বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
‘সুখের আশ্রয়’ অ্যাপার্টমেন্টে একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড। ভয়াবহ করোনা রোগ সংক্রামক আবহে, খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে অ্যাপার্টমেন্টের প্রায় সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কাছে। বৃদ্ধ অতুলবাবু ভয়ঙ্করভাবে আতঙ্কগ্রস্ত আর বেশ দিশেহারা হয়ে ছলছল চোখে বলছেন, ‘স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে আমি আমার ফ্ল্যাটে একাই থাকি। আমার একমাত্র ছেলে চাকরিসূত্রে বিদেশে থাকে। আমার পাশের ফ্ল্যাটের অভিজিৎ আমার যে এতবড় ক্ষতি করবে, সেটা আমি কল্পনাই করতে পারিনি। অথচ আমি অভিজিৎকে আমার ছেলের মতোই ভালবাসি। আজ সকালে অভিজিৎ খুব চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আমাকে বলল, কাকু, আমার গাড়িটা স্টার্ট নিচ্ছে না। আপনার গাড়ির চাবিটা আমাকে দিন, আমি আধ ঘন্টার মধ্যেই একটা জরুরি কাজ সেরে ফিরে এসে আপনার গাড়ি আবার গ্যারেজে রেখে দিচ্ছি। ভাবলাম, হয়ত কোনও বিপদে পড়েছে, তাই আমার গাড়ির চাবিটা ওকে দিলাম। আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে এসে আমাকে একেবারে জড়িয়ে ধরে বলল, কাকু, আপনি আমার খুবই উপকার করলেন, আপনার গাড়িটা এই মুহূর্তে না পেলে আমি খবরটা জানতেই পারতাম না। এই কথা বলে হনহন করে নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ভাবলাম হয়ত ওদের কোন বিপদ ঘটেছে তাই মানবিকতার তাগিদে জিগ্যেস করতে ওদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে শুনতে পেলাম ঘরের ভেতর অভিজিৎ ওর স্ত্রীকে বলছে, ‘রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।’ এই কথা শুনে আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। যে হারে আমাদের কলকাতা শহরে সংক্রামক করোনা রোগের রিপোর্ট পজিটিভ হচ্ছে, তাতে শঙ্কিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমে গিয়ে প্রায় এক বোতল ডেটল জলের সঙ্গে মিশিয়ে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলাম। কারণ, কিছুক্ষণ আগেই এই অভিজিৎ আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। বড় এক বোতল স্যানিটাইজার দিয়ে অভিজিৎ এর ব্যবহৃত আমার গাড়িটাকে জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করলাম। আমার খুব ভয় হচ্ছে একেই আমাদের এলাকাটি কন্টেনমেন্ট জোন হিসেবে চিহ্নিত। তার ওপর অভিজিৎদের মতো করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমার রিপোর্টও যদি পজিটিভ হয়!
খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই ফ্ল্যাট ওনার্স এসোসিয়েশনের সম্পাদক এরই মধ্যে জরুরি মিটিং তলব করে সবাইকে বাড়ির ছাদে জড়ো হতে বলেছেন। সেখানেই নাকি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হবে।
বিমল বাবু বললেন, আমি আর এক মুহূর্ত এই অ্যাপার্টমেন্টে থাকছি না। এখনই পরিবার নিয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছি।
অবিনাশবাবু বেশ চিন্তিত হয়ে বললেন, এই রোগ এত বেশি সংক্রামক, এখানে এখন থাকাই যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্টকে সিল করে দেবে।
তিনতলার বৃদ্ধা মহামায়া দেবী বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে ঠাকুরের নাম জপতে জপতে হাতে একটা ছোট সুটকেস নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন। অ্যাপার্টমেন্টের টপ ফ্লোরে থাকেন সরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তার। সবাই মিলে পরামর্শ করে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ডাঃ ব্যানার্জি, আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন আপনাদের হাসপাতালে কোভিড ওয়ার্ডে করোনা রোগীদের বেডে অভিজিৎ দের ভর্তি করবার জন্য। আর একান্তই যদি হাসপাতালে ভর্তি করা না যায়, তবে অন্তত কোনও কোয়ারেন্টিন সেন্টারে এদের পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। ডাঃ ব্যানার্জি বললেন, আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্টে কোনও লোকের করোনার রিপোর্ট যদি পজিটিভ আসে, তবে তো খুব চিন্তারই বিষয়। দেখি আমি কী করতে পারি। এই বলে তিনি তাঁর মোবাইলে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করা শুরু করলেন।
জরুরি এই আলোচনা চলাকালীন হঠাৎ করে সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন অভিজিৎকে ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মুহূর্তে সম্বিত ফিরে পেয়ে তার সামনে থেকে আরও অনেকখানি দূরে সরে গিয়ে সবাই মিলে বললেন, তুমি এখানে? তোমাদের রিপোর্ট তো ‘পজিটিভ’।
অভিজিৎ একগাল হাসি দিয়ে বলল, হ্যাঁ, রিপোর্ট তো পজিটিভ এসেছে। আর এই পজিটিভ রিপোর্ট আসার জন্য আমরা ভগবানের কাছে অনেক প্রার্থনা করেছিলাম, আজ আমাদের খুব খুশির, খুব আনন্দের দিন। রিপোর্ট পজিটিভের জন্য আমি আজ সবাইকে পেট ভরে মিষ্টি খাওয়াবো, আর অর্ডারও দেয়া হয়ে গেছে।
গোকুল বাবু নাকে–মুখে মাস্কটাকে ভাল করে লাগিয়ে নিয়ে দূর থেকেই বললেন, তোমাদের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত পুলিশ আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্ট সিল করে দেবে। আর এই সাংঘাতিক সময়ে তুমি আমাদের সঙ্গে মশকরা করছ?
অভিজিৎ একটু চিন্তা করে পুরো ব্যাপারটি বুঝে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে আমার নয়, আমার স্ত্রীর। আমাদের দশ বছর বিয়ে হয়েছে, এতদিন পর আমার স্ত্রীর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট ‘পজিটিভ’ এসেছে। সেই আনন্দেই আমি সবাইকে পেট ভরে মিষ্টি খাওয়াব।
এই সুখবর শুনে নিমেষের মধ্যে করোনার ভয় দূর হয়ে সবাই মিলে এক আনন্দ উৎসবে মেতে উঠলেন। রোগা ছিপছিপে চেহারার রঘুনাথবাবু ফোকলা দাঁতে এক অট্টহাসি দিয়ে বললেন, তবে আর দেরি কেন? মিষ্টির হাঁড়িগুলি তাড়াতাড়ি আনবার ব্যবস্থা করো। দশাসই চেহারার রঘুনাথবাবুর স্ত্রী লাজুক ভাবে ধমকের সুরে বললেন, তোমার তো হাই ডায়বেটিস, মিষ্টির প্রতি এত লোভ কেন? সবার প্রবল হাসিতে এই করোনা সংক্রামক পরিবেশে খুশির এই খবরে একটা আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল।