উত্তম আর হেমন্ত যেন এক যুগলবন্দি। কিন্তু এমন অনেক গান আছে, যে ছবিতে উত্তম আছেন, কিন্তু হেমন্তর গান অন্য কারও লিপে। কোথাও উত্তম শ্রোতা। আবার কোথাও গান বাজছে নেপথ্যে। এমনই এক অন্যরকম যুগলবন্দির কাহিনি তুলে ধরলেন পৃথা কুণ্ডু।
পূর্বস্মৃতি হারানো স্বামীর বাড়িতে এসেছেন এক নারী। নিজের মর্যাদা, অবস্থান, অহং বিসর্জন দিয়ে গভর্নেসের কাজ নিয়েছেন – স্বামীর কাছাকাছি থাকবেন বলে। অথচ স্বামী তাঁকে চিনতে পারেন না, তাঁর নিরুচ্চার ভালবাসায় ভরা উদ্বেগকে দূরে ঠেলে দেন – ‘কৌতূহল থাকা ভাল, কিন্তু কৌতূহলের একটা সীমারেখা থাকা দরকার।’ ভদ্রলোক অবশ্য বোঝেন, চাকরি করতে আসা এই মহিলা বিবাহিতা। তাই পরে যখন তিনি জানতে চান ভদ্রমহিলার স্বামীর কথা, উত্তর আসে, ‘আমার স্বামী আমাকে ভুলে গেছেন!’ এ উত্তর যেন একটু ভাবিয়ে তোলে ভদ্রলোককে। একলা ঘরে তাঁর ভাবনার সঙ্গী হয় রেডিও থেকে ভেসে আসা একটি গান – ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে।’
সাদাকালো পর্দার মায়ায় আর সেই মায়াবী কণ্ঠের আবেশে একসময় মজেছিল আম-বাঙালি, আজও সে আবেশ একেবারে হারিয়ে যায়নি। কিন্তু ‘হারানো সুর’ ছবির এই গানটির জনপ্রিয়তার আবেগে কেবল না ভেসে আমরা কি ভেবেছি, কতটা ব্যতিক্রমী ছিল এই গানের প্রয়োগ? গানটি পুরুষকণ্ঠে। ঘরের মধ্যে বসে শুনছেন আর এক পুরুষ, যাঁর ঠোঁটে এর আগে ওই কণ্ঠেরই গান প্রভূত সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু এখানে গানটি তাঁর নয় – ‘এই শপথের মালা খুলে/আমারে গেছ যে ভুলে/তোমারেই শুধু দেখি বারে বারে আজ শুধু দূরে থেকে।’ আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের কথা তো তাঁদেরই মানায়, সব জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য করেও যাঁদের কল্যাণী মূর্তিতে আড়ালে থাকতে হয় ‘নিজেরে লুকায়ে রেখে’। অন্যভাবে বলতে গেলে –গানটি যেন উত্তমের উদ্দেশে হেমন্ত গাইছেন সুচিত্রার হয়ে! শোনা যায়, ছবিতে এই গানটি রাখার জন্য গায়ক-সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হয়েছিল পরিচালক এবং নায়ক-প্রযোজকের যথেষ্ট আপত্তি সত্ত্বেও। আমরা সবাই জানি – কতখানি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল এই গানটি ছবির সাফল্যের ক্ষেত্রে।
এ এক ভিন্নধারার ‘যুগলবন্দি’র আখ্যান – উত্তমের সাথেই আছেন হেমন্ত, কিন্তু তাঁর ঠোঁটে গান গাইছেন না। এমন উদাহরণ কিন্তু কম নয় এই জুটির সহাবস্থানের ইতিহাসে। ‘বউঠাকুরানীর হাট’ (১৯৫৩) ছবিতে দেখা যায়, বন্দি রাজপুত্রের চরিত্রে উত্তম ধনঞ্জয় বৈরাগীর কণ্ঠে হেমন্তর গান শুনে কাঁদছেন। এটি তাঁর প্রথম দিককার ছবি। খেয়াল করলে বোঝা যাবে, অন্যান্য দৃশ্যের তুলনায় এই চোখের জল ফেলার দৃশ্যে তাঁর অভিনয় অনেক পরিণত – সে কৃতিত্বের ভাগীদার কি গায়কও নন? আবার নৌকায় বসে বৈরাগীর মুখে ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ শুনে তিনি বোনকে বলছেন – ‘ডাকতে হয় না রে, দরকার হলে উনি নিজেই আসেন’। এ ছবিতেও উত্তমের সাথেই আছেন হেমন্ত, কিন্তু তাঁর মুখের গানে নন – বরং জড়িয়ে আছেন, ছড়িয়ে আছেন ছবি জুড়ে।
‘সূর্যতোরণ’ ছবিতে ‘ওরা তোদের গায়ে মারবে লাথি’ যেন নায়কের প্রতিবাদী সত্তার সমর্থনেই কথা বলছে, কিন্তু গানটি গাইছে এক পথ-অভিনেতা। আবার উত্তম যখন সুচিত্রার গাড়ি চালাচ্ছেন, তাঁর অব্যক্ত প্রেমকে ভাষা দিচ্ছে গাড়ির মিউজিক সিস্টেম থেকে ভেসে আসা হেমন্তর গান – ‘তুমি তো জানো না।’ এ ছবিতে অন্য একটি গান অবশ্য উত্তমের মুখেই, ‘হোক না আকাশ মেঘলা’। ‘দুই ভাই’ ছবিতে উত্তমের লিপে দুটি গান গেয়েছেন হেমন্ত, বাকিগুলি বিশ্বজিতের লিপে, উত্তম শ্রোতা। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এ গানগুলো গাইছেন ‘ছড়িদার’ অনিল চট্টোপাধ্যায়। পাগলের ভূমিকায় উত্তমকুমারের মনের গ্লানি কিন্তু অনেকটা প্রকাশ পায় অনিলের গানে গানে। ‘সূর্যতপা’ ছবিতে জহর রায়ের লিপে ‘কে যাবে কে যাবে’ গানটি হেমন্ত গাইছেন একান্তই ‘খোকাবাবু’র জন্য, তবে ‘সব কিছু বোঝান কি যায়’ গানটির শ্রোতা উত্তম, সঙ্গে সন্ধ্যা রায়। ‘ধন্যি মেয়ে’র গান দুটির ক্ষেত্রেও উত্তম সরাসরি শ্রোতার ভূমিকায় নেই।
‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ছবিতেও প্রথম গানটি বাউলের কণ্ঠে – ‘তার অন্ত নাই গো’। রাইচরণরূপী উত্তমের মুখে তাঁর কোন গান নেই। কিন্তু উত্তমের অভিনয়ের সঙ্গতে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটিতে অসাধারণ আবহ রচনা করেছেন হেমন্ত। খোকাবাবুকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে রাইচরণ। ছবিতে এই দৃশ্যটি প্রায় ছ মিনিটের – দু-তিনবার ‘খোকাবাবু’ বলে ডাকা ছাড়া আর কোন সংলাপ নেই। আবহে সঙ্গীত পরিচালক ক্রমাগত বাজাচ্ছেন তারসপ্তকে বাঁধা বেহালা, বেদনার অভিব্যক্তির সঙ্গে ‘কি হয় কি হয়’ ভাব ফুটছে তাতে। এমনই অমোঘ সেই স্বরপ্রয়োগ – যে এতক্ষণ ধরে শুনতে একটুও একঘেয়ে লাগে না। তারপর যখন পাড় ভাঙছে উত্তাল নদীর ঢেউ, রাইচরণ বুঝতে পারছে যে খোকা তলিয়ে গেছে, তখন ওই আবহের সুরটিকেই নিজের গলায় তুলে আনেন হেমন্ত – সব হারিয়েও কেবল সুরসম্বল এক হাহাকারের মত শোনায় তাঁর কণ্ঠে চড়া পর্দায় ‘ম – গ ম গ র স’ হয়ে মধ্য সপ্তকে ‘ণ ধ প গ ম গ’…সেই সঙ্গে রাইচরণের মুখে রিক্ততার অভিব্যক্তি মিলে যায় মর্মস্পর্শী দৃশ্যায়নে।
‘কমললতা’ ছবিতে শ্রীকান্তের (উত্তমকুমার) মুখে হেমন্তর গান নেই, এমনকি আর এক প্রধান চরিত্র গহর মিয়াঁর (নির্মলকুমার) মুখেও গেয়েছেন শ্যামল মিত্র। হেমন্তের গানগুলি রাখা হয়েছে এক ‘খ্যাপা গোঁসাই’-এর মুখে। আপনভোলা মানুষ, তাঁকে দেখা যায় খুব কম; অথচ তাঁর গাওয়া কীর্তনের সুর সর্বত্র ভেসে বেড়ায়। বৈষ্ণব আখড়ার আপন-করা, প্রেমমাখা পরিবেশ যেন মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর গানে গানে। ‘ভজহুঁ রে মন’, ‘বনসন আওত নন্দদুলাল’, ‘নব বৃন্দাবন নব নব তরুগণ’, ‘এই না মাধবীতলে’ – গানগুলো ছাড়া কমললতার আখড়া ভাবা যায়? নেপথ্যে ‘দেখ সখি সাজিল নন্দকুমার’ গানটির অনুষঙ্গে শ্রীকান্ত আর কমললতা রাধাকৃষ্ণের জন্য মালা গেঁথে পরস্পরের দিকে তাকায় – তৈরি হয় এক মরমিয়া দৃশ্যপট। আবহে সেই এক ও অদ্বিতীয় হেমন্ত।
‘স্ত্রী’ ছবিতে উত্তমের লিপে গাইলেন মান্না দে, আর সৌমিত্রের লিপে হেমন্ত। ততদিনে নানা কারণে ঘটে গেছে উত্তম-হেমন্তর মধুর সম্পর্কে কিছু অনভিপ্রেত কালিমাপাত। কেন জানি না এক আশ্চর্য সমাপতনের মতই মনে হয় এ ছবিতে হেমন্তর গাওয়া গানগুলির অন্তর্নিহিত বক্তব্য – বিশেষ করে জবাবি গানদুটি যেন উত্তমের অভিনীত চরিত্রটির উদ্দেশেই গাওয়া – ‘কালো আমার ভাল লাগে না’, আর ‘রাজা, যে টাকাটা মারছ ছুঁড়ে’।
অ্যাণ্টনি ফিরিঙ্গি বললে উত্তমের কথাই মনে পড়ে। কিন্তু উত্তম যখন ভোলা ময়রার চরিত্রে, অ্যাণ্টনির ভূমিকায় তখন বিশ্বজিৎ, আর তাঁর গলায় গেয়েছেন হেমন্ত। ছবির নাম ‘ভোলা ময়রা’। ‘ধনরাজ তামাং’ ছবিতে আবার পাই অন্য ধরনের যুগলবন্দি – হেমন্তকণ্ঠে ‘ধনরাজ তামাং একটি শুধু নাম’ গানটিও নামভূমিকায় থাকা মানুষটিকে পাহাড়ি উপকথার সঙ্গে একাকার করে দেয় নেপথ্যের সুরবিস্তারে।
এর পাশাপাশি মনে পড়বে ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিতে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। গানটি যখন পর্দায় এল, বয়স্ক নায়ককে দেখতে আসা পুরনো বন্ধুদের মত দর্শকও নতুন করে ভাবতে বসল – বাইরে থেকে কড়া মেজাজি, বেপরোয়া, বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ডাক্তারবাবুর মধ্যে অসহায় বিপত্নীকের প্রাণ এমন করে লুকিয়ে ছিল! পর্দায় গানটি গাইছেন অসীমকুমার। অথচ এ গানের অভিব্যক্তির পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে উত্তম-অভিনীত চরিত্রটির এক গোপন গভীর দিক।
এ ছবিতে আর একটি গানের প্রয়োগও অভিনব। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ দেশাত্মবোধক দ্বিজেন্দ্রগীতি হিসেবেই প্রচলিত। কিন্তু এখানে ডাক্তার অগ্নীশ্বরের দেশভ্রমণ আর নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সূত্রে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে ওঠা – এক খাঁটি, উন্নত চরিত্রের দেশপ্রেমিক, সেবাব্রতীর চোখ দিয়ে দেশকে দেখার অনুভূতি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই গানের অবিস্মরণীয় গায়নে। শেষ দৃশ্যে ডাক্তারের হাত কেঁপে ফুলগুলো পড়ে যাওয়া, উঠোনে লোকের ভিড়, তারপর পর্দা জুড়ে চিতা জ্বলে ওঠা – সবকিছুর সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মানিয়ে যায় গানটির শেষ স্তবক – ‘ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি / আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি’। সৌজন্যে সেই অনুপম কণ্ঠ – যার আবেদনে মৃত্যু হয়ে ওঠে অমৃত। উত্তমের অনবদ্য অভিনয় যদি এই অন্তিমদৃশ্যটির শরীর, তবে হেমন্তর গান তার আত্মা। প্রায় একই কথা বলা যায় ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবির ‘যাই চলে যাই’ প্রসঙ্গে। এ ছবির নায়ক তথা সুরকার ছিলেন উত্তম কুমার। ভাঙা সম্পর্ক ততদিনে আবার জোড়া লেগেছে কিছুটা – ‘ছোট ভাই’-এর সুরে গান গাইতে সানন্দেই রাজি হয়েছিলেন হেমন্ত। উত্তমের মুখে নয়, কিন্তু একটি মৃত্যুদৃশ্যের আবহ হিসেবে তাঁর অভিনয়ের সঙ্গে এক অবিস্মরণীয় যুগলবন্দি রচনা করেছে এই গান। এবং, ‘হারানো সুর’-এর মতো এই গানটিও এক প্রয়াতা নারীর (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) বিদায়বাণী।
উত্তমকুমারের প্রয়াণের পর একটি অনবদ্য স্মৃতিচারণা–সহ গানের ডালি সাজিয়ে দিয়েছিলেন হেমন্ত – সেটি এইচএমভি-র রেকর্ডে, ক্যাসেটে অনেক উত্তম-হেমন্ত অনুরাগীই সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন। তার শেষ গান ছিল ‘চৌরঙ্গী’ ছবির ‘কাছে রবে, কাছে রবে’ – খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে এই লেখার উপসংহারে এসে। পর্দায় গানটি গেয়েছেন বিশ্বজিৎ – কিন্তু এ গান যেন উত্তমের উদ্দেশেই গাইছেন হেমন্ত। দুই মহাব্যক্তিত্বের শেষ হয়েও শেষ-না-হওয়া সম্পর্কের চিরায়ত অভিজ্ঞান আর কী-ই বা হতে পারে!
কৃতজ্ঞতা : অধ্যাপক প্রদোষ ভট্টাচার্য