মরচে পড়েনি, এখনও বেশ ধারালো টিনের তলোয়ার

সংহিতা বারুই

কত নতুন নাটক হচ্ছে। কত নাটক কালের নিয়মে হারিয়েও যাচ্ছে।
এখনই এমনটা হচ্ছে, এমন নয়। আগেও এমন অনেক নাটক এসেছে। ঝড় তুলেছে। হারিয়েও গেছে। কিন্তু কোনও কোনও নাটক বোধ হয় থেকে যায়। প্রেক্ষাগৃহ থেকে হারিয়ে গেলেও থেকে যায় স্মৃতিতে। থেকে যায় চিন্তায়-চেতনায়। সমকালীন নাটককে ঘিরে নানা বিতর্ক ওঠে ঠিকই। কিন্তু সেইসব আলোচনা একটা সময় থিথিয়ে যায়। কালজয়ী আবেদন না থাকলে বোধ হয় এভাবেই বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে যায়।

নাটকের এই শহরে কত দল, কত উপদল। কেউ নতুন নাটক নামাতে ব্যস্ত। কেউ আবার পুরানো গৌরবের দিনগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। তেমনই একটি গোষ্ঠী ডিঙা কলকাতা। যারা অতীতের প্রতি প্রণত থেকে ছুঁতে চায় নতুন সময়কে।

উৎপল দত্ত ঠিক কত বড় নাট্যকার ছিলেন ? এই প্রজন্ম সত্যিই দুর্ভাগা। তারা জানলই না, তারা কী হারাল। ‘স্বজন-আর স্বজন হারানোর’ শিরোনামেই তারা আটকে রইল। টিভিতে চলল চাপানোতর। না, শিশির ভাদুড়ি, উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, অজিতেশদের সময় কোনও টিভি শো ছিল না। কাগজে বিনোদনের আলাদা পাতাও ছিল না। আর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া সোশাল মিডিয়া তো ছিলই না। তাই সেই কাজগুলো তেমনভাবে সংরক্ষিতও নেই। কোনও কোনও প্রকাশক ‘নাট্য সমগ্র’ বের করে ঠিকই। কিন্তু মোটা ভলিউম দেখে হয়ত অনেকে দূরে সরে যায়।

???????????????????????????????

ডিঙা কলকাতাকে ধন্যবাদ। তাঁরা সেই হারিয়ে যাওয়া অতীতকে ফিরিয়ে আনছেন। এই প্রজন্ম কিংবদন্তি উৎপল দত্তর অভিনয় হয়ত দেখতে পেল না। কিন্তু নাট্যকার উৎপল দত্ত সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন, তার কিছুটা আভাস তো পাওয়া গেল। আসলে, ডিঙা কলকাতার পথচলা শুরুই হয়েছিল উৎপল দত্তর ‘টিনের তলোয়ার’দিয়ে। কালজয়ী এই নাটক যে এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক, তারই প্রমাণ পাওয়া গেল মধুসূদন মঞ্চে।
নাটকের পটভূমি সেই ঊনবিংশ শতাব্দী। উত্তর কলকাতার সেই থিয়েটার সংস্কৃতি। নিছক বিনোদন নয়, সেদিন থিয়েটারও যেন হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। ইংরেজদের আনা নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও কীভাবে গর্জে উঠেছিল গ্রেট বেঙ্গল অপেরা ?

যাঁরা উৎপল দত্তর ‘ঝড়’ দেখেছিলেন, তাঁরা নতুন করে চিনেছিলেন ডিরোজিওকে। এখানে ডিরোজিও হয়ত নেই, কিন্তু তার ছায়া থেকে গেছে। নাটক দলের নানা চড়াই উতরাইয়ের মাঝে আমাদের চোখের সামনে যেন ধরা দেয় সেই সময়। কোথাও কি এই সময়ের গন্ধও পাওয়া যায় না! নাট্য নিয়ন্ত্রণের নানা ফন্দি ফিকির কি এই সময়েও নেই! কদিন আগেই ‘নাট্য স্বজন’ ভেঙে যাওয়া আর সেই চাপানোতর কি সেটাই আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিল না!
???????????????????????????????

বাঙালির একটা বড্ড বদগুন। সে কথায় কথায় তুলনা টেনে বসে। হয়ত পি এল টি-র সঙ্গে ডিঙার তুলনা টেনে বসবে। হয়ত উৎপল দত্তর সঙ্গে পরিচালক দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুলনা টেনে বসবে। এই সব তুলনা থেকে বেরিয়ে এসে দেখুন। অরূপ লাহিড়ী, তপতী দাশগুপ্ত, শ্রাবণী দত্ত, কোয়েল চ্যাটার্জি, অরিজিৎ চ্যাটার্জি, দেবজ্যোতি সরকারদের অভিনয় ও উপস্থাপনাও মন কাড়বে। দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় ও নির্দেশনা স্বতন্ত্রতার দাবি রাখে। প্রচার ও জনসংযোগের দায়িত্বে ছিলেন কৌস্তুভ দাশগুপ্ত ও রূপা ঘোষ। মঞ্চসজ্জা, আলো, আবহ, মেক আপ- সবিমিলিয়ে ‘কমপ্লিট টিমওয়ার্ক’ বলতে যা বোঝায়, তাই।

শোনা যায়, উৎপল দত্ত খুব খুঁতখুঁতে মানুষ ছিলেন। কোনওকিছুএই নাকি তাঁর ঠিকঠাক পছন্দ হত না। তাঁক সাতের দশকের প্রযোজনা এই দু হাজার পনেরোয় মধুসূদন মঞ্চে দেখলে কী বলতেন ? খুব কি বিরক্ত হতেন ! মনে হয় না। হয়ত গ্রিনরুমে গিয়ে দেবব্রত-র পিঠ চাপড়ে দিয়ে আসতেন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.