শান্তনু দেশাই
ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ঝমঝম করে একটা ব্রিজ পেরোলো ট্রেনটা। নদীর নাম দেখলাম ডায়না। ভারী সুন্দর তার গড়ন। জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁ গো তুমি বিদেশি নাকি?
কলকলিয়ে হেসে বললো কেন গো? নদীর আবার দেশ বিদেশ হয় নাকি?
আমাদের তো সারা বিশ্ব এক দেশ। সকলেই আমরা কারো না কারোর সঙ্গে জড়িয়ে আছি। তোমরা নিজেদের মত করে ভাগ করে নিয়েছ।
লজ্জায় পড়ে গেলাম। সত্যি তো আমরাই বিশ্বকে বিভাজিত করেছি।
ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল কিছুক্ষণ। ভালোই হোল। আমি ডায়নার সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার সুযোগ পেলাম। ডায়না, তিস্তা, তোর্ষার খোঁজ নিল। আমাকে সুধালো কোথায় যাচ্ছি।
বললাম কোথাও নয় গো। এমনি অলস ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
ডায়না বললো, ও, পলাতক ছবির রেশ নাকি !
নাঃ, সে আর পারি কই।
ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে দুলে উঠল। ডায়না কে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চললাম। জানালার বাইরে সরে সরে যাচ্ছে দৃশ্যপট। আমার কল্প জগৎ সারাক্ষণ অনুরিত হচ্ছে সেই চলমান দৃশ্যের।
আমি একটু বেশিই কল্পনা প্রবণ।
কৈশোর বয়সেও সাহিত্য পরীক্ষায় বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, নিয়মানুবর্তিতা, বা কোনও মনীষীদের অবদান রচনা ছেড়ে আমি একদম শেষে থাকা একটি বট গাছের আত্মকথা বা একটি নদীর আত্মকথা লিখতে পছন্দ করতাম।
কলেজে নীরস লেকচারের ফাঁকে খোলা জানালা দিয়ে বাইরের ঘুরপাক খেয়ে ওঠা ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখে বিভোর হয়ে যেতাম।
সেই কল্পনার কলতান ইদানিং একটু কমেছে সাংসারিক চাপের কারণে। মনের চাতালে শ্যাওলা জমেছে।
তবু আজও সুযোগ পেলেই মন উড়ি উড়ি।
ট্রেনের আরামপ্রদ চেয়ারে প্রায় সকলেই মুঠো ফোনে মগ্ন। জানি না কি দেখেন, শোনেন। ট্রেনের জানালার বাইরে তখন একটা ছোট্ট গ্রাম। অনেক সুপারি গাছ, দরমার বেড়া দেয়া গোয়ালঘর। টিনের চালা দেয়া দু কামরার ঘর থেকে ধোঁয়া উঠছে। হয়তো কেউ কাচি মাছের বাটি চচ্চড়ি বসিয়েছে। ঝাল ঝাল কুল লঙ্কা দিয়ে সে বড় লোভনীয়।
বেশ কদিন ধরেই এদিকে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। খাল বিল গুলো ভর ভর। তাতে কয়েকজন বাঁশের ঘনি দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টায়। আনারস ক্ষেতে জল ঢুকেছে। একটা মন্দির জেগে আছে। তার চাতালে দুইজন বসে।
ভাবি ওরা কি নিয়ে কথা বলছে।
ডবল ডোজ, বুস্টার, নিউ ভ্যারিয়েন্ট এইসব শব্দ কি ওদের জানা?
সেভক স্টেশন এ বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে। আমাদের শহুরে স্বাচ্ছন্দের বলি কয়েক হাজার গাছ।
শুধুই কি গাছ? তাতে থাকা কত পতঙ্গ, পাখি ? ওরা কোথায় যাবে ?
কতদিন জোনাকি দেখিনা।
রাঙারুনে হোম স্টের বারান্দায় বসে দূরে আলোকমালায় সজ্জিত দার্জিলিং শহরকে দেখে জোনাকি দেখার স্বাদ মেটাই।
আমরা খুব হিংস্র।
ভাবনায় ছেদ পড়ে হকারের ঝালমুড়ির আওয়াজে। কি সুন্দর সাজানো।
কিন্তু আমি যে সব কিছু সাজানো পছন্দ করিনা। একটু অগোছালো থাকাও ভালো। সাজানোর সুযোগ থাকবে তো।
এই দেখোনা সাজানো কাশ্মীর ভ্রমণ করতে গিয়ে মনটা একদম অগোছালো হয়ে গেল।
হৈ হট্টগোল, দৌড়াদৌড়ি করে বেহাল।
অশান্ত মনকে শান্তি দিতে তিনদিনের ছুটিতে চলে এলাম বর্ষার দার্জিলিংয়ে।
কোনও তাড়াহুড়ো নেই, কোলাহল নেই। টিপটিপ বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় অলসভাবে লেবঙ কার্ট রোড, ভুটিয়া বস্তি, মহাকাল মন্দির ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।
চাইনি তবু সে দেখা দিল।
গুনগুন করে গান শোনালাম… আমি আপন করিয়া চাহিনি তোমারে, তুমি তো আপন হয়েছো।
লাজুক হেসে মেঘের চাদরে ঘোমটা দিল।
এই বেশ।
রোহিনীর রাস্তা ধরে শেয়ার জিপে যখন আসছিলাম তখনই চোখে সবুজের আস্তরণ ঘন হয়ে লেপ্টে গিয়েছিল।
জোড় বাংলো নেমে উল্টোদিকের রাস্তা ধরে তিন মাইল এসে যখন রাঙ্গারুন এর রাস্তা ধরলাম সে সবুজ আপ্লুত করে দিল।
কোথাও ঈষৎ হলুদাভ, কোথাও গাড় সবুজের শেড। জনমনিষ্যির চিহ্ন মাত্র নেই সারা রাস্তা জুড়ে।
ট্রেকার্স হাট, খালিঙ্গ হোম স্টে পেরিয়ে আশ্রয় নিলাম নিলম হোম স্টে তে।
ছোট্ট ছিমছাম ঘর বারান্দা। রাঙারুন এর চা বাগান এই অঞ্চলের সবথেকে প্রাচীন।
দুঃখের বিষয় চা কারখানা টি বন্ধ। পূর্বের শ্রমিকরা কেউ দূরের বাগানে কাজ নিয়েছে, কেউ ঘরের সামনে দোকান করে দিন গুজরান করে।
পায়ে হেঁটে ঘুরতে বেশ লাগছিল।
কিছুটা দূরেই লাকপা হোম স্টে। সবথেকে সেরা লোকেশন। ঘর থেকেই চা বাগান সহ টাইগার হিল, দার্জিলিং শহর দৃশ্যমান। গাঁয়ের নীচে নদী। অন্য সময় জল থাকেনা। নদী পেরিয়ে পাহাড় চড়ে টি এন রোড ধরে দার্জিলিং যাওয়া যায়।
আমার সে আশায় জল ঢেলে দিল নদী। জল বিপদজনক ভাবে বয়ে চলেছে। পারাপার মুশকিল।
পরদিন রাঙারুন কে বিদায় জানিয়ে চলে এসেছিলাম দার্জিলিং।
আস্তাবল পেরিয়ে ম্যাল থেকে একশ মিটার দূরে সস্তার হোটেলে এক রাত কাটিয়ে নেমে গিয়েছিলাম শিলিগুড়ি।
ভবঘুরের মত ইচ্ছে নিয়ে কোনও গন্তব্য রাখলাম না। সকালের ট্রেন ধরে ডুয়ার্সের ঘন সবুজ গায়ে মেখে, চোখে লেপটে পৌছেছিলাম আলিপুরদুয়ার। খানিক বিশ্রাম আর দুপুরের ভোজন সেরে ফিরতি পথে ডুয়ার্স রানী কাঞ্চন কন্যা ধরে বাড়ির পথে পা বাড়ানো।
রাজাভাতখাওয়া স্টেশন এর পাশে নুড়ি পাথরের খাঁজে অনেক অনেক প্রজাপতি উড়ছে, বসছে ঘুরছে। কিতাবি ভাষায় মাড পুডলিং বলে।
ওরা ডাক দিল, আসবে না?
বললাম, আসবো আর একদিন, আজ যাই।