সরোজ চক্রবর্তী
বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় জোরদার চর্চা। কখনও দলকে নিয়ে। কখনও তারকাদের নিয়ে। কোন দল চ্যাম্পিয়ন হবে, কারা দ্রুত ছিটকে যাবে, তা নিয়ে যেমন চর্চা চলে, তেমনই কোন তারকা কতখানি জ্বলে উঠবেন, তা নিয়েও সরগরম থাকে ফুটবল মহল।
এবারের বিশ্বকাপের আগে কোন তিনটি নাম নিয়ে সবথেকে জোরালো চর্চা হয়েছে? নিশ্চিতভাবেই সেই তিনটি নাম হল মেসি, রোনাল্ডো ও নেইমার। প্রথম দুজনের এবারই শেষ বিশ্বকাপ। নেইমারের যা বয়স, হয়ত আরও একটা বিশ্বকাপে তাঁকে দেখা যাবে। তিনজনই যে বিরাট জ্বলে উঠেছেন, এখনও পর্যন্ত এমনটা বলা যাবে না। তবে, প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল পর্ব পেরিয়ে যাওয়ার পরেও এই তিনজন তারকাই কিন্তু টিকে আছেন। কাউকেই ছিটকে যেতে হয়নি।
তিনজনের তুলনামূলক আলোচনা করা যাক। একদিকে মেসি। প্রথম ম্যাচেই হার অখ্যাত সৌদি আরবের কাছে। একেবারে খাদের কিনারায় আর্জেন্টিনা। আর একটা হারলেই বিদায়। এই অবস্থায় চাপটা আরও বেশি করে এসে যায়। ঠিক সেখান থেকেই যেন ঘুরে দাঁড়াল আর্জেন্টিনা। অবশ্যই মেসির ঠান্ডা মাথা। পরের দুই ম্যাচে দলকে জেতালেন। এমনকী প্রি কোয়ার্টারেও জয় এল। মেসি পেনাল্টি মিস করলেন ঠিকই, কিন্তু তারপরও নিরন্তর আক্রমণ চালিয়ে গেলেন। হয়ত আসল জ্বলে ওঠা এখনও বাকি। তবু যেটুকু হয়েছে, দশে ছয় তো দেওয়াই যায়।
পরের জন হতেই পারতেন রোনাল্ডো। তাঁর কথায় পরে আসা যাক। আপাতত নেইমারকে নিয়ে দু’চার কথা। প্রথম ম্যাচেই গোড়ালিতে চোট। ছিটকে গেলেন পরের দুই ম্যাচে। ব্রাজিল প্রথম দুই ম্যাচে জিতে যাওয়ায় অবশ্য নকআউট নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল না। সেদিক থেকে কোচ টিটে অনেকটা খোলামনে দল পরিচালনা করতে পেরেছেন। তাই নেইমার নেই শুনেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। বরং অপেক্ষা করেছেন, নকআউটের জন্য। নকআউটের শুরু থেকেই দেখা গেল নেইমারকে। একটু নিচের থেকে খেলালেন। একজন তারকা সদ্য চোট সারিয়ে ফিরেছেন। ফলে, শুরু থেকেই তিনি যেন বিপক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু না হয়ে যান, সেটাও দেখা দরকার। ব্রাজিল পেনাল্টি পেল। মারতে পাঠালেন নেইমারকেই। কারণ, তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনাটাও জরুরি। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে নেইমার যে একাই ফারাক গড়ে দিয়েছেন, এমন নয়। কিন্তু পেছন থেকেও বড় ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁকে আগলাতে বিপক্ষের দু–তিন জন ব্যস্ত থেকেছেন। সেই সুযোগে অন্যরা কিছুটা ফাঁকা জমি পেয়েছেন। ফলে, গোলমুখের জটলা একটু হলেও কম ছিল। হয়ত সেই কারণেই ৩৬ মিনিটে চার গোল তুলে নেওয়া সহজ হয়েছে।
এবার রোনাল্ডো। তিন মহাতারকার মধ্যে সবথেকে খারাপ জায়গায় আপাতত তিনিই। শেষ বিশ্বকাপকে স্মরণীয় রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর আগেই জড়িয়ে গেলেন অযাচিত বিতর্কে। ফোকাসটা একটু হলেও নড়ে গেল। নিজেকে জোর করে প্রাসঙ্গিক করতে গিয়ে অন্যের গোলকে নিজের গোল বলে চালাতে চাইলেন। মাথায় স্পর্শ হয়নি। তবু গোলদাতার ভূমিকায় ছুটে গেলেন। ব্রাজিলের মতো পর্তুগালও প্রথম দুই ম্যাচ জিতেছিল। ফলে, আগেই নকআউটে পৌঁছে যায়। শেষ ম্যাচে কোচ যেই শেষদিকে রোনাল্ডোকে তুলতে গেলেন, রোনাল্ডো সেটা মন থেকে নিতে পারলেন না। মেজাজ দেখিয়ে বসলেন। পরের ম্যাচে চোখের সামনে দেখলেন নতুন তারকার উত্থান। তাঁকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়েও ম্যাচ বের করে নিলেন কোচ স্যান্টোস। বুঝিয়ে দিলেন, তুমি দলের থেকে বড় নও। রোনাল্ডোর পক্ষে ব্যাপারটা হজম করা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
তাহলে, তিনজনের তুলনা টানলে কী দাঁড়াল? প্রথম দু’জন এখনও দলের সম্পদ। কিন্তু রোনাল্ডো এখন আর ততখানি সম্পদ নন। ক্লাবে যেমন পড়তি ফর্মে চলে গিয়েছিলেন, দেশের হয়েও হয়ত তাই। কোয়ার্টার ফাইনালে কি কোচ শুরু থেকে তাঁকে ব্যবহার করবেন? র্যামোসের দুরন্ত হ্যাটট্রিকের পর তিনিই হয়ত কোচের টেক্কা হয়ে উঠবেন। রোনাল্ডো হয়ত ট্র্যাজিক হিরো হয়েই থেকে যাবেন। অপরিহার্যতার নিরিখে যদি রেটিং করি, প্রথমে অবশ্যই মেসি। দুইয়ে নেইমার। রোনাল্ডোর জায়গা সেই তিন নম্বরে।