রক্তিম মিত্র
উতৃতরবঙ্গের চোপড়ায় দুটি সাধারণ আত্মহত্যা। অথচ, তা নিয়ে কতকিছুই না হয়ে গেল! রটিয়ে দেওয়া হল, মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আরও যেটা রটানো হল, তা আরও সাঙ্ঘাতিক। ব্যাস, এরকম উস্কানি হলে ফল যা হওয়ার, তাই হল। জাতীয় সড়ক অবরোধ। সরকারি বাস পোড়ানো। পুলিশকে আক্রমণ। এই ছবিগুলো ছড়িয়ে গেল মোবাইলে মোবাইলে। বাঙালির ঐতিহ্য নিয়ে যে যতই গর্ব করি না কেন, আসল কথাটা হচ্ছে, এই বাংলা সাম্প্রদায়িকতার উর্বর এক জমি হয়ে উঠছে। তাই একটু ধর্মীয় উস্কানি দিলেই তা দিব্যি লোকে বিশ্বাস করে ফেলছে। তলিয়ে ভাবার মতো বোধ বুদ্ধি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে।
রাতেই পাওয়া গেল ছেলেটির দেহ। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এটিও বিষ খেয়েই আত্মহত্যা। দুটো মেলালে যা দাঁড়াচ্ছে, তা হল ভিন্ন ধর্মের দুজন প্রেমিক–প্রেমিকা। কিন্তু বাড়ির লোক এই সম্পর্ককে মেনে নিত না। তাই একসঙ্গে দুজন বিষ খেয়েছে। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে নিয়ে অহেতুক জলঘোলা হল। বিজেপি যে উস্কানি দিতে চাইবে, ঝামেলা পাকাতে চাইবে, তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু শাসক দলও বারবার সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে। সেই কারণেই বিজেপির পক্ষে উস্কানি ছড়ানোর কাজটা সহজ হয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ তড়িঘড়ি জানিয়ে দিল, মেয়েটির শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। কোনও যৌন নিগ্রহ হয়নি। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ, পুলিশ বোঝাতে চাইল, আত্মহত্যা। কিন্তু পুলিশ নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে এমন জায়গায় নামিয়ে এনেছে, এই সহজ কথাটা লোকের বিশ্বাসযোগ্য হল না। অন্যদিকে, ছেলেটির দেহ রাতেই পাওয়া গেল। তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। কিন্তু এটা জানাতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। বা, জানালেও সেটা সেভাবে প্রচার হল না। ফলে, ধারণা তৈরি হয়ে গেল, ছেলেটিকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। কী আশ্চর্য, ছেলেটিকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, বেশ হয়েছে, এভাবেই বদলা নিতে হয়–এই জাতীয় পোস্টে সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে গেল।
পরে জানা গেল, মেয়েটির বাবা, দাদাকে নাকি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ছেলেটি যদি আত্মহত্যাই করে, তাহলে মেয়ের বাবাকে গ্রেপ্তার করা হল কেন? তাহলে কি সত্যিই পিটিয়ে মারা হয়েছে? বদলা নেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যদিও আত্মঘাতী মেয়েটির বাবা–দাদাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গুজব ছড়ানোর জন্য। তাঁরা নাকি বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেছে। তারাও নাকি ষড়যন্ত্র করেছে।
এমনিতেই যে কোনও ব্যাপারকে সাম্প্রদায়িকতার রং লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এই অবস্থায় পুলিশের হঠকারী আচরণ তাতে নতুন করে ইন্ধন জোগায়। যাঁর কিশোরী মেয়ে মারা গেল, তাঁর কি মাথার ঠিক থাকে! তাঁর কি তখন ভাবনা চিন্তা করে বিবৃতি দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা থাকে? তাঁরা বিভ্রান্ত হতেই পারেন। শোকের মাথায় খুন ভেবে বসতেই পারেন। তার জন্য তাঁদের ষড়যন্ত্রকারী বানিয়ে দেওয়া? মেয়ের মৃত্যুর পরের দিনই তাঁদের অ্যারেস্ট করতে হবে? তাও আবার এরকম একটা স্পর্শকাতর ঘটনার পর?
যাঁরা এতটা গভীরে যাননি, যাঁরা সবটা জানেন না, তাঁদের মনে হতেই পারে, দুজনেই যদি আত্মহত্যা করে, তাহলে ছেলের বাড়ির অভিযোগে মেয়ের বাবা–দাদাকে গ্রেপ্তার করা হল কেন? শুধুমাত্র এই প্রশ্নটাই বাজার গরম করার পক্ষে, উত্তেজনা ছড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট। এটা জানার পরেও পুলিশ এমন হঠকারী কাজ করল কেন? মেয়েটির বাবা যদি মেয়ের মৃত্যুর শোকে সাময়িক বিভ্রান্তির শিকার হয়েও থাকেন, তাই বলে এখনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা খুব জরুরি ছিল? এই সময় এই ব্যাপারটাকে একটু উপেক্ষা করা যেত না! এর ফল কী মারাত্মক হতে পারে, পুলিশ কর্তারা একবার ভেবেও দেখলেন না?
কাদের নির্দেশে এসব কাজ করছে পুলিশ? এসব কাজ বিজেপির জমিকেই আরও শক্ত করে। এসব কাজ সাম্প্রদায়িক প্রচারকে আরও মজবুত করে। বিরোধীরা সুযোগ নেবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁরা বারবার এই সুযোগ হাতে তুলে দিচ্ছেন, তাঁদের অপরাধও কোনও অংশে কম নয়।