অভিজিৎ চক্রবর্তী
তুই লালপাহাড়ির দ্যাশে যা, রাঙা মাটির দ্যাশে যা। এই গানটির কথা কে না জানেন? কিন্তু এই গানটি প্রথম কে রেকর্ড করেছিলেন? অনেকেই হয়তো কোনও এক ব্যান্ডের নাম হাওয়ায় ভাসিয়ে দেবেন। কিন্তু ঘটনা হল, এই গান প্রথম রেকর্ড করেছিলেন বাঁকুড়ার লোকশিল্পী সুভাষ চক্রবর্তী।
সম্প্রতি শিল্পী প্রয়াত হলেন। যেহেতু সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্র সদনে শোকযাপন হল, তাই তাঁর মৃত্যুর খবর কিছুটা হলেও সামনে এল। চ্যানেলে অল্প জায়গা পেল। কাগজেও জায়গা পেল। নইলে, হয়ত শিল্পীর মৃত্যু সংবাদটাও হারিয়ে যেত। তবু, যতটা গুরুত্ব প্রাপ্য, ততটা কি পেলেন? অনেক ফাঁক থেকে গেল। অনেক ফাঁকিও থেকে গেল।
একটি গানের সঙ্গে কত গল্পই না জড়িয়ে থাকে। আসলে, এটি গান হিসেবে লেখা হয়নি। এটি ছিল ছিকই একটি কবিতা। কবি অরুণ চক্রবর্তী কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৭২ সালে। গত বছর এই কবিতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও গেল। গানের জন্মের আগে সেই কবিতার জন্মের দিকে একটু তাকানো যাক। শ্রীরামপুর স্টেশন। সেখানে দেখা গেল এক মহুয়া গাছ। কিন্তু এই গাছ এখানে কেন? এই গাছ তো জঙ্গলমহলে থাকার কথা? তখনই কবি লিখলেন, ‘হিতাই তুকে মানাইছে নাই রে, এক্কেবারে মানাইছে নাই রে।’ সেই মহুয়া গাছের উদ্দেশে কবি বললেন, ‘তুই লালপাহাড়ির দ্যাশে যা, রাঙামাটির দ্যাশে যা।’
অন্যদিকে, সুভাষ চক্রবর্তী। জন্ম, বেড়ে ওঠা বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে। বাড়িতে গানের আবহ। বাবা গোবর্ধন চক্রবর্তী ছিলেন ধ্রুপদ, ধামার গানের সঙ্গীতজ্ঞ। মা গাইতেন কীর্তন। তাই জন্ম থেকেই পেয়েছিলেন সঙ্গীতের ঘরানা। শুরুর দিকে মান্না দে, শ্যামল মিত্রদের গান গাইতেন। কিন্তু একটা সময় মনে হল, নিজের মতো করে গান তৈরি করতে হবে। এই লালমাটিতে জন্ম নেওয়া কবিতায় যদি সুর দেওয়া যায়, কেমন হয়! এভাবেই একের পর এক লোককবিতায় সুর হল। মঞ্চে গাওয়া হল।
এভাবেই একদিন হাতে এল কবি অরুণ চক্রবর্তীর সেই কবিতা। সেই কবিতায় সুর দিলেন। মঞ্চে গাইতে লাগলেন। মঞ্চ থেকেই ছড়িয়ে গেল মুখে মুখে। ডাক এল ভি বালসারার কাছ থেকে। তিনি এই গানের রেকর্ড করাতে চান। বালসারাজির তত্ত্বাবধানে সেই রেকর্ড করলেন সুভাষ চক্রবর্তী। তখন সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা ছিল না। এফএম–ও ছিল না। বা, সুভাষ চক্রবর্তী সে অর্থে তারকা গাইয়েও ছিলেন না। তাই, এখনকার পরিভাষায় যাকে ‘ভাইরাল’ বলা হয়, তেমনটা হয়ত হয়নি। তবু, যাঁরা লোকগানের খোঁজ রাখেন, তাঁরা শুনেছিলেন।
কিন্তু নয়ের দশকে কী হল! একটি বিখ্যাত ব্যান্ড এই গানটি রেকর্ড করল। কিন্তু গানের গীতিকার বা সুরকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে দিব্যি ‘প্রচলিত’ লিখে দেওয়া হল। এই গানটি কার গাওয়া, সেটা আমজনতা না জানতেই পারেন। কিন্তু ওই জনপ্রিয় ব্যান্ডের কেউ জানতেন না, এটা বিশ্বাসযোগ্য? একটু চেষ্টা করলে জানা যেত না? হয়ত সেই চেষ্টাটাই হয়নি। অথবা, বেমালুম চেপে গিয়ে ‘প্রচলিত’ লিখে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই তো শিল্পীদের আড়ালে ঠেলে দেওয়া হয়। আর সেই কাজটা করেন আরেকদল শিল্পীই।
শুধু কি এই একটা গান? আরও কত জনপ্রিয় গান প্রথম রেকর্ড করেছিলেন বাঁকুড়ার এই লোকশিল্পী। রবি ঠাকুর হে, ই বৈশাখে গ্রামে লিয়ে যাব, কাঠ কুড়াতে বেলা যায়, হেই মা দুগ্গা, ও বাবা হে, ছাতার টাঁড়ের মেলায় যাব, মকর পরবে মদনা ছড়া ধামসা বাজাইছে, বাঁকুড়ার মাটিকে পেনাম করি দিনে দুপুরে। আর সেই ‘গুতাই দিবেক কানাকাড়াটা’ বা ‘মাচানতলার দোকানে মিষ্টি খাব আমরা দুজনে’ তো আছেই।
এভাবেই গান বেঁচে থাকে। একজনের গান অন্যের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু প্রথম যিনি গেয়েছিলেন, তিনি আড়ালেই থেকে যান। সেই আড়ালে থাকার একবুক অভিমান নিয়েই চলে গেলেন এই লোকশিল্পী।