Categories খেলা

অনেক সম্ভাবনা উস্কে দিয়ে গেল ‘‌গাভাসকারের জন্ম’‌

কপিলদেবের সেই অপরাজিত ১৭৫। কত লোক সেই ইনিংসের স্মৃতিচারণ করেন। কার বাড়ির টিভিতে দেখেছিলেন, সেটাও গড়গড় করে বলে যান। কিন্তু ঘটনা হল, সেই ম্যাচটা টিভিতে দেখানোও হয়নি। এমনকী, সেই ইনিংসের কোনও রেকর্ডিং খোদ কপিলদেবের কাছেও নেই। আসলে, তিরাশি এমনই এক রূপকথা, সবাই যার সাক্ষী থাকতে চায়। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সবাই যে সচেতন মিথ্যে বলেন, এমনটা নয়। আসলে, মনে মনে তাঁরা ভাবতে থাকেন, সত্যিই বোধ হয় দেখেছি। সেই বিশ্বাসটাই ক্রমে জাঁকিয়ে বসে।

প্রাক তিরাশি ভারতীয় ক্রিকেটে তেমনই এক রূপকথার জন্ম একাত্তরে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সিরিজ হারানো!‌ তাও আবার এমন দল নিয়ে, যে দলে না ছিলেন ভাল মানের জোরে বোলার, না ছিল তেমন মিডল অর্ডার। শুধু চার স্পিনারের ওপর ভর করে ফাস্ট বোলিংয়ের স্বর্গরাজ্যে পাড়ি দেওয়া!‌ না ছিল পতৌদির মতো ওজনদার নেতা, না ছিল ঈর্ষণীয় টিম স্পিরিট। এত কিছু নেই–‌এর ভীড় সরিয়ে কীভাবে এসেছিল সেই রূপকথার জয়! পঞ্চাশ বছর পর‌ সেই গৌরবগাথা নিয়েই গৌতম ভট্টাচার্য ও বোরিয়া মজুমদারের দুরন্ত বই ‘‌গাভাসকারের জন্ম’‌।

বইটা বাংলার পাশাপাশি ইংরাজিতেও বেরিয়েছে। সেখানে নাম ‘‌১৯৭১’‌। কিন্তু বাংলায় ‘‌গাভাসকারের জন্ম’‌ নাম কেন?‌ প্রশ্ন উঠতেই পারে। লেখকদের ব্যাখ্যাও আছে। সেই ব্যাখায় পুরোপুরি একমত হওয়া বা না–‌হওয়াটা পাঠকের নিজস্ব স্বাধীনতা। আসলে, সেই সিরিজ যেমন মহাকাব্যিক জয়ের একটা মাইলস্টোন, তেমনি সেই সিরিজ জন্ম দিয়েছিল সুনীল গাভাসকার নামের এক কিংবদন্তিকে। পরবর্তীকালে যিনি দশ হাজার রানের এভারেস্টে পৌঁছে যাবেন, ৩৪ টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক হবেন, পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠবেন, সেই মহাজীবনের উত্থান তো এই সিরিজেই। সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি, দু–‌ইনিংসে সেঞ্চুরি সব ওই প্রথম সিরিজেই। সিরিজে ৭৭৪ রান!‌ যা ক্রিকেট লোকগাথায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। সেই দুরন্ত অভিষেকেরও তো সুবর্ণ জয়ন্তী।

তাই বলে এই বই গাভাসকারের উত্থানে আচ্ছন্ন নেই। গোটা বই জুড়ে গাভাসকারের কথা দশ শতাংশও নেই। তাহলে কী আছে?‌ যা আছে, তা কোনও অংশে কম আকর্ষণীয় নয়। এতদিন সেভাবে উঠেও আসেনি। একটা সিরিজকে ঘিরে এত কিছু ঘটেছিল!‌ পতৌদি, গাভাসকার, ওয়াদেকার, প্রসন্নদের আত্মজীবনীতে বিক্ষিপ্তভাবে নানা কথা উঠে এসেছে। কিন্তু পুরো ক্যানভাসটা ধরা পড়েনি। ধরা পড়া সম্ভবও ছিল না। কারণ, তাঁরা নিজেদের অনুভূতি উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু গবেষকের নির্মোহ দৃষ্টি ছিল না। বা সবটা বেআব্রু করা তাঁদের পক্ষে হয়তো শোভনীয়ও ছিল না। একদিকে না থেকেও প্রবল ছায়া পতৌদির। অন্যদিকে হঠাৎ করে নেতৃত্ব পাওয়া মধ্যবিত্ত ব্যাঙ্কার ওয়াদেকার। বিভাজনটা অদৃশ্য হলও প্রায় আড়াআড়ি থেকে গিয়েছিল। শুধু তারকার ঝলমলে উপস্থিতি নয়, যাঁরা নিষ্ফলের হতাশের দলে থেকে গিয়েছেন, এই সিরিজের পর যাঁদের আর কখনও ক্রিকেটীয় আঙিনায় দেখাই যায়নি, তাঁদের কথা–‌যন্ত্রণাও উঠে এসেছে প্রায় একইরকম গুরুত্ব ও সহমর্মিতা নিয়ে।

এ শুধু গবেষণা নয়, তার থেকে অনেক বেশি কিছু। লাইব্রেরিতে কয়েকটা বই ঘেঁটে বা জীবিত কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই দুর্মূল্য বই লেখা সম্ভব ছিল না। সোলকার সেই কবেই মারা গেছেন। টাইগার পতৌদি, অজিত ওয়াদেকার, অশোক মানকড়, দিলীপ সরদেশাই, জয়সীমা, কৃষ্ণমূর্তিরা ও নেই। কিন্তু নানা সময়ে তাঁদের নানা স্মৃতিচারণও আছে। কিছু অন দ্য রেকর্ড, কিছু অফ দ্য রেকর্ড। অর্থাৎ, এই বইয়ের প্রস্তুতি নিশ্চিতভাবেই কয়েক দশক আগে থেকে নেওয়া। অভিজ্ঞ সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য প্রায় চার দশক ধরে কাছ থেকে দেখে আসছেন ভারতীয় ক্রিকেটের নানা চড়াই–‌উতরাই। নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন অতীতের দিকপালদেরও। সেই অভিজ্ঞতা এই বইয়ের বড় একটা সম্পদ। আবার পাশাপাশি দরকার ছিল যথার্থ গবেষণা ও ক্রিকেট ঐতিহাসিকের নির্মোহ দৃষ্টি। সেই অভাবটা পূর্ণ করেছেন গবেষক বোরিয়া মজুমদার। সবকিছুকে এক মলাটে আনতে দরকার ছিল পর্যাপ্ত সময়, যত্ন আর সমন্বয়। দীর্ঘ লকডাউন এক্ষেত্রে যেন শাপে বর হয়ে দেখা দিয়েছে। বিষয় বিন্যাস আর ঝরঝরে গদ্য টেনে নিয়ে যায় শেষ পাতা পর্যন্ত।


অজানা কাহিনিগুলো নিয়ে আস্ত একটা উপন্যাস হতে পারে না!‌ কেউ কেউ চেষ্টা করে দেখতেই পারেন। তাতে ক্রিকেট সাহিত্য আরও একটু সমৃদ্ধ হতে পারে। তিরাশির বিশ্বজয় নিয়ে ছবি হচ্ছে। একাত্তরও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়। এই বই যেন সেই সম্ভাবনাকেও উস্কে দিয়ে গেল।
***
গাভাসকারের জন্ম
গৌতম ভট্টাচার্য ও বোরিয়া মজুমদার
দীপ প্রকাশন

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.