অজয় নন্দী
পৃথিবীর প্রাচীনতম হকি প্রতিযোগিতা কোনটি? উত্তর হল, বেটন কাপ। কোথায় হয়? উত্তর হল, কলকাতা। হ্যাঁ, হকির ইতিহাসের সঙ্গে এভাবেই জড়িয়ে আছে কলকাতার নাম। দেশের দিকপাল তারকারা খেলে গেছেন এই বেটন কাপে। এখন বেটন কাপ আছে ঠিকই, কিন্তু সেই উন্মাদনা আর নেই। কবে শুরু হয়, কবে শেষ হয়, জানাই যায় না।
প্রতি বছর বেটন কাপ এলেই একটি আশ্বাস ঠিক শোনা যেত। ফাইনালে হাজির থাকতেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। তিনি বলতেন, আমরা অ্যাস্ট্রো টার্ফ তৈরি করছি। সামনের বার থেকে বেটন কাপ হবে সেই নতুন অ্যাস্ট্রো টার্ফে। এক দশকের বেশি সময় ধরে এই ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে গেছেন। কাগজে সেই ভাষণ বড় বড় করে বেরিয়েছে, শিরোনাম হয়েছে। পরের বছর আবার তিনি ফাইনালের প্রধান অতিথি। আবার সেই এক ভাষণ।
হঠাৎ কলকাতার বুক থেকে হকি হারিয়ে গেল কেন? শুধু কলকাতা কেন, হকিকে ঘিরে ভারতের যে একচেটিয়া দাপট, তাও যেন এখন নিছক রূপকথা মনে হয়। অলিম্পিকে আটবার সোনা এসেছে এই হকি থেকেই। কিন্তু শেষ সোনা এসেছে সেই ৪৫ বছর আগে। আবার সেই প্রশ্ন, ভারতই বা হকির শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই থেকে এতখানি পিছিয়ে পড়ল কেন?
হকির প্রাক্তনরা একটা ব্যাখ্যাই দিয়ে থাকেন, যখন থেকে অ্যাস্ট্রো টার্ফে হকির শুরু, তখন থেকেই ভারত যেন মূলস্রোত থেকে হারিয়ে গেল। অন্যান্য দেশ যখন ঘাসের মাঠকে বিদায় জানিয়ে একের পর এক অ্যাস্ট্রো টার্ফ বানিয়ে ফেলল, আমরা তখন অনেক পিছিয়ে। গত দুই–তিন দশকে দেশের নানা প্রান্তে অ্যাস্ট্রো টার্ফ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আমাদের রাজ্যে এতদিন একটিই অ্যাস্ট্রো টার্ফ ছিল। সল্টলেক সাই সেন্টারে। হকির জন্য আলাদা মাঠ ছিল না। ফুটবলের মাঠে আর যাই হোক, হকি হয় না। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাব আগে হকি দল বানাতো। লিগকে নিয়ে হইচই পড়ে যেত। আস্তে আস্তে ক্লাবগুলিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলল।
পড়শি রাজ্য ওড়িশা হকি ইন্ডিয়ার স্পনসর। সেখানে হকির বিশ্বকাপ হয়ে গেল। হকির পরিকাঠামোকে তারা কোথায় নিয়ে গেল। আর আমরা পড়ে রইলাম সেই তিমিরেই। গত কয়েকমাসে যেন ছবিটা অনেকটা বদলে গেল। ডুমুরজলা স্টেডিয়ামে বসল আধুনিক অ্যাস্ট্রো টার্ফ। মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গল লড়াইকে ঘিরে আবার যেন হারানো দিন ফিরে পেল কল্লোলিনী তিলোত্তমা। প্রথমে গ্রুপ লিগে, পরে ফাইনালে। আবার শিরোনামে উঠে এল হকি। যুবভারতী সংলগ্ন মাঠেও বসছে আরও একটি অ্যাস্ট্রো টার্ফ। সেখানে থাকবে নৈশালোকের ব্যবস্থাও। অর্থাৎ, সামনের বছর থেকে হকির কলকাতা লিগ হবে নৈশালোকে। নিশ্চিতভাবেই আকর্ষণ আরও বাড়বে।
লেখার শুরুটাই হয়েছে সমালোচনা দিয়ে। বছরের পর বছর সরকারের প্রতিশ্রুতির ফানুস নিয়ে। কিন্তু এক বছরের মধ্যে দুটো হকির মাঠ যদি তৈরি হয়, তার কৃতিত্বও সরকারের প্রাপ্য। যা দশ বছর আগে হতে পারত, তা না হয় দশ বছর পরেই হল। অবশ্য এই বিলম্বের দায় বাম সরকারেরও। দুই দশক আগেই রবীন্দ্র সরোবরে অ্যাস্ট্রো টার্ফের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সুভাষ চক্রবর্তী উঠেপড়েই লেগেছিলেন। কিন্তু ময়দানের একাংশের বিরোধিতায় তা শেষমেশ বাস্তবায়িত হয়নি। তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়।
পড়শি রাজ্য ওড়িশা যদি হকিতে এতখানি এগিয়ে যায়, তাহলে বেটন কাপের শহরই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? একটা অ্যাস্ট্রো টার্ফের কতই বা খরচ! তার জন্য শুধু সাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে কেন? একটা অ্যাস্ট্রো টার্ফ কতখানি উন্মাদনা ফিরিয়ে দিল, তা তো চোখের সামনেই দেখা গেল। ক্লাবগুলিও দল গঠনে এগিয়ে এসেছে। এবারের উন্মাদনায় তাদের উৎসাহ আরও বাড়বে। নতুন দল যেমন আসবে, তেমনই স্পনসরও আসবে। আমাদের শহরের বুক থেকে অনেককিছু যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনই আবার অনেককিছু ফিরেও আসছে। এই শহর আইপিএল দেখেছে, আইএসএল দেখেছে। এবার হকিকে ঘিরেও মেতে উঠুক কল্লোলিনী তিলোত্তমা।