ছোট্ট একটি রাজ্য। তারা কিনা ফুটবলে ভারতসেরা! কত বার্তাই না দিয়ে গেল আইজল এফ সি। কিন্তু আমরা কি তাদের কাছ থেকে কিছু শিখলাম! লিখেছেন প্রসূন মিত্র।।
শেষ ম্যাচের দিকেই তাকিয়েছিল কলকাতা। একদিকে মোহনবাগান খেলতে নেমেছিল চেন্নাই এফসি–র বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, শিলংয়ের মাঠে আইজল এফসি খেলতে নেমেছিল লাজংয়ের বিরুদ্ধে। অঙ্কটা খুব পরিষ্কার ছিল। এদিকে মোহনবাগানকে জিততেই হবে। ওদিকে আইজলকে হারতেই হবে। এই দুটো যদি ঘটে যায়, তাহলেই পঞ্চমবারের জন্য আই লিগ আসবে সবুজ মেরুন তাঁবুতে।
প্রথমটা হল। কিন্তু দ্বিতীয়টা হল না। এদিকে মোহনবাগান জিতল ঠিকই, কিন্তু ওদিকে আইজল ড্র করল। ফলে পয়েন্টের হিসেবে আইজল জিতে নিল আই লিগ। কিন্তু তারপর যেটা ঘটল, সেটা কারও নজরে এল না। কারণ, ততক্ষণে টিভি চ্যানেলে অন্যকিছু দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। গ্যালারিতে ঘটল অদ্ভুত একটা ঘটনা। আই লিগ জয়ের সাক্ষী থাকবেন বলে শিলংয়ে গিয়েছিলেন হাজারের ওপর মিজোরাম সমর্থক। আয়োজনের কোনও ত্রুটিও ছিল না। বাদ্যযন্ত্র থেকে পটকা, অনেককিছুই নিয়ে গিয়েছিলেন। আই লিগ জেতার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেই পারতেন। কিন্তু চমৎকার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আইজলের সমর্থকরা। তাঁরা ঠিক করলেন, খেলা চলাকালীন তাঁরা শিলংয়ের গ্যালারি যেটুকু নোঙরা করেছেন, তা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবেন। ম্যাচ শেষে সাময়িক আনন্দ কাটিয়ে তাঁরা নেমে পড়লেন সাফাই অভিযানে। গ্যালারিতে পড়েছিল চায়ের কাপ, প্লাস্টিকের প্যাকেট, কাগজ, আরও টুকটাক কিছু। আইজল সমর্থকরা সবকিছু নিজেদের হাতে পরিষ্কার করলেন। মাঠের মধ্যে যেমন ফুটবলাররা চ্যাম্পিয়ন, মাঠের বাইরে তেমনি এই সমর্থকরা চ্যাম্পিয়ন।
আমাদের রাজ্যে এমনটা ভাবা যায়! ভাবুন তো, ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা গিয়ে মোহনবাগানের গ্যালারি পরিষ্কার করছেন। বা মোহনবাগান সমর্থকরা ইস্টবেঙ্গলের গ্যালারি পরিষ্কার করছেন। এমনটা কখনও দেখতে পাবেন? আমাদের নিজেদের ঝগড়া এতটাই প্রসারিত, আমরা একে অন্যের পতাকা পোড়াই। কেউ গিয়ে ফেন্সিং ভেঙে দিয়ে আসি। সুযোগ থাকলে আরও কত অপকর্ম করতাম, কে জানে!
আই লিগ জেতার সুবাদে অনেকেই আইজলকে ভারতসেরা বলছেন। বলতেই পারেন, যুক্তি আছে। যেভাবে ছোট্ট একটা রাজ্যের অখ্যাত একটা দল নিজেদের এভাবে তুলে আনল, কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। তারকা ফুটবলার নেই। বাজেট একেবারেই সামান্য। সব অনামী–অখ্যাত তরুণদের নিয়ে গড়া দল। তবে, এই তরুণদের কিন্তু নিজেদের হাতে করে তৈরি করেছেন আইজল কর্তৃপক্ষ। মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গলের এত বছরের পুরনো ইতিহাস। স্পন্সরেরও অভাব নেই। কত কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। অথচ, তরুণ প্রতিভা তুলে আনার ব্যাপারে আমাদের দুই প্রধান কি সত্যিই আন্তরিক? এই একটা জায়গাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মিজোরামের এই দলটি। তাই যাঁরা মোহনবাগান সমর্থক, নিজের দল আই লিগ না জেতায়, নিশ্চয় তাঁদের দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু আইজলের কৃতিত্বকে খাটো করবেন না। নতুন চ্যাম্পিয়নকে মুক্ত মনে স্বাগত জানান।
আইজল কি পরেরবারও চ্যাম্পিয়ন হবে? এতটা আশা করা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। হয়ত ফেড কাপেই ব্যর্থ হতে পারে। পরের বার যদি নাও জেতে, তবু এবারের সাফল্যটা কিন্তু ব্যর্থ নয়। আমাদেরও মনে হয়, এবার প্রত্যাশার চাপ বাড়বে। অখ্যাতদের নিয়ে বারবার হয়ত চমক দেওয়া যাবে না। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলে এত বছরের আই লিগের ইতিহাসে সেরা চমক অবশ্যই এই পাহাড়ি দলটি। একটা ছাপ রেখে গেল। আর মাঠের বাইরের দর্শকরা? তাঁরাও আমাদের অনেককিছুই শিখিয়ে গেলেন। কিন্তু আমাদের কি সত্যিই শেখার মানসিকতা আছে?