স্বরূপ গোস্বামী
স্টেডিয়ামের ওই নীল–সাদা ঢেউয়ের মাঝে তিনি। মেসিদের টিমবাসে, সাজঘরেও তিনি। স্টেডিয়ামের বাইরে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। তাঁরা টিকিট জোগাড় করে উঠতে পারেননি। কেউ ভিড় করেছেন ফ্যান জোনে। কেউ আবার সমুদ্র সৈকতে। পরনে নীল–সাদা জার্সি। আর চিৎকার করে চলেছেন, ভামোস আর্জেন্টিনা। ভামোস মেসি। সেই ভিড়েও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। দোহা থেকে প্রশান্ত মহাসাগর ডিঙিয়ে সাড়ে তেরো হাজার কিমি দূরের বুয়েনস এয়ার্স। মাঝদুপুরে সেখানেও যেন জনসমুদ্র। নীল–সাদা সেই ঢেউয়ের মাঝেও তিনি।
কাতার থেকে কলকাতা কতদূর? জানান দেওয়ার জন্য সবজান্তা গুগল আছে। সেই দূরত্ব জানার দরকার নেই। হৃদয়ের দূরত্ব ভূগোলের হিসেবে মাপা যায় না। সেই শহরের অলিতে, গলিতে কত লড়াই, কত তর্ক, কত বিভাজন। কেউ টিএমসি, কেউ বিজেপি, কেউ সিপিএম। খেলার আঙিনাতেও কি রেহাই আছে! সেখানেও কেউ মোহনবাগান, কেউ ইস্টবেঙ্গল। সব বিভাজনের পাঁচিল ভেঙে নীল–সাদার জয়গানে তিনি আছেন।
আসলে, সেই প্রাচীরটা তিনি ভেঙে দিয়েছেন সেই ৩৬ বছর আগে। সেই কবে বাঙালির হৃদয়ের মানচিত্রে গেঁথে দিয়েছেন আর্জেন্টিনার পতাকা। তিনি ট্রফি জিতলে বাঙালি উত্তাল হয়, তিনি কাঁদলে বাঙালিও কাঁদে। বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে তিনি নির্বাসিত সেই চুরানব্বইয়ে। তারপরেও বাঙালি সেই হ্যাংওভার কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই তিনি নেই জেনেও কাতারের মঞ্চে তাঁরই ছায়া খোঁজে।
দু’বছর হল পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন অন্য এক দুনিয়ায়। এই পৃথিবীর খবর কি তাঁর কাছে পৌঁছোয়! আচ্ছা, সেখানে কি টিভি আছে? সেখানে কি ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম— এ–সব কাজ করে! প্রতিনিয়ত ছবি পোস্ট করে, স্টেটাস আপডেট দিয়ে তাঁকে প্রাসঙ্গিক থাকতে হয় না। তবু তাঁর ছবিগুলো কী করে ঘুরে বেড়ায় ফেসবুকের এক দেওয়াল থেকে অন্য দেওয়ালে! ইংরেজি জানতেন না (জানলেও বলতেন না)। বাংলা তো দূরের কথা। তবু বোধ হয়, সেই সারসত্যটা বুঝেছিলেন, হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে। তাই ঘুরেফিরে আসে ছিয়াশির সেই কাপে চুমু খাওয়ার ছবি, অভিমন্যুর মতো ডিফেন্সের চক্রব্যূহ ভেদ করে গোল করে আসার ছবি, ভামোস আর্জেন্টিনা স্লোগান তুলে বুক চাপড়ানোর ছবি।
চুরানব্বইয়ে পা থেকে ফুটবল কেড়ে নিয়েছিল ফিফার ফতোয়া। কিন্তু গ্যালারিতে তাঁকে কে ঠেকায়! পতাকা উড়িয়েছেন, জার্সি উড়িয়েছেন, পাগলের মতো চিৎকার করেছেন। এমন তীব্র যাঁর প্যাশন, তাঁকে মাঠের বাইরে মানায়! এভাবে বাইরে থেকে চিৎকার করে কি দেশকে জেতানো যায়! কোচিং ডিগ্রি নেই। তবু নেমে পড়েছেন কোচিং করতে। তাও আবার বিশ্বকাপে (২০১০)। কারণ, বুঝেছিলেন, বিশ্বকাপ আনতে পারলে মেসি নামের এই ছেলেটাই পারবে। বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন মেসিকে। সব ঝড়ঝাপটা নিলেন নিজের কাঁধে। মেসি যখন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, সেই আঘাতও নিলেন বুক পেতে। একসময় অবসর নিয়ে বসলেন অভিমানী মেসি। তিনি ডাক দিলেন, ফিরে এসো, এখনও তোমার আসল কাজ বাকি।
অভিমান ভুলে ফিরে এলেন মেসি। সেই রক্ষণের জঙ্গল ভেদ করে বাড়ালেন ঠিকানা লেখা পাস, ঠিক যেমনটা ওই লোকটা বাড়াতেন। একবুক যন্ত্রণা চেপে লিখলেন নতুন ইতিহাস। ঠিক যেমনভাবে ওই লোকটা লিখেছিলেন। এই মেসি আসলে কে? উত্তর হল, একটুকরো মারাদোনা। আসলে, পাগলপারা মেসির মধ্যেও ওই মানুষটাই লুকিয়ে ছিলেন।
Categories
খেলা