী করেছেন চাইলে গুগল করুন। নইলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে অন্য পোস্টে চলে যান। অনলাইন হয়ে এসব নাম না জানা লোকের তালাশ করার চাইতে মহত্তর কাজ আপনার করবার আছে – নিজের ওপর আপনার এহেন শূন্যগর্ভ বিশ্বাস আছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.