ঋষভ সাহা
গত কয়েক বছর ধরে অদ্ভুত একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। যাদবপুর মানেই কেমন যেন একটা বাঁকা চোখে দেখা। যেন যাদবপুরের পড়ুয়া মানেই তারা দেশদ্রোহী। যাদবপুরের পড়ুয়া মানেই তারা মদ, গাঁজা খায়। কী আশ্চর্য, একের পর এক মূলস্রোত মিডিয়া এরকম প্রচার করে চলেছে।
যে কোনও প্রতিষ্ঠানেই নানা মতবাদের মানুষ থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। যাদবপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে মেধাবী ছাত্ররা এখানে পড়তে আসেন। এখানে যে কেউ সুযোগ পান না। অনেক বাধা অতিক্রম করে এখানে সুযোগ পাওয়া যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বিজ্ঞান, বাণিজ্য থেকে কলা— সব বিভাগেই মেধার ছড়াছড়ি। এখান থেকে পাস করে তাঁরাই দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে কাজ করেন। এক লহমায় তাঁদের সবাইকে কালিমালিপ্ত করে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?
এখানে যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা সবাই একমতের হবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। কেউ হয়তো বাম মনস্ক, কেউ তৃণমূল মনস্ক, কেউ বিজেপি মনস্ক। কেউ এসইউসিআই বা নকশালপন্থীও হতে পারেন। সবার স্লোগান কখনই এক নয়। বাজার গরম করতে কেউ একটা দেওয়ালে স্লোগান লিখে দিলেন, অমনি ওটাকেই যাদবপুরের মূল সুর ধরে নিয়ে রে রে করে সমালোচনা করা— এমনটা কাম্য নয়। এমনকী নানা ইস্যুতে যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের সুরও এক নয়। একজনের সঙ্গে আরেকজনের ভাবনা মেলে না। তাই বলে সেখানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করা হবে, সেনা নামানো হবে, এসব হুঙ্কার কেন?
যাঁরা শাসক, তাঁরা দায়িত্বশীল হবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু কে কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারেন, এ যেন তার প্রতিযোগিতা। রাজ্যের শাসকদলের নেতা মন্ত্রীরা বলতে শুরু করলেন, আধঘণ্টায় যাদবপুর দখল করে নিতে পারি। কেউ কেউ আবার দশ মিনিটে নামিয়ে আনলেন। এতই যদি ক্ষমতা, বছরের পর বছর নির্বাচন করাতে ভয় পাচ্ছেন কেন? ছাত্ররা কী চেয়েছিল? দ্রুত নির্বাচন হোক। তাতেই এত গাত্রদাহ? বছরের পর বছর স্থায়ী উপাচার্য নেই কেন? এই দায় কি ছাত্রদের? রাজ্যপাল আর শিক্ষামন্ত্রী ছেলেমানুষদের মতো ঝগড়া করছেন। বলা যায়, নিজের নিজের পদের গুরুত্ব ভুলে দিয়ে ইতরতার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এঁরা কিনা ছাত্রদের জ্ঞান দিচ্ছেন!
কেন্দ্রের শাসক দল সমালোচনা বলতে একটা শব্দই বোঝে— দেশদ্রোহী। যেন দেশপ্রেমের সব ঠিকে তাঁরা নিয়ে বসে আছেন। তাঁরা চিৎকার করে যেটা বলবেন, সেটাই দেশপ্রেম। আর বাকিরা তা না মানলেই তাঁরা দেশদ্রোহী। তাই এঁদের কাছে জেএনইউ মানে দেশদ্রোহী, এঁদের কাছে যাদবপুর মানে দেশদ্রোহী। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে যাঁদের তেমন সম্পর্ক নেই বললেই চলে, বছরের পর বছর যাঁরা প্রকাশ্যেই ইংরেজদের দালালি করে এসেছেন, তাঁরাও কিনা আজ দেশপ্রেমের ভাষণ দিচ্ছেন। সংকট সত্যিই গভীরে, তাই এঁদের কাছে দেশপ্রেমের ভাষণ শুনতে হচ্ছে।