সরল বিশ্বাস
বিধানসভা ভোটের আগেই বাজারে ছাড়া হয়েছিল প্রচারটা। এবার জিতলে তৈরি হবে বিধান পরিষদ। যাঁরা এখানে টিকিট পেলেন না, তাঁদের বিধান পরিষদ থেকে জিতিয়ে আনা হবে। তাঁদের মধ্যে থেকে মন্ত্রীও করা হতে পারে।
এই প্রতিশ্রতি কাদের জন্য? নিশ্চিতভাবে আমজনতার জন্য নয়। কারণ, বিধান পরিষদ হল কি হল না, এতে আম পাবলিকের কী আসে যায়! একমাত্র যাঁরা বিধান পরিষদের যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের ছাড়া আর কারও আগ্রহ থাকার কথাও নয়।
এবারের ভোটে অনেককেই টিকিট দিতে পারেননি নেত্রী। নির্বাচিত বিধায়করা যেমন বাদ পড়েছেন, তেমনি অনেক প্রত্যাশী ছিলেন, তাঁদের প্রত্যাশাও পূরণ করা যায়নি। অন্য শিবিরে পা বাড়াতে পারেন। সেটা আটকাতে এরকম একটা টোপ দরকারও ছিল। অনেকেই ভেবেছেন, এখানে টিকিট পাইনি। যদি চুপচাপ থাকি, অন্য একটা দরজা খোলা রইল। এই প্রতিশ্রুতিতে ভাঙন কিছুটা হলেও ঠেকানো গেছে। তাছাড়া, হেরে গেলেও পেছনের দরজা রইল।
ভোটে জেতার পর ক্যাবিনেটে এই প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। এমনভাবে চ্যানেলে বলা হল, এমনভাবে কাগজে লেখা হল, যেন বিধান পরিষদ হয়েই গেল। যেন আর কোনও বাধা রইল না। সর্বাধিক প্রচারিত কাগজের শিরোনামে ব্যবহার করা হল ‘ছাড়পত্র’ শব্দটি। যেন ক্যাবিনেটের ছাড়পত্রের জন্য বিষয়টি আটকে ছিল।
নিয়মটা আসলে কী? ক্যাবিনেটে পাশ হওয়ার পর আসবে রাজ্য বিধানসভায়। সেখানে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার। এই পর্যন্ত সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এরপর তা রাজ্যপালের অনুমোদনের জন্য যাবে। এত সহজে অনুমোদন পাওয়া যাবে? যদি যায়, তারপর যাবে লোকসভা ও রাজ্যসভায়। সেখানেও দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন নিয়ে পাশ করাতে হবে। তারপর তা যাবে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য। যদি সংসদের দুই কক্ষে পাশ হয়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতির দিক থেকে ছাড় পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু লোকসভা ও রাজ্যসভায় দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন পাওয়া যাবে, এটা কীসের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী ভেবে নিলেন? অঙ্কটা খুব পরিষ্কার, যদি প্রধানমন্ত্রী চান, যদি বিজেপি চায়, তবেই এই প্রস্তাব পাশ হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, গোটাটাই কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তাহলে মমতা ব্যানার্জি এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন কীসের ভিত্তিতে?
হ্যাঁ, কয়েকটা রাজ্যে এখনও বিধান পরিষদের অস্তিত্ব আছে। সে তো আমাদের রাজ্যেও ছিল। যা পঞ্চাশ বছরেরও আগে তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে বিধান পরিষদের স্বীকৃতি পাওয়া মোটেই সহজ নয়। গত পঞ্চাশ বছরে এমন একটিই নজির আছে। ইতিহাসের চাকাকে বারবার পেছন দিকে নিয়ে যাওয়া কি এতই সহজ?
গত দশ বছরে তিনবার রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে দিল্লিতে পাঠানো হয়েছে। বিধানসভায় সর্বসম্মতিতে সেই নাম বদলের প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। তারপরেও দিল্লি এখনও রাজ্যের নাম বদলে অনুমোদন দেয়নি। সামান্য একটা নাম পরিবর্তনে এতরকম জটিলতা। সেখানে বিধান পরিষদের সম্মতি পাওয়া যাবে? চোখে দূরবিন লাগিয়েও এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে?
তাছাড়া বিধান পরিষদের ভাবনা কেন এসেছিল? কাদের জন্য এসেছিল? এমন কিছু বিদগ্ধ মানুষ, যাঁরা নীতি নির্ধারণে দিশা দেখাবেন, যাঁরা শিক্ষায়–দীক্ষায় অগ্রগণ্য, যাঁরা বিশেষ চিন্তাশীল মানুষ, তাঁদের জন্য। রাজ্যসভাও সেই কারণেই। তাই এটিকে সংসদের উচ্চকক্ষ বলা হয়। সেখানে তৃণমূল কাদের পাঠিয়েছে, একবার চোখ বোলানো যাক। মানস ভুঁইয়া, দীনেশ ত্রিবেদী, সুখেন্দু শেখর রায়রা অবশ্যই যোগ্য। দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বা যোগেন চৌধুরিকেও না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আহমেদ হাসান ইমরান, বিবেক গুপ্ত, দোলা সেন, শুভাশিস চক্রবর্তী, আবির বিশ্বাস, সুব্রত বক্সি, সৃঞ্জয় বসু, অর্পিতা ঘোষ, মৌসম নুর। এঁরা সত্যিই দেশকে দিশা দেখাবেন? কোনও বিষয় নিয়ে ইংরাজিতে দশ মিনিট কথা বলার যোগ্যতা আছে? সহজ কথা, লোকসভায় হারা লোকেদের বা দলের লোকেদের পুনর্বাসন। জেলা পরিষদের মেন্টর পোস্ট তৈরি করা হয়েছিল। জেলায় জেলায় কাদের বসানো হয়েছিল? তাই বিধান পরিষদ চালু হলেও কাদের আনা হবে, তা সহজেই বোঝা যায়। এইসব লোকেদের জন্য বিধান পরিষদ? পাইয়ে দেওয়া আর আনুগত্য আদায়ের নির্লজ্জতা তবু থামবে না?