বিশ্বক্রিকেটে সবথেকে বড় চোকার্স কারা? জোর লড়াই বেঁধে যেতে পারে দুই দেশের মধ্যে। একটি অবশ্যই দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু নিউজিল্যান্ডকেই বা বাদ দেবেন কীভাবে? তারাও হুঙ্কার দিয়ে বলে চলেছে, ‘হাম ভি কিসি সে কম নেহি’।
প্রতিবার বিশ্বকাপের আগে চলে কালো ঘোড়া বেছে নেওয়ার পালা। অর্থাৎ, কারা চমক দেবে? কারা অনেক হিসেব বদলে দেবে? সেই তালিকায় অনেকেই একেবারে সামনের সারিতেই রাখেন নিউজিল্যান্ডকে। শুরু থেকে নিউজিল্যান্ড বুঝিয়ে দেয়, তারা সত্যিই অন্যরকম দল। তাদের ওপর বাজি ধরে বিশেষজ্ঞরা ভুল করেননি। কিন্তু যেই না আসল সময় আসে, অমনি সব অঙ্ক কেমন যেন গুলিয়ে যায়। যে দলটা দারুণ দাপট নিয়ে খেলছিল, সেই দলটা হঠাৎ করে কেমন যেন গুটিয়ে যায়। ‘আহা’ ‘বেচারা’ এইসব উপমা নিয়েই হারিয়ে যেতে হয়।
ট্র্যাডিশনটা শুরু হয়েছে সেই প্রথম বিশ্বকাপ থেকেই। সেবার সেমিফাইনালে উঠেও হারতে হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। সেই বিশ্বকাপেই কিউয়ি অধিনায়ক গ্লেন টার্নার করেছিলেন ১৭১ রান। তিরাশির বিশ্বকাপে কপিলের সেই অপরাজিত ১৭৫ এর আগে সেটাই ছিল বিশ্বকাপ ও একদিনের ম্যাচের সর্বাধিক রান। তবে নিউজিল্যান্ড তার থেকেও বেশি ধাক্কা খেয়েছিল ৯২ এর বিশ্বকাপে। সেবার গ্রুপের শীর্ষ দল হিসেবে সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল। সেই প্রথম ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। সেই প্রথম স্লগ ওভারে ঝড় তোলার বদলে ঝড় উঠতে শুরু করেছিল প্রথম পনেরো ওভারে। সাবেকি ক্রিকেটের ব্যকরণকেই যেন একঝটকায় বদলে দিয়েছিলেন মার্ক গ্রেটব্যাচ। কিন্তু সেবারও দারুণ দাপট দেখিয়ে সেমিফাইনাল থেকেই বিদায়। নবাগত এক ইনজামাম উল হক যেন সমুদ্রে ঘেরা দেশটার সব আশায় জল ঢেলে দিয়েছিল।
দেশটার চারিদিকে শুধুই সমুদ্র। সে অর্থে প্রতিবেশী দেশ বলতে যা বোঝায়, তা আদৌ নেই। দুটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মিলিয়ে একটি রাষ্ট্র। আয়তনে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মোটামুটি তিন গুন। আর জনসংখ্যায়? বাঁকুড়া আর পুরুলিয়া — এই দুই জেলা মেলালে যা হবে, তার থেকেও কম। তবু একের পর এক কিংবদন্তি ক্রিকেটার উপহার দিয়ে চলেছে ছোট্ট ওই দ্বীপরাষ্ট্র।
অতীত চর্চা থাক। এবারের বিশ্বকাপের কথাতেই আসা যাক। গতবারের রানার্স বলে কথা। বাড়তি সমীহ তো থাকবেই। প্রথম চার ম্যাচ পর্যন্ত পয়েন্ট টেবিলে তারাই শীর্ষে। এমনকী, ভারতেরও উপরে। কিন্তু পঞ্চম ম্যাচ থেকেই টেবিলটা একটু ওলট–পালট হয়ে গেল। শেষমেশ চতুর্থ দল হিসেবে ছাড়পত্র এল। কিন্তু চমক তো এবারও কম ছিল না। একেবারে শুরুতে ডেভন কনওয়ের কথাই যদি ধরেন, শুরুই করলেন ঝোড়ো শতরান দিয়ে। সবমিলিয়ে এই ওপেনারের রান ৩৭২। ড্যারিল মিচেলও দুই শতরান–সহ করে ফেললেন ৫৫২ রান। গড় ৬৯। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন রাচিন রবীন্দ্র। বাবা তীব্র ক্রিকেট অনুরাগী। রাহুল দ্রাবিড়ের ‘রা’ আর শচীন তেন্ডুলকারের ‘চিন’। দুইয়ে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখলেন ‘রাচিন’। তবে রবীন্দ্র মানে অবশ্য রবীন্দ্র জাদেজা নয়। কোনও সন্দেহ নেই, এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা আবিষ্কার এই তরুণ ক্রিকেটার। তাঁর ব্যাট থেকে এল ৫৭৮ রান। মোট রানের নিরিখে চার নম্বরে। নামের পাশে তিন খানা শতরান, দুটি অর্ধ শতরান।
কিন্তু সেমিফাইনালে এসে সেই নিউজিল্যান্ডের কী যে হল! ওয়াংখেড়েতে ভারতের সামনে কার্যত দাঁড়াতেই পারল না। একদিকে ভারত চারশো ছুঁইছুঁই রান তুলে ফেলল। অন্যদিকে, মহম্মদ সামি তুলে নিলেন সাত উইকেট। শুরুতে দুই ওপেনার ফিরে গেলেও কেন উইলিয়ামসন ও ড্যারিল মিচেল একটা লড়াকু জুটি তৈরি করেছিলেন। ওয়াংখেড়ের গ্যালারি তখন আশা–আশঙ্কার দোলায় দুলছে। ঠিক চার বছর আগে, সেমিফাইনালে এই নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরেই ছিটকে যেতে হয়েছিল ভারতকে। এবারও সেই ইতিহাস ফিরে আসবে না তো! কিন্তু যেই জুটি ভাঙল, প্রায় তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ল রিচার্ড হ্যাডলি–মার্টিন ক্রোদের দেশ।
মুম্বইয়ে নিউজিল্যান্ড যেমন ‘চোকার্স’ তকমা বজায় রাখল, ঠিক পরেরদিন ইডেনে দক্ষিণ আফ্রিকাও ‘সুনাম’ বজায় রাখল। অর্থাৎ, দারুণ খেলেও দৌড় এসে সেই সেমিফাইনালেই থেমে গেল। কিউয়িরা অবশ্য এই সেমিফাইনালের বাধাটা টপকেছিল, চার বছর আগে। মনে হয়েছিল, কোনওবারই শিঁকে ছিড়ছে না, এবার নিশ্চয় সমুদ্রবেষ্টিত দেশটিতে বিশ্বকাপ পাড়ি দেবে। কিন্তু হায়! বিধি বাম! ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফাইনাল টাই হল। গড়াল সুপার ওভারে। সেখানেও সমান সমান। শেষমেশ কারা কটা বাউন্ডারি মেরেছে, তার নিরিখে ফয়সালা। এমন এক বিচিত্র নিয়মে কিনা বিশ্বকাপ হাতছাড়া!
আসলে, ‘চোকার্স’ তকমাটা এমনই এক ছাপ ফেলে যাওয়া দাগ, একবার লাগলে সহজে মুছতে চায় না। প্রতিবার বিশ্বকাপ এলেই কাগজে কমন হেডিং, ‘চোকার্স তকমা মুছতে মরিয়া কিউয়িরা’। হেডিং হয়, সেই কাগজ ঠোঙাও হয়। কিন্তু তকমাটা আর কিছুতেই মোছে না। কী জানি, ক্রিকেট সার্কিটে এমন ডিটারজেন্ট পাউডার হয়ত আবিষ্কারই হয়নি।