সরল বিশ্বাস
উপনির্বাচনের ফল দেখে যথারীতি অনেকেই হতাশ। অনেকে ভেবেই নিয়েছিলেন, আরজি কর কাণ্ডের পর বামেরা হয়তো দু–একটা আসনে জিতে যাবে। আরও দু–একটা আসনে দ্বিতীয় হবে। অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ায় আশার বাণী দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছিল।
বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না। ২০১৯, ২০২১, ২০২৪ — তিনটি বড় মাপের নির্বাচনেই শূন্যতা কাটেনি। এত তাড়াতাড়ি সেই শূন্য দশা কেটে যাবে, এমন আশা না করাই ভাল। তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি— বিরাট অংশের মানুষ এখনও এই তত্ত্বেই বিশ্বাস করেন। তাঁদের ভাবনা ঠিক হোক, ভুল হোক, তাঁরা যে এমনটা ভাবছেন, এটা ঘটনা। এখনই বামের পালে হাওয়া লাগবে, এমন দুরাশা আমার অন্তত ছিল না।
বামেরা তাহলে কী করলে ঘুরে দাঁড়াবে? অনেকেই এমনটা জানতে চান। সত্যি কথা বলতে কী, এর চটজলদি কোনও সমাধান সূত্র নেই। তিন থেকে একধাক্কায় একে উঠে আসার নজির ভারতীয় রাজনীতিতে তেমন একটা নেই। মনে রাখতে হবে, ২০১১–তে মানুষ শুধু তৃণমূলকে আনেনি, বামেদের প্রত্যাখ্যানও করেছিল। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত একটা ক্ষোভ ব্যালট বাক্সে ঝড় তুলেছিল। তৃণমূলের ওপর কি ক্ষোভ তৈরি হয়নি? হয়তো আরও বেশি ক্ষোভ, আরও বেশিই মোহভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু এখনই তৃণমূলকে প্রত্যাখ্যানের জায়গায় আমজনতা আসেনি। কারণ, বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী শক্তিও সেভাবে উঠে আসেনি। আর উপনির্বাচনের ফল বেশিরভাগ সময় শাসকের দিকেই ঝুঁকে থাকে। এখনই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন নেই, ক্ষমতার হাতবদলের প্রশ্নও নেই। তাহলে খামোখা মানুষ এইসব শিবিরে ভিড়তে যাবেন কেন?
বলা হয়, বামেদের আরও রাস্তায় নামতে হবে। আন্দোলন করতে হবে। কিন্তু সেসব করতে তো বড় মাপের সংগঠন লাগে। মানুষকে একত্রিত করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু ছোট ছোট সামাজিক কাজ তো করা যায়। বামেরা কি সেইসব সামাজিক কাজে নিজেদের যুক্ত রাখছেন? এটা অনেক বেশি জরুরি। আচ্ছা, আপনি কাউকে রক্ত দিতে গেলে তৃণমূল বা পুলিশ নিশ্চয় বাধা দিতে আসবেন না। সারা জীবনে কজনকে রক্ত দিয়েছেন? শিবিরেই বা কবার দিয়েছেন? হাসপাতালে গিয়েই বা কজনকে দিয়েছেন। গোটা জেলা কমিটি ধরে যদি সমীক্ষা হয়, দেখা যাবে, অনেকে একবারও দেননি। অনেকে একবার, মেরেকেটে দু’বার। অথচ, পঞ্চাশ বছরের এক কর্মী বা নেতা চাইলে পঁচিশ থেকে তিরিশবার দিতে পারতেন। জেলা কমিটিতে এমন একজনকেও কি খুঁজে পাওয়া যাবে?
আত্মীয়দের জন্য বা শ্বশুরবাড়ির লোকের জন্য অনেককেই হাসপাতালে যেতে হয়। তার বাইরে! পাড়া পড়শি হোক বা বন্ধু, পার্টি কমরেড হোক বা পাশের গ্রামের মানুষ। এঁরা যখন হাসপাতালে ভর্তি থাকেন, আমরা কজন তাঁদের দেখতে যাই। কজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি? কেউ মারা গেলে গত দশ বছরে কবার শ্মশানে গেছি? যদিও বা যাই, কতক্ষণে ফেসবুকে সেই ছবি ছাড়ব, তার জন্য প্রাণ ছটপট করে। তারপর কটা লাইক আর কমেন্ট পড়ল, গুনতে থাকি।
অনেকে বলবেন, রেড ভলান্টিয়ারদের কথা। হ্যাঁ, করোনা কালে বাম ছাত্র যুবদের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয় ছিল। কিন্তু তার ধারাবাহিকতা আর রইল না। তাছাড়া, যাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ছবি ছাড়ার তাগিদটাও বেশ ভালমতোই লক্ষ্য করা গেছে। সত্যিকারের মানুষের পাশে থাকলে ঢাক পেটানো কি সত্যিই খুব জরুরি? মানুষকে জানান দেওয়া কি খুব জরুরি? এতে যাঁর পাশে দাঁড়ালেন, তাঁকে কি কোথাও ছোট করা হল না? তাঁর কৃতজ্ঞতা বিরক্তিতে বদলে গেল না তো?
কারও জন্য হাসপাতালে গেলে, তাঁর পরিবারের লোকেরা ঠিকই জানবেন। একসময় পাড়াপড়শিও জানবেন। এর জন্য চটজলদি ছবি আপলোড করার কোনও দরকার নেই। বরং তাতে হ্যাংলামিটাই আরও বেশি করে বেআব্রু হয়।
সব পাড়াতেই অনেক বয়ষ্ক মানুষ থাকেন। যাঁদের ছেলে হয়তো বাইরে থাকেন। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বুড়ো বুড়ি সারাদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আপনার চেনা জানার বৃত্তেও এমন মানুষের অভাব নেই। মাসে কবার এমন মানুষদের বাড়িতে যান! টুকটাক এটা–সেটা এনে দেওয়া, নিদেনপক্ষে তাঁদের গল্প শোনা— এটুকু তো করাই যায়। আমরা আদৌ করি কি?
সবাই সবকিছু বোঝে। কাউকে কিছু বোঝাতে যাবেন না। আপনি যেটা ফেসবুক দেখে জেনেছেন, সেই মানুষটা সেটা জেনেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। রাস্তায় নামা, গণ আন্দোলন গড়ে তোলা। এগুলো তো অনেক বড় ব্যাপার। আগে এই ছোট ছোট কাজগুলো শুরু হোক। শূন্যের গেরো এমনি এমনি কাটবে না। কাজটাও সেই শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে।