কুন্তল সরকার
গত কয়েকদিন ধরে অনেকেই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে নানা স্মৃতির কথা বলছেন, লিখছেন। কে তাঁর কতটা কাছের ছিলেন, তা প্রমাণ করার একটা অদ্ভুত প্রতিযোগিতা চলেছে চতুর্দিকে। কারও কারও আলোচনা শুনে তো মনে হচ্ছে, প্রণববাবু নিজে খুব একটা সিদ্ধান্ত নিতেন না। এইসব লোকই তাঁকে বুদ্ধি জোগাতেন। কখন কোন দপ্তরটা নেওয়া উচিত, কোনটা নেওয়া উচিত নয়। কারও কাছে প্রধানমন্ত্রী না হতে পারার দুঃখের কথা বলেছেন। আবার কারও কাছে রাষ্ট্রপতি ভবনে বন্দি থাকার যন্ত্রণা শুনিয়েছেন। কিছুটা সত্যি নিশ্চয় আছে। জলের পরিমাপ কতটা, কে মাপতে যাচ্ছে!
যাই হোক, আমি কোনও কালেই প্রণববাবুর কাছের লোক ছিলাম না। এমনকী সামনাসামনি কখনও তাঁকে দেখিওনি। হয়ত কোনও জনসভায় দূর থেকে দেখেছি। সে দূরত্বটাও অন্তত দুশো মিটার তো হবেই। এত দূর থেকে কোনও মানুষকে ঠিকঠাক চেনাও যায় না। তবে, প্রায় তিন দশক ধরে মানুষটার নানা কর্মকাণ্ড শুনে আসছি, পড়ে আসছি। সেখান থেকেও তো চেনা যায়। শেখা যায়।
আমার কাছে মানুষটার সবথেকে বড় গুণ, তিনি নিজের সীমাবদ্ধতা জানতেন। অকপটে তা স্বীকার করতেন। নিজেকে কখনই জনপ্রিয় বলে দাবি করেননি। এমনকী মনে মনেও ভাবেননি। এটা তাঁর বিনয় নয়। গভীর বিশ্বাস। তিনি বারবার বলেছেন, আমার বক্তৃতা শুনতে পাঁচশো লোকও আসবে না। সেটা আমি এত বছরের রাজনৈতিক জীবনে বেশ ভালভাবে বুঝে গেছি। জননেতা কখনই আমি নই। ক্যারিশ্মা বলতে যা বোঝায়, তা ছিল ইন্দিরাজির। রাজ্য রাজনীতির কথা যদি বলেন, তাহলে জ্যোতি বসু, মমতা ব্যানার্জি। আমি তাঁদের একশো মাইলের মধ্যেও নেই।
বিরোধীতার নামে কী কদর্য আক্রমণ চলছে চারদিকে। কেন্দ্র, রাজ্য সব জায়গায় যেন একই সংস্কৃতি। বিরোধী আর শাসক যেন পাল্লা দিয়ে কুরুচিকর কথা বলে যাচ্ছে। সেই আবহে মূর্তিমান এক ব্যতিক্রম হলেন প্রণববাবু। শাসকের ভূমিকায় যেমন দেখা গেছে, তেমনি বিরোধীর ভূমিকাতেও কেটেছে লম্বা সময়। কখনও মুখ থেকে একটিও আপত্তিজনক মন্তব্য শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। যাঁরা টুইট করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, ফুল দিচ্ছেন, তাঁরা যদি এই শিষ্টাচার, সহবৎ শিখতেন!
অনেকে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী না হতে পারার জন্য একটা চাপা যন্ত্রণা ছিল। থাকাটাই তো স্বাভাবিক। একবার নয়, দুবার নয়। চার–চারবার তাঁর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল। এবং চারবারই তিনিই ছিলেন যোগ্যতম। কিন্তু তাঁর বদলে অন্য কেউ শপথ নিয়েছেন। একজন যোগ্য মানুষকে বারবার যদি বঞ্চিত হতে হয়, একটা চাপা কষ্ট তো থাকারই কথা। কিন্তু কখনও তার বহিপ্রকাশ দেখেছেন! কখনও সেই কষ্টকে বড় করে দেখাননি। নিজেকে বঞ্চিত বলে তুলে ধরার চেষ্টাও করেননি। কারও সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টাও করেননি। এসব প্রসঙ্গ উঠলে সেই প্রশ্নকে চমৎকার সামাল দিয়েছেন। এই সংযমটা কজন দেখাতে পারেন!