ড. অরিন্দম অধিকারী
তাঁর সমধুর বচন ও মানুষের প্রতি সহমর্মিতা তাঁর রাজনৈতিক সৌজন্যকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গোপসাগরের উত্তর সরকার উপকূলে পূর্ব ভারতের একটি ছোট্ট রাজ্য ওড়িশা। ‘কালাহান্ডি সিনড্রোম’ যেমন আছে, তেমনই ভুবনেশ্বরে ইনফোসিস স্পেশাল ইকনোমিক জোন আছে। উপকূল ঘেরা বালেশ্বর, ভদ্রক, জাজপুর, কেন্দ্রপাড়া জেলাগুলি ঘূর্ণিঝড়ে ফি বৎসর বিধ্বস্ত থাকে। প্রশ্ন করে নিজেদেরকে প্রকৃতির কাছে দাস না প্রভু। আবার করোনা নামক পৃথিবীব্যাপী এই ঝঞ্ঝার সামনে ওড়িশা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল।
অধিকাংশ ভারতবাসী ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর নামও হয়তো জানেন না। করোনা সময়ে টেলিভিশন বা জনসমক্ষে যত না মুখ দেখিয়েছেন, তার থেকে বেশি নীরবে নেপথ্যে করোনা মোকাবিলায় গোটা ওড়িশাতে প্রধান সেনাপতি ছিলেন নবীন পট্টনায়েক।
ওড়িশা উপকূলে বঙ্গোপসাগরের নোনা হাওয়ার জনবসতির কাছে ঘূর্ণিঝড় মানেই এক অভিশাপ। ১৯৯৯ এর সাইক্লোন বিধ্বস্ত সময়েই নবীনবাবু ওড়িশা সামলাতে এলেন। ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি আর ৪.৫ বিলিয়ণ আমেরিকান ডলারের ক্ষয়ক্ষতির পরেও ওড়িশা একদিন ঘুরে দাঁড়াবে, বুকে এই প্রত্যয় নিয়ে প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছিলেন ওড়িশার তখনকার নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। তারপর অনেক ঝড়ের মোকাবিলা করেছে ওড়িশার উপকূলের জেলাগুলি। কিন্তু ‘৯৯ এর সাইক্লোন এর শিক্ষা নিয়ে নবীন পট্টনায়েকের আধুনিকতায় গড়া গ্লোবাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট হালফিলের পিলিন, ফণির মতো ঘূর্ণিঝড়কে প্রতিহত করেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ ওড়িশা সরকারকে গ্লোবাল লিডার ঘোষণা করেছে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ও রিস্ক রিডাক্সনের জন্য।
অন্ধ্রপ্রদেশের বর্ডারে মালকানগিরি জেলার মাওবাদী সমস্যা নিরসনে ১৫১ বিচ্ছিন্ন গ্রামকে মূল জনপদের সাথে যুক্ত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা হল গুরুপ্রিয়া সেতু। তাই মালকানগিরির গুরুপ্রিয়া সেতু শুধু একটি ব্রীজ নয় এটি আত্মত্যাগের প্রতীক। কটক আর ঢেনাকালের দূরত্বকে মাত্র ১৬ কিলোমিটারে পরিণত করছে নবীন পট্টনায়েক সরকারের তৈরি করা মধুসূদন সেতু। একটা সময় ছিল ওড়িশার ক্রীড়া জগতে কোনরকম স্বীকৃতি ছিল না। নবীন পট্টনায়েক ক্রীড়া সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আনলেন বিপ্লব। উন্নত মানের কলিঙ্গ স্টেডিয়াম তৈরি করে উড়িষ্যা পুরুষদের হকি বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিল। অলিম্পিকে যুক্ত খেলা গুলিকে জনপ্রিয় করলেন। নতুন নতুন শিল্প তালুক গড়েছেন কলিঙ্গনগর, ঝাড়সুগুডা ও আঙ্গুলে। অ্যাপেলো, এমসের মত হাসপাতাল ছাড়াও ভুবনেশ্বরে গড়ে উঠেছে হাইটেক হসপিটাল। বারিপদা, বালেশ্বর, বালাঙ্গির, কোরাপুটে নবীন বাবু গড়েছেন সরকারি মেডিকেল কলেজ। আই আই এম সম্বলপুর, আই আই টি, ট্রিপল আই আই টি ভুবনেশ্বর তার সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। ঝাড়সুগুডা এয়ারপোর্ট তৈরির মাধ্যমে পশ্চিম ওড়িশায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এর রাস্তা তৈরি করেছিলেন নবীন পট্টনায়ক সরকার।
২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ব্যবসার সহজতর বান্ধব পরিবেশের জন্য ভারতের রাজ্যগুলিতে ওড়িশাকে সপ্তম স্থান দিয়েছে। ১৯৩৬–৩৭ এর ১.৭৭ কোটি টাকার বাজেট তাঁর আমলে ২০১৮ সালে পৌঁছেছিল ১২০০২৮ কোটি টাকায়। নবীন পট্টনায়েক ‘মেক ইন ওড়িশা’ কনক্লেভে ভারত ও জাপানের কর্পোরেটদের থেকে ৩০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছিলেন। গরিবের জন্য ১৭ লক্ষ পাকাবাড়ি তৈরি, অতিরিক্ত ১৭ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমিকে সেচের আওতায় এনে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা, ২২৫০০ কিমি নতুন গ্রামীণ রাস্তা আর ৬০০ নতুন ব্রিজ তৈরি করা, ৩০০ নতুন বাস পরিষেবার মাধ্যমে কটক, পুরী, ভুবনেশ্বরকে বিভিন্ন শহরের সঙ্গে যুক্ত করা, শিশু মৃত্যুর হার কমানো, গরিবের স্বাস্থ্য যোজনা কাজের মধ্য দিয়ে নবীন পট্টনায়েক বারবার আলোচনায় উঠে আসবেন। জ্যোতি বসু, পবন চামলিং এর পাশআপাশি তিনিও দীর্ঘদিনের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন। ওড়িশার মানুষের জন্য এত কিছু করার পরও মানুষ তাঁকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। ওড়িয়া ভাষা না জেনেও ওড়িয়াদের হৃদয়ে তিনি থেকে যাবেন বহুদিন।