রক্তিম মিত্র
বেশ কেকদিন আগের কথা। অন্তত দিন কুড়ি তো হবেই। হঠাৎ একটি অডিও ছড়িয়ে গেল। যেখানে শোনা যাচ্ছে, একজন অন্যজনকে বলছেন, ‘কবীর আমি খুব চাপে আছি। তুমি টিকিটটা নাও।’ অন্যদিক থেকে বলা হল, ‘একটু সমস্যা আছে।’ কথাগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। শেষে বলতে শোনা গেল, ‘সুকান্ত যেন জানতে না পারে।’
কার সঙ্গে কার কথোপকথন? একটা নাম শোনা গেল, কবীর। তাঁকে একজন টিকিট নিতে বলছেন। তিনি নাকি খুব চাপে আছেন। তিনি আসলে কে? জল্পনা ছড়িয়েছিল, তিনি কল্যাণ ব্যানার্জি। শ্রীরামপুরের তিনবারের তৃণমূল সাংসদ। যাঁরা সামান্য হলেও কল্যাণ ব্যানার্জির গলার আওয়াজ চেনেন, তাঁদের মনে হতেই পারে এটা কল্যাণেরই গলা।
কিন্তু এমন একটা অডিও টের ফাঁস হওয়ার পর কে আর নিজের মুখে স্বীকার করে! কল্যাণ ব্যানার্জিও করেননি। যা বলার, সেটাই বলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নাকি চক্রান্ত হচ্ছে। তাঁর ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা। তিনি নাকি পুলিশ সুপারকে বলেছেন, দ্রুত তদন্ত করে বের করতে। কোথা থেকে এটা ছড়াল, খুঁজে বের করতে।
নারদের ভিডিও সামনে আসার পরেও তৃণমূলের বিরাট অংশের দাবি ছিল, ওটা ফেক ভিডিও। এমনকী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো অনায়াসে বলেছিলেন, ওটা ফেক ভিডিও। যদিও পরবর্তীকালে ভয়েস স্যাম্পল টেস্টে দেখা গেল, ভিডিওটা নকল নয়। এমনকী পরবর্তীকালে অভিযুক্তদের অনেকেই প্রকারান্তরে স্বীকার করেই নিয়েছেন যে, ওটা আসল ভিডিওই ছিল। অর্থাৎ, জেনে হোক বা না জেনে হোক, মুখ্যমন্ত্রী ডাঁহা মিথ্যে বলেছিলেন, এটা প্রমাণিত। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর ‘সত্যবচন’ এর সুনাম এতটাই যে, তাঁর মিথ্যে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
যাক, আবার কীর্র্তিমান কল্যাণের কথাতেই আসা যাক। তিনি নাকি এসপি–কে বলেছিলেন, খুঁজে বের করতে। সত্যিই যদি চক্রান্ত হত, সত্যিই যদি গলাটা তাঁর না হত, এতদিনে পুলিশ ঘটা করে প্রেস কনফারেন্স করে বসত। তিনি নিজেও প্রেস কনফারেন্স করে ফেলতেন। কিন্তু এই কুড়ি দিনে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। হয় পুলিশ খুঁজে বের করতে পারেনি। অথবা, বুঝতে পেরে নিজেরাই চেপে গেছে। এখন যা প্রযুক্তির অবস্থা, পুলিশের খুঁজে বের করলে একদিনের বেশি লাগার কথা নয়।
এই তদন্ত তো আর সিবিআই বা ইডি করছে না। করছে মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্য পুলিশ। এখনও তারা খুঁজে পেল না। এই ব্যর্থতার দায় তাহলে কার? সত্যিই যদি তাঁর গলা না হত, এতক্ষণে কল্যাণ তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিতেন। আসলে, কল্যাণ নিজে বেশ ভাল করেই জানেন, গলাটা কার।
কল্যাণবাবু আইনজীবী। বলতেই পারেন, কী প্রমাণ আছে? প্রমাণ জোগাড় করা যাঁদের দায়িত্ব, এই রাজ্যে তাঁরা ব্যস্ত থাকেন প্রমাণ লোপাটের কাজে। তাই প্রমাণ থাকার কথাও নয়। কুড়িদিন হয়ে গেল। পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাহলে ঘোষণা করুক, ওই গলাটা কল্যাণ ব্যানার্জির নয়। নইলে, ধরে নিতেই হবে ওটা কল্যাণের গলা।
তাহলেই ভাবুন, তাঁর বিরুদ্ধে কে টিকিট পাবেন, তিনি নিজেই ঠিক করে দিচ্ছেন। এমন একটা অভিযোগ গতবারেও উঠেছিল। কারণ, গতবারও তাঁর এই প্রাক্তন জামাই বাবাজীবনই প্রার্থী হয়েছিলেন। মোদ্দা কথা হল, কেন্দ্রীয় বিজেপির সঙ্গে কল্যাণের বোঝাপড়া ঠিক কেমন, সেটা পরিষ্কার করে দিল সেই অডিও ক্লিপ। হ্যাঁ, ওটা কল্যাণেরই গলা এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেটা যদি এখনও প্রমাণ না হয়ে থাকে, তাহলে সেটা মুখ্যমন্ত্রী আর পুলিশের ব্যর্থতা।
বোঝাপড়াটা পরিষ্কার, এমন একজনকে প্রার্থী করা হোক, যেন কল্যাণের জয়টা মসৃণ হয়। কাউকে কাউকে যে এভাবেই ওয়াক ওভার দেওয়া হচ্ছে, সেটা অন্তত ডায়মন্ড হারবারে পরিষ্কার। কী ভাবছেন, এই কল্যাণ টিকিট না পেলে তৃণমূলে থাকতেন? কোনও চান্স নেই। বিজেপিতে ঝাঁপ দিতে একদিনও লাগত না। নিজে তৃণমূলের টিকিট পেলেন, এবার জামাইকে পাঠিয়ে দিলেন বিজেপির শিবিরে।
আচ্ছা, এটা কল্যাণের কাছে যতটা বিড়ম্বনার, বিজেপির কাছেও তো ততটাই বিড়ম্বনার। তারাই বা আলাদা করে তদন্ত করল না কেন? ঠিকঠাক তদন্ত হলে কল্যাণের যেমন বিড়ম্বনার শেষ থাকত না, তেমনই বিজেপিরও বিড়ম্বনার শেষ থাকত না। অতএব, ধামাচাপা থাকলেই উভয়ের মঙ্গল।