সুগত রায়মজুমদার
অতীতে এই শিরোনামের বাক্যটি পরবর্তীকালে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। এই কথাটি এখন আমরা খুবই প্রযোজ্য মনে করি রাজ্যের রাজনীতিতে। ‘সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ’, ভারতবর্ষ। যেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন পোশাক, বিভিন্ন আচরণ, বিভিন্ন ধর্মের বিচরণ। এই দেশেই বহু অঙ্গরাজ্য অবস্থান করছে। এতে আছে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন আচরণের মানুষ। কারও সঙ্গেই কারও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেমন সহনশীল, তেমনই উদারতা যাঁদের ভূষণ। আর সঙ্গে রয়েছে হিংস্রতাও। রাজ্য রাজনীতিতে তাই এই হিংস্র রূপ প্রকাশ পাচ্ছে নির্বাচনগুলিতে। পঞ্চায়েতের ভোটেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। লোকসভাতেও একই রূপ। অন্য বহু রাজ্যে যেমন ধর্মের গোঁড়ামি কাজ করে, আমাদের রাজ্যে ধর্মের হয়ত ততখানি নেই। ধর্মীয় চিন্তাভাবনায় এখানকার মানুষ অনেক বেশি উদার। দৈনন্দিন জীবনে শুধু ধর্মকেই আঁকড়ে ধরার লোক এই রাজ্যে কম। সেজন্যই এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক তেমন দাঙ্গা হয় না। অন্য রাজ্যের মানুষকে নিগ্রহ করা হয় না। এই ট্রাডিশন তৈরি হয়েছে শ্রীচৈতন্য, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি সুভাষচন্দ্রদের হাত ধরে। সেজন্যই এ রাজ্যের মানবিকতা অন্য রাজ্যগুলির চেয়ে আলাদা। তা হলে কেন আমাদের রাজ্যে বছরের পর বছর গণতন্ত্র হরণের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে? এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? বিগত দিনে যে বিদ্বজ্জনেরা তৃণমূলনেত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়, তাঁদের আজ কেন এত অনীহা তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাতে? তা হলে তো বলতেই হবে, এরও পেছনে কোনও উদ্দেশ্য আছে।
বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ রাজ্যের জনগণ যখন কর্মসংস্থান ও স্বচ্ছন্দে বাস করার স্বপ্ন দেখেন, তখন আমাদের রাজ্যের যুব সম্প্রদায় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া দলগুলির নেতৃবৃন্দকে বিশ্বাস করে খুনের রাজনীতির শিকার হচ্ছে। যাঁরা এই রাজনীতির শিকার হচ্ছেন, তাঁরা সকলেই খুব নিম্নবিত্ত পরিবারের। যাঁদের ঘরে শুধু অভাবের জ্বালা। তাঁরা সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে ভাবেন, আজ দিনটা কীভাবে যাবে? কী খাবে, কী পরবে, কী আয় করবে, কোনও নিশ্চয়তা নেই। সেজন্যই তাঁরা নেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, ১০০ দিনের কাজকে প্রাধান্য দিয়ে তা পাওয়ার আশা করে খুনখারাবির রাজনীতিকে আশ্রয় করে নির্বাচনের দিন নিজেদের মধ্যে লড়াই করে নিজেদের জীবন দিচ্ছেন। আর সেটার ফয়দা নিচ্ছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ কিছু সমাজবিরোধী নেতা। যাঁদের মাথায় সবসময়ই কোনও না কোনও রাজনীতিক দলের নেতার আশীর্বাদধন্য হাত! সেজন্যই আমাদের রাজ্যে দিনদিন এই খুনের রাজনীতির প্রভাব বেড়েই চলেছে। সেটা কমার লক্ষ্মণও দেখা যাচ্ছে না। যখন প্রতিটি রাজ্যের মানুষ সামনের দিকে তাকাতে চাইছে, তখন পশ্চিমবাংলার মানুষ অতীতকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে কিছু পাওয়ার আশায়।
৪৭ বছর আগে ১৯৭২ সালে কংগ্রেসের হাত ধরে শুরু হয় আমাদের রাজ্যে ছাপ্পা ও খুনোখুনির নির্বাচন। তাতে রাজ্যের মানুষ বিরক্ত হয়ে কংগ্রেসকে ছুঁড়ে ফেলে ১৯৭৭ সালে। আনে তথাকথিত প্রগতিশীল দল সিপিএমকে। পরবর্তীকালে সিপিএম এই নির্বাচনকে তুলে আনে শিল্পের পর্যায়ে। রাস্তাঘাটে খুন, নির্বাচনে বুথ দখল, ছাপ্পার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও মরিচঝাঁপি, বিজন সেতুর গণহত্যা, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাইয়ের ঘটনা ঘটানো। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর মানুষ অনেক আশা করে সিপিএমকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তৃণমূলনেত্রীকে আনেন। কিন্তু তিনি মসনদে বসে প্রথমই ঘোষণা করেন, বিরোধী দল সিপিএম যেন প্রথম ১০ বছর কোনও শব্দ ব্যবহার না করেন। শুধু দেখে যাবেন। তাঁর এই স্বৈরতন্ত্রী মনোভাব কোনও বাধা পায়নি বলেই ৫ বছর শাসনের পর তা আরও বেড়ে যায়। তিনি কোনও বিরোধী দলকেই পাত্তা দেন না। বিরোধীদলের কোনও গুরুত্ব নেই। গত পঞ্চায়েত নির্বাচন সাধারণ মানু্য প্রত্যক্ষ করেছেন। কত মানু্য খুন হয়েছেন। তার দায়ভার কি তৃণমূলনেত্রী এড়াতে পারবেন? আর এবারের লোকসভা নির্বাচনেও ব্যতিক্রমী নন নেত্রী। যথেচ্ছ মারামারি বুথ দখল চলছেই। এজন্যই এই রাজ্যের মানুষ এ সব দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
মানুষ এখন তাঁরও বিকল্প ভাবতে শুরু করেছেন। এর থেকে মুক্তি চাইছেন সাধারণ মানু্য। হয়তো মানু্ষ এর চেয়েও খারাপ আর কোনও দলকেই হয়তো বেছে নিতে পারেন এই নির্বাচনে। যা শাসকদল হয়তো ধারণাই করতে পারছে না। তাঁরা এখন ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগে রাজ্যবাসীকে ভুলেই গেছেন। মানু্য কী চান, তা–ও বোঝেন না।
নেত্রী বোঝেন না, শুধু উন্নয়ন দিয়ে হয় না। অতীতে তৃণমূলনেত্রীর জোটের এক সঙ্গী চন্দ্রবাবু নাইডুও উন্নয়ন দিয়ে নিশ্চিন্তে বুঁদ হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, মানুষ তাঁকেই পুনরায় নির্বাচিত করবেন। হাতেনাতে হেরে গিয়ে শিক্ষা পেয়েছিলেন। শাসকদলের নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও ভুলে গেছেন, সাধারণ মানুষ শুধু উন্নয়ন চান না, চান গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রই যদি হরণ করেন তিনি, তা হলে তাঁকে বঙ্গোপসাগরের জলে ছুঁড়ে ফেলতেওদ্বিধা করবেন না জনগণ। এই অবস্থার সমাধান কী? মানুষের ভাবনা, এই পরম্পরা কি চলতেই থাকবে?
মানুষ বিকল্প ভাবতে শুরু করেছেন। সেই সময় আসছে। যত ছাপ্পা দেওয়াই হোক, যতই ধর্মের সুঁড়সুঁড়ি ও ভাষণে উস্কানি দেওয়া হোক কোনও সম্প্রদায়কে, তাতেও কোনও কাজ হবে না এই নির্বাচনে। মানু্ষ অন্য কোনও দলকেও আনবেন, তাতেও আর ভরসা পাচ্ছেন না পশ্চিমবঙ্গবাসী। কিন্তু এর স্থায়ী সমাধান চাইছেন জনগণ। জনগণ ভাবছে, পাশাপাশি রাজ্য ঝাড়খণ্ড, বিহার যদি পরিবর্তিত হতে পারে, তা হলে কেন আমাদের রাজ্যে এর পরিবর্তন হবে না? সারা দেশে যখন নির্বাচনে শান্তি বিরাজ করে, খুনোখুনি হয় না, তখন আমাদের রাজ্যে কেন এই ভয়ের আবহ তৈরি হবে? সাধারণ মানুষ এখন সেই পথই খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা কোনও দলের প্রতিই দায়বদ্ধতা দেখাবেন না। বরং তাঁরা সঠিক পথটাই বেছে নেবেন এই নির্বাচনে। মানুষ নিজেই বিকল্প খুঁজে নেবে।
(ওপেন ফোরাম। বেঙ্গল টাইমসে পাঠকের মুক্তমঞ্চ। নানা মত উঠে আসতে পারে এই বিভাগে। আপাতত বেশিরভাগ মতামত উঠে আসছে লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে। চাইলে, আপনিও আপনার সুচিন্তিত মতামত জানাতে পারেন। )