দলের কাছেই তিনি কতটা অবাঞ্ছিত, অভিষেক যদি বুঝতেন!‌

রক্তিম মিত্র

মাস খানেক আগে থেকে তিনি হুঙ্কার দিয়ে চলেছেন, এবার আর কোনও বুথে জবরদস্তি চলবে না। সবাইকে প্রার্থী দিতে দিতে হবে। যদি কেউ প্রার্থী দিতে না পারেন, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমি নমিনেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।

এই হুঙ্কার যিনি ছেড়েছিলেন, তাঁর নাম অভিষেক ব্যানার্জি। পোশাকি দু–‌একটা পরিচয় আছে। ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু এই পরিচয়গুলো নেহাতই গৌণ। আসল কথা, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো। পুলিশ থেকে প্রশাসন তাঁর কথায় ওঠে–‌বসে। সেই কারণেই তিনি হুঙ্কার ঝাড়েন।

আই প্যাকের গ্যাস বেলুনে চড়ে যতই উড়ুন, যতই নিজেকে প্রোমোট করুন, তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা যে একেবারেই তলানিতে, তিনি নিজেই বারবার তা প্রমাণ করেছেন। তাই হুঙ্কার ঝাড়েন। কদিন পরেই সেটা গিলতে হয়। আসলে, গাল বাড়িয়ে থাপ্পড় খেতে হয়। তার পরেও শিক্ষা হয় না।

উদাহরণ বাড়াতে চাইলে অনেক বাড়ানো যায়। পঞ্চায়েতের আবহে একেবারে সাম্প্রতিক কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। কয়েক মাস আগে থেকেই হুঙ্কার ঝাড়ছেন, এবার আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা চলবে না। ভোটে জিতে আসতে হবে।

অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি বোধ হয় শুধরে গেলেন। কিন্তু সারমেয়র লেজ একবার বেঁকলে তা সোজা হওয়া বড্ড কঠিন। গোটা বাংলা খোঁজার দরকার নেই। তিনি যে এলাকার সাংসদ, সেই ডায়মন্ড হারবারে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ৪৭ শতাংশ আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেননি। অর্থাৎ, তাঁর নিজের এলাকায় অর্ধেকের বেশি মানুষ গ্রাম পঞ্চায়েতে ভোটই দিতে পারবেন না। ভোটের দিন সেই সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, কে জানে!‌

তিনি কি সত্যিই চেয়েছিলেন এবার ভোট হোক?‌ যদি সত্যিই চেয়ে থাকেন, নিজের লোকসভা কেন্দ্রে সেটা করে দেখাতে পারলেন না কেন?‌ যদি সত্যি চেয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হবে, তাঁর নিচুতলার কর্মীরা তাঁর কথাকে পাত্তাই দেয়নি। তাঁরা জানেন, লোকসভায় কীভাবে ভোট হয়েছে। এই ভোট লুঠ তাঁদেরই করতে হয়েছে। তাঁরা অন্যের জন্য ভোট লুঠ করবেন, নিজেদের সময় শান্তির বাণী শুনবেন কেন?‌ নিজের এলাকায়, নিজের কর্মীদের কাছে এমন ঠাসিয়ে থাপ্পড় খাওয়ার পর কোন মুখ নিয়ে গোটা বাংলায় সভা করতে যান!‌ যাঁর নিজের এলাকায় শান্তিতে ভোট করানোর মুরোদ নেই, তিনি গোটা বাংলার দায়িত্ব নিতে গেলেন কোন লজ্জায়!‌

এবার তিনি বলে বসলেন, যাঁদের নাম ঘোষণা হবে, তাঁরাই প্রার্থী। তাঁদেরকেই মেনে নিতে হবে। যাঁরা মেনে নেবেন না, তাঁদের বহিষ্কার করা হবে। দেখা গেল, এই হুঙ্কারও টিকল না। বিভিন্ন ব্লকে বিক্ষোভ হল। বাধ্য হয়ে ঢোক গিলতে হল। চুপি চুপি অনেক জায়গায় প্রার্থী বদলে গেল। যিনি ছিলেন বিদ্রোহী নির্দল, তিনি হয়ে গেলেন দলের ঘোষিত প্রার্থী। আর যিনি ছিলেন ঘোষিত প্রার্থী, রেগে মেগে তিনি হয়ে গেলেন ‘‌নির্দল’‌। অর্থাৎ, এক্ষেত্রেও তাঁর হুমকি টিকল না। গাল বাড়িয়ে আরেকটা থাপ্পড় খেতে হল।

এবার তিনি ঘোষণা করলেন, যাঁরা নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের দল কোনওদিনই ফেরত নেবে না। এটাও ব্যুমেরাং হতে বাধ্য। খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। বোর্ড গঠনের আগেই কত নির্দল যে ‘‌উন্নয়নে সামিল হতে’‌ মূলস্রোতে ফিরতে চাইবেন, গুনে শেষ করা যাবে না। যেখানেই বোর্ড গঠনে জটিলতা হবে, সেখানেই এই নির্দলদের নিয়ে টানাটানি হবে। যাঁরা স্বেচ্ছায় আসতে চাইবেন না, তাঁদের লোভ দেখানো হবে, তাতেও না হলে ভয় দেখানো হবে। তাতেও কাজ না হলে পুলিশ দিয়ে তুলে আনা হবে। অপহরণ করা হবে, মিথ্যে মামলা দেওয়া হবে। সবগুলোই হবে। হতে বাধ্য। তিনি বারণ করলেও কেউ শুনবে না। কারণ, নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে এমন তলানিতে নামিয়েছেন, তৃণমূলেরই কেউ তাঁকে বিশ্বাস করে না। তিনি যতই হুঙ্কার ঝাড়ুন, নিচুতলার কর্মীরা পাত্তাই দেয় না। কারণ, তিনি যে ‘‌সুবোধ বালক’‌ হতে চাইছেন, এটাই কেউ বিশ্বাস করে না।

দলের লোকের কাছেই তিনি যে কতটা অবাঞ্ছিত, এর পরেও তিনি বুঝবেন না। ‌

Share