-শোভন চন্দ
বাঙালির ড্রয়িং-রুম থেকে সেলুলয়েডের পর্দা তিনি সর্বত্র বিরাজমান। বাংলা সাহিত্যে রহস্য রোমাঞ্চের মেলবন্ধনে তিনি অতুলনীয়। তা সে বড়দার কেরামতি হোক কিংবা ব্যোমকেশের তদন্ত -কেন্দ্রিক চুলচেরা বিশ্লেষণ। বাঙালি হৃদয়ে ইনি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত । আজ ৪৫ বছর অতিক্রান্ত, তিনি আমাদের ছেড়ে হয়তো কোন এক নিগুঢ় রহস্য সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন। তবে এই সাহিত্য রচনার আড়ালে এক আলাদা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লুকিয়ে থাকত । যাকে জ্যোতিষ শরদিন্দুবাবু বললে খুব একটা ভুল বলা হয়না। সেই অজানা -অদেখা শরদিন্দু বাবুর স্মৃতিচারণে নানান মজার কথা তুলে ধরলেন মিত্র অ্যান্ড ঘোষ-এর কর্ণধার, আমাদের সকলের প্রিয় ভানুবাবু (সবিতেন্দ্রনাথ রায়)।
শরদিন্দুবাবুর লেখার টেবিলে সামনে থাকত নানারকম শিশি। কোনওটায় লজেন্স, আখরোট বা কিশমিশ। লেখার সময় যখন যা ইচ্ছে হত খেতেন। শরদিন্দুবাবু দক্ষিণ কলকাতার কেয়াতলা অঞ্চলে থাকতেন। ওঁর সাহিত্যিক বন্ধুদের নিত্য যাতায়াত ছিল। তাঁদের মধ্যে থাকতেন প্রতুল চন্দ্র গুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী,গজেন্দ্রকুমার মিত্র সুম্থনাথ ঘোষ ,নকুল চট্টোপাধ্যায় বিমল মিত্র প্রমুখ।এঁদের সঙ্গে আমি অবশ্য থাকতাম অনেকটা সহচর হিসেবে। শরদিন্দু বাবুর মতে এই জ্যোতিষ- ঠিকুজি চর্চার মধ্যে একটা আনন্দ খুঁজে নেওয়ার পথ ছিল।আমাকে এইসব ঠিকুজি বা ছক নিয়ে যেতে হত শরদিন্দুবাবুর কাছে ,আবার তাঁর কথামতো কখনো তা পৌছে দিতে হত যথাস্থানে। আজও মনে পড়ে নীহাররঞ্জন বাবুর কথা, তাঁর ঠিকুজি নিয়ে যাই শরদিন্দু বাবুর কাছে । শরদিন্দুবাবুর কথা মতো নীলা আংটি ধারণের পর নীহাররঞ্জন বাবুর খ্যাতি বাড়তে থাকে। সাহিত্য থেকে নাট্যমঞ্চ এমনকি চলচিত্র শিল্পেও তাঁর আগমন ঘটে।এদিকে শরদিন্দুবাবুর জ্যোতিষ- ঠিকুজি চর্চার ক্ষমতার খ্যাতি ব্যাপ্ত হয়। বহু খ্যাতনামা লেখক সাহিত্যিক তাঁর ঠিকুজি নিয়ে হাজির হন শরদিন্দু বাবুর দরবারে।
একদিন শরদিন্দুবাবু বললেন, ভানু তুমি সকলের ঠিকুজি নিয়ে আসো,তোমারটা কখনও দেখাওনি। আমি বললাম আমি সাধারণ মানুষ, আপনি নামজাদা মানুষের ঠিকুজি দেখেন তাই আর দিইনি। শরদিন্দুবাবু বললেন, আরে এটা তো আমার হবি। এখানে নামজাদা- অনামজাদা কিছু নেই। তুমি এরপর যখন আসবে, তোমার কোষ্ঠীপত্র নিয়ে আসবে। পরের বার যাওয়ার সময়ে আমার ঠিকুজি নিয়ে গেলাম। পরে আমি যখন শরদিন্দুবাবুর কাছে গেলাম, তিনি হেসে বললেন, ভানু, আমি এক দারুণ সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি, প্রায় ব্যোমকেশের মতো। আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতে উনি বললেন, তোমার এ কোষ্ঠীপত্র তৈরি হয়েছে কাশীতে। আমি বললাম হ্যাঁ আমার এক সম্পর্কিত- কাকা কাশীতে থাকতেন, তিনি করিয়ে দেন। শরদিন্দু বাবু বললেন তাইতো উনি ধরে নিয়েছেন তোমার জন্ম কাশীতে। তোমার শুক্রলগ্ন ধরে কোষ্ঠী করেছেন। তোমার হল কন্যালগ্ন, রাশি মীন ঠিকই আছে। আমি হতাশ হয়ে বললাম, তাহলে ওই কোষ্ঠীপত্রটাই ভুল? শরদিন্দুবাবু বললেন,অত হতাশ হওয়ার কারণ নেই। তোমার ছক তৈরি করে ভবিষ্যৎ গণনা একটা করে রেখেছি। আমি কৌতুহূল চেপে চুপ করে শুনছি। শরদিন্দুবাবু বললেন ১৯৬৫ সালে তোমার বাড়ি হবে, ১৯৭০ সালে বিবাহ, দুটি কন্যার জন্ম, অমুক সালে বিদেশ যাত্রা,ইত্যাদি,ইত্যাদি।আমি বললাম, এসব তো গল্পকথা বা রূপকথা শোনাচ্ছে। শরদিন্দু বাবু মৃদু হেসে বললেন জানাতে ভুলো না- যখন যা হবে।সেটা ১৯৬২ সালের কথা। নিজের বাড়ি তখন কষ্টকল্পনা মাত্র।
তবু ১৯৬৫ সালে যখন বাড়ি হল, গৃহপ্রবেশ হল, শরদিন্দুবাবুকে চিঠি দিয়ে আশীর্বাদ চেয়েছিলাম। শরদিন্দুবাবু আশীর্বাদ দিয়ে উত্তর দিলেন, পরেরগুলোও ঠিক ঠিক হবে দেখবে, তবে আমাকে জানাতে ভুলোনা বিয়ের মিষ্টি তো খাবই। দুঃখের বিষয়, সে মিষ্টি তাঁকে খাওয়ানো যায়নি। তার আগেই তিনি পরপারে যাত্রা করেছেন।
শুধু মাত্র মোটিভ দেখে জটিল রহস্যের সমাধান নয় জীবন রহস্যের সমাধানে সত্যান্বেষীর স্রষ্টার প্রতিভা অতুলনীয়। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে আজকের দিনেই পুণেতে থাকা কালীন ৭১ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাই আজ এই প্রতিভাশালী সাহিত্যিকের চরণে সাহিত্য-প্রিয় বাঙ্গালির পক্ষ থেকে রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।