এ কলকাতার মাঝেই তো আরেকটা কলকাতা

মলয় সিনহা

‘‌‌এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা/‌ হেঁটে দেখতে শিখুন।’‌ সেই কতকাল আগে লিখে গিয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি সত্যিই আমাদের এই প্রাণের শহরকে ঠিকঠাক চিনি?‌ আমরা কি সত্যিই হেঁটে দেখতে শিখেছি!‌ আমরা কি এই কলকাতার মধ্যে আরেকটা কলকাতার সন্ধান পেয়েছি!‌

আসলে, আন্তর্জাতিক সাফল্য বা স্বীকৃতি না এলে বাঙালি ঘরের মানুষকে ঠিক চেনে না। রবীন্দ্রনাথ নোবেল না পেলে তিনি কি এতখানি শ্রদ্ধার পাত্র হতেন?‌ আর দশজন কবির সঙ্গে কি আমরা তাঁকে গুলিয়ে ফেলতাম না!‌ সত্যজিৎ রায় অস্কার না পেলে তিনি কি আমাদের কাছে ‘‌বিশ্ববরেণ্য’‌ হয়ে উঠতেন!‌ অর্থাৎ, বিশ্ব যখন চিনিয়ে দেয়, তখন আমরা চিনতে শুরু করি।

সম্প্রতি বিশ্বের এক নামী পর্যটন সংস্থা কলকাতাকে বিশ্বের সেরা শহরগুটির তালিকায় রেখেছে। আমাদের প্রচলিত ধারণা, পর্যটন মানেই বুঝি পাহাড়, জঙ্গল বা সমুদ্র। এই তিনটের কোনওটাই কলকাতায় নেই। তাই কলকাতা যে পর্যটনের গন্তব্য হতে পারে, এটা আমরা সেভাবে তলিয়ে দেখিনি। কলকাতা খুব ভাল ঘোরার জায়গা, অনেককিছু দর্শনীয় জায়গা আছে, শুধু এই কারণে এই স্বীকৃতি নয়। কলকাতার ইতিহাস, পরম্পরা, কলকাতার উন্নয়ন, কলকাতার কৃতী মানুষ— সব মিলিয়েই এই স্বীকৃতি। অর্থাৎ, একটি স্বীকৃতি যেন একছাতার তলায় অনেক সাফল্যের মালা গেঁথে দিয়ে গেল। এই শহরের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। ১৯১১ পর্যন্ত এই কলকাতাই ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। মুঘল সম্রাটদের দিল্লি নয়, সাহেবরা বেছে নিয়েছিলেন গঙ্গার পাড়ের এই শহরকে। দেশের অনেককিছুই কলকাতায় প্রথম। অর্থাৎ, কলকাতা পথ দেখিয়েছে, তারপর বাকি ভারত তাকে অনুসরণ করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে বড় ভূমিকা ছিল কলকাতা ও বাংলার। সেই কারণেই বঙ্গভঙ্গের আয়োজন, সেই কারণেই রাজধানী স্থানান্তর। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সিনেমা, গানবাজনা, বিজ্ঞান, ইতিহাসচর্চা, খেলাধূলা— সব ব্যাপারেই কলকাতা যেন অগ্রণী।

পরের দিকেও এই ধারা বজায় থেকেছে নানা ক্ষেত্রে। দেশের প্রথম মেট্রো রেল যেমন কলকাতায়, তেমনই প্রথম মোবাইলও চালু কলকাতায়। চলচ্চিত্র উৎসব হোক বা বইমেলা, কলকাতা এখনও অনন্য। ইডেনের খেলা হোক বা যুবভারতীর মোহনবাগান–‌ইস্টবেঙ্গল— এই উন্মাদনা আর কোথায়!‌ একেকটা অলি গলিতে কত ইতিহাস। উত্তর কলকাতার রাস্তায় হাঁটলেই মনে হয়, এখানে হাঁটতেন রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, সারদামণির মতো কিংবদন্তিরা। সেই ইতিহাসও তো পর্যটনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা শুধু বেড়ানোর জায়গা নয়। কলকাতার পতাকাকে সারাদেশে আরও উজ্জ্বল রাখার স্মারক।

আসলে, আমাদের গর্বের মুকুটে এত পালক রয়ে গেছে, আমরা কখনও ভেবে দেখতেও শিখিনি। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর কি আমাদের চোখ খুলবে!‌ আমরা কি নিজের শহরকে হেঁটে দেখতে শিখব!‌ আরও ভাল করে চিনতে শিখব!‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.