গানের মতোই মানুষটাও ছিলেন সোজাসাপটা

অমিত দাশগুপ্ত

জীবনের অনেকটা সময়ই কেটেছে মুম্বইয়ে। অনেকদিন ধরেই শিল্পীদের সঙ্গে মিশছি। সেই হেমন্তবাবু–মান্নাবাবুদের সময় যেমন দেখেছি, তেমনি এখনকার শোনু নিগম, কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, শ্রেয়া ঘোষালদেরও দেখছি। সবাই হেমন্তবাবুকে কতখানি শ্রদ্ধার চোখে দেখেন, সেটাও দেখেছি। প্রত্যেকেরই অভিনবত্ব আছে। কাউকে ছোট করার জন্য এই লেখা নয়। কিন্তু সবাইকে মনে রেখেও বলতে পারি, মানুষ হিসেবে হেমন্তবাবু সত্যিই এক বনস্পতি। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ওই মাপের মানুষ আর দেখিনি।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কিছু বলতে গেলে রাতের পর রাত ফুরিয়ে যাবে। দীর্ঘদিন এরকম এক বটবৃক্ষের ছায়ার তলায় কাটিয়েছি। অনেকটাই কাছ থেকে দেখা। কিছুটা তাঁর মুখ থেকে শোনা। আবার কিছুটা অন্যান্যদের কাছ থেকে শোনা। তিনি গায়ক হিসেবে কেমন, সুরকার হিসেবে কেমন, এটা আমার বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালিমাত্রই সেটা জানেন। প্রত্যেকে নিজের মতো করে জানেন। শুধু বাঙালি কেন, ভারতের সঙ্গীতপ্রেমী মানুষমাত্রই জানেন।  সংক্ষিপ্ত পরিসরে মানুষটার কয়েকটা দিক তুলে ধরতে চাই। নির্দিষ্টভাবে শুধু গান, সুর, ছবি নয়। সবমিলিয়ে মানুষটা কেমন, তার কিছু টুকরো টুকরো ছবি বরং তুলে ধরা যাক।
১) হেমন্তবাবুর গায়কি যেমন, সুর করার সময় সেই ধারাটাই বজায় রাখতেন। জোর করে নিজের কেরামতি দেখানোর চেষ্টাই করতেন না। তিনি বারবার বলতেন, উচ্চমার্গের সঙ্গীত শিক্ষা তাঁর নেই। কোনও ওস্তাদের কাছে তালিম নেননি। অন্যান্য গাইয়েরা যেমন তাল, রাগ নিয়ে আলোচনা করেন, হেমন্তবাবুকে তার ধারপাশ দিয়েও যেতে দেখিনি। পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়েও খুব একটা আলোচনা করতেন না। গানটা তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। তিনি জানতেন, ফিল্মের একটা গান মানে আড়াই থেকে তিন মিনিটের ব্যাপার। তা যেমন মানুষের মনকে নাড়া দেয়। সেখানে নিজের গলার কাজ দেখানো বা পাণ্ডিত্য দেখানো উচিত নয়। এটা নিজের মুন্সিয়ানা দেখানোর জায়গা নয়। তাই মানুষের কাছে যেন গ্রহণযোগ্য হয়, বরাবর সেদিকেই নজর দিয়েছেন।

২) গান মানেই ধরে নেওয়া হয়, অন্তমিল থাকবে। কিন্তু হেমন্তবাবু এমন অনেক গানে সুর করেছেন, যার কোনও অন্তমিল নেই। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। চলে যেতে যেতে/দিন বলে যায়/আঁধারের শেষে ভোর হবে/ হয়ত পাখি গানে গানে/ তবুও কেন মন উদাস হল।’ কোথাও কোনও অন্তমিল খুঁজে পাচ্ছেন। এমনকী অন্তরা বা সঞ্চারিতেও কোনও অন্ত মিলের ব্যাপার নেই। আপনারা যখন শোনেন, তখন একবারও কি বেমানান মনে হয়! আর দশটা জনপ্রিয় গানের সঙ্গে কোথাও তফাত খুঁজে পান! এই হলেন হেমন্তবাবু। একটা গদ্যকেও অনায়াসে সুর দিতে পারেন। শ্রতিমধুর করে তুলতে পারেন।

hemanta5

৩)‌ হেমন্তবাবুর যে সমস্ত বিখ্যাত গান আমরা শুনেছি, তার প্রায় আশিভাগ গানের মুখরা তিনিই করেছেন। অর্থাৎ, প্রথম একটা–‌দুটো লাইন ধরিয়ে দিতেন। তারপর গীতিকার লিখতেন। যেমন ধরা যাক, এই রাত তোমার আমার। উনি প্রথম লাইনটা বলে দিলেন। তারপর বাকিটা লেখা হল। এভাবেই জন্ম নিয়েছে একের পর এক বিখ্যাত গান। গীতিকাররা সেটা মেনেও নিতেন। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল। যেমন সলিল চৌধুরি। তিনি আবার নিজের কথা বদল করতেন না। এমনকী, দাঁড়ি, কমা বদল করলেও পছন্দ করতেন না।

৪) মুম্বইয়ের একটা মজার ঘটনা বলি। গল্পটা হেমন্তবাবুর কাছ থেকেই শোনা। বিআর চোপড়ার ছবি। সম্ভবত ‘‌এক হি রাস্তা’‌। সুরকার হেমন্তবাবু। সবকটা গান তৈরি। সবাই খুশি। একটা গান নিয়ে আপত্তি জানালেন ডান্স ডিরেক্টর ঝান্ডে খাঁ। তাঁর দাবি, এই গানের সঙ্গে নাচের দৃশ্য মানানসই হবে না। পরিচালক হেমন্তবাবুকে বললেন, এই গানটা বদলাতে হবে। কারণটাও বললেন। হেমন্তবাবু কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ঠিক আছে, দু তিনদিনের মধ্যেই বদলে দেব। তবে, আমারও একটা শর্ত আছে। আমিও শুটিং দেখব। যদি মনে হয়, গানের সঙ্গে নাচটা উপযুক্ত হচ্ছে না, তাহলে আবার শুট করতে হবে। বি আর চোপড়া পড়লেন মহা সমস্যায়। তিনি ঝান্ডে খাঁকে বললেন, খাঁ সাহেব, আপনি এই গানেই করতে পারেন তো করুন। নইলে আমি অন্য ডান্স ডিরেক্টর খুঁজে নেব। ঝান্ডে খাঁর বক্তব্য ছিল, উনি গানের লোক, উনি নাচের কী বোঝেন!‌ হেমন্তবাবুর যুক্তি ছিল, উনি নাচের লোক হয়ে যদি গান বদল করতে বলতে পারেন, তাহলে আমি গানের লোক হয়ে নাচ বদল করতে বলতেই পারি।

৫)‌ স্বর্ণযুগ থেকে এই সময়। অসংখ্য শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছি। প্রায় সবাইকেই বলতে শুনেছি, আমার যা প্রাপ্য ছিল, তা পাইনি। হেমন্তবাবু সেখানে ব্যতিক্রম। তিনি বারবার বলতেন, আমার যা প্রাপ্য, তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছি। আমি কে?‌ ভাল করে গান শিখিওনি। তারপরেও লোকে এতবছর ধরে আমার গান শুনছেন, এটাই বিরাট এক পাওনা। এর থেকে বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে!‌

৬)‌ তাঁর গানের মতোই মানুষটাও ছিলেন একেবারে সোজাসাপটা। কোনও ভনিতা ছিল না। যেটা ভাল, সেটা প্রাণ খুলে প্রশংসা করতেন। যেটা ভাল লাগল না, সেটাও সামনেই বলতেন। সবথেকে বড় কথা, নিজের লিমিটেশন জানতেন। সেটা নিজের মুখে স্বীকার করতেও দ্বিধা করতেন না। আমার গানের ক্ষেত্রেও হয়েছে। হয়ত কোনও গান নিয়ে গেছি। উনি শুনে বলতেন, সুরটা খুবই ভাল হয়েছে। কিন্তু আমার গলায় এটা মানাবে না।

৭)‌ কখনও কোনও শিল্পীর সমালোচনা করতে শুনিনি। প্রত্যেকের সম্পর্কেই ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। নতুনদের প্রশংসা করতেন দরাজ কণ্ঠে। এবং সেটা মেকি নয়। মন রাখার জন্যও নয়। মন থেকেই তিনি প্রশংসা করতেন। এমনকী কেউ প্ররোচিত করলেও কারও সম্পর্কে খারাপ কথা বলতেন না। একবার সলিলদা হেমন্তবাবুর গাওয়া একটা গান (‌পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি)‌ প্রতিজ্ঞা যেশু দাসকে দিয়ে গাওয়ালেন। ব্যাপারটা আমার ঠিক ভাল লাগেনি। তাঁকে গিয়ে বললাম, সলিলদা এটা ঠিক করলেন না। হেমন্তবাবু বিষয়টা জানতেন, কিন্তু কোনও রাগ বা অভিমান দেখালেন না। বললেন, ও হ্যাঁ, ওটা যেশু দাসকে দিয়ে গাইয়েছে। যদিও আমি শুনিনি। তবে যেশু দাস তো ভালই গায়। আশা করি, ভালই গেয়েছে। এই হলেন হেমন্ত মুখার্জি। আর কজন শিল্পী এটা খোলা মনে মেনে নিতে পারতেন, জানি না।  ‌

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.