সরকারই যেন কুস্তি লড়তে নেমেছে

কুস্তিটা আসলে কার সঙ্গে কার?‌ মনে হতেই পারে, কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচনে কে জিতলেন, তাতে কুস্তিগিরদের কী যায় আসে!‌ যদি যায় আসেও, তাহলে কেউ পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দিচ্ছেন, কেউ খেলরত্ন ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এমনটা কেন হচ্ছে?‌ এ তো সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা!‌

এ তো বাপু ভাল লক্ষণ নয়। নির্ঘাত ব্যাটারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এ নির্ঘাত বিরোধীদের গেমপ্ল্যান। এমন একটা সুর হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে অনেকদিন ধরেই। তাই যে কুস্তিগিররা অলিম্পিক, এশিয়ান গেমসের আসরে দেশকে পদক এনে দিয়েছিলেন, জাতীয় মূলস্রোত মিডিয়ায় তাঁরাই যেন ‘‌দেশদ্রোহী’‌। আর যাঁরা তাঁদের পক্ষ নেবেন, তাঁরাও সেই গোত্রের। এমনকী, সেই নাম যদি কপিলদেব হয়, তাঁরও রেহাই নেই। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ। প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ব্রাত্যই থেকে যান।

সত্যিই, তো কোন ফেডারেশনে কে সভাপতি হবেন, তা নিয়ে খেলোয়াড়দের তেমন মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। কই, অন্য কোনও খেলায় তো এমনটা হয় না। আসলে, এর আগে কোনও ফেডারেশনের সভাপতির বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগও ওঠেনি। এর আগে কোনও ‘‌প্রভাবশালী’‌ সভপতিকে আড়াল করার এমন মরিয়া সরকারি চেষ্টাও দেখা যায়নি। ব্রিজভূষণ শরণ সিং শাসকদলের একজন বাহুবলি সাংসদ। সামনে লোকসভা নির্বাচন। তার আগে মেগা ইভেন্ট অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ। তার আগে সেই রাজ্যের এমন দাপুটে সাংসদকে সরকার খামোখা চটাবে কেন?‌ এই সহজ সত্যিটাই বুঝে উঠতে পারেননি সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগট, বজরং পুনিয়ারা। তাঁরা ভেবে নিয়েছিলেন, তাঁরা ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন করলে সরকার বোধ হয় তাঁদেরই পাশে দাঁড়াবে। ‘‌বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’‌ যে সরকারের গালভরা প্রকল্প, মেয়েদের ওপর এমন নির্যাতন দেখলে তারা নিশ্চয় চুপ করে বসে থাকবে না। কিন্তু হায়!‌ প্রচারের ঢক্কানিনাদ এক জিনিস, আর বাস্তব অন্য জিনিস।

প্রতিবাদটা চলে আসছে সেই গত বছর থেকে। তাঁদের কী দাবি ছিল?‌ অভিযুক্ত ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে ঠিকঠাক তদন্ত হোক। কিন্তু সরকার শুরু থেকেই অযাচিত কুস্তিতে নেমে পড়ল। না হল তদন্ত, না হল এফআইআর। আন্দোলন ভাঙতে চলল নানা কৌশল। কখনও কুস্তিগিরদের মধ্যে তৈরি করা হল বিভাজন। কখনও লেলিয়ে দেওয়া হল পেটোয়া চ্যানেলকে। কখনও ধামাচাপা দিতে বানিয়ে দেওয়া হল কমিটি। মাসের পর মাস যায়। সেই তদন্ত কমিটি কার্যত অশ্বডিম্ব প্রসব করল।

বছরের মাঝামাঝি ফের ধর্নায় বসলেন সাক্ষী, বজরংরা। মাসের পর মাস দেশকে গৌরব এনে দেওয়া এইসব খেলোয়াড়রা রাস্তায় বসে আছেন। নিজেদের অলিম্পিক, এশিয়ান গেমসের মেডেল গঙ্গায় ভাসাতে যাচ্ছেন। তারপরেও সরকারের ভ্রুক্ষেপ নেই!‌ একটা অলিম্পিক মেডেলের মূল্য কতটা, তাঁরা বোঝেন না!‌ তারপরেও যখন সেটা গঙ্গায় ভাসাতে ছুটে যান, তখন তার গুরুত্ব কতটা, সেটা বোঝার মতো সংবেদনশীল মনোভাবটাই সরকার হারিয়ে ফেলেছিল। তাঁরা এঁদের দেখতে চাইছিলেন ‘‌দেশদ্রোহী’‌ হিসেবেই।

কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচনের পর সেই প্রতিবাদ আরও চড়া সুর নিল। সাক্ষী মালিক সেদিনই অবসর ঘোষণা করলেন। বজরং পুনিয়া জানিয়ে দিলেন, তিনি পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দেবেন। বিনেস ফোগটও ঠিক করলেন অর্জুন ও পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দেবেন। এমনিতে তাঁরা যখন কোনও পদক নিয়ে ফেরেন, তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে ঘটা করে ছবি তোলেন। সাফল্যের আলোয় উজ্জ্বল সেই ফ্রেমে অবলীলায় ঢুকে পড়েন। কিন্তু তাঁরা যখন রাষ্ট্রীয় সম্মান ফেরাতে চান, তখন তাঁদের যন্ত্রণার কারণ বোঝার চেষ্টা করেন না। একবারও বলতে পারেন না, ‘‌তোমরা রাষ্ট্রীয় সম্মান ফিরিয়ে দিও না। তোমাদের অভিযোগের উপযুক্ত তদন্ত হবে।’‌ এটুকু বলার মতো মানবিকতাও সরকার দেখাতে পারল না!‌ বজরং, বিনেসদের রাষ্ট্রীয় সম্মান কিনা ফুটপাথে রেখে আসতে হল!

এ আমার পাপ। এ তোমার পাপ। ‌কিন্তু সরকার মেতে থাকবে মন্দিরে। সরকার মেতে থাকবে ভোটের বাজার গরমে। কে পদ্মশ্রী ফেরাল, কে খেলরত্ন ফেরাল, এসব ভাবতে তাঁদের বয়েই গেছে।

মনে পড়ে যাচ্ছে নরক গুলজারের সেই কালজয়ী সংলাপটা, ‘‌কথা বলো না, কেউ শব্দ করো না, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না।’‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.