সুপ্রিয় চ্যাটার্জি
মধ্য কলকাতার একটি পুরনো পানশালা। ভিতরে আক্ষরিক অর্থেই তিলধারণের জায়গা নেই। কোনওমতে স্বল্প আলোতেই সন্তর্পণে পানীয়ের গ্লাস, খাবারের প্লেট টেবিলে টেবিলে পৌঁছে দিচ্ছে দক্ষ পরিবেশনকারীরা। রঙিন পানীয়ে শূন্য গেলাস পলকেই পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একধারে স্টেজ। সেখানে মাইক্রোফোন হাতে কিন্নরকন্ঠে গাইছেন কোন সুবেশিনী যুবতী বা উচ্ছলকণ্ঠ গায়ক। যোগ্য সঙ্গতে পিছনে সারি দিয়ে বসে থাকা মিউজিশিয়ানেরা।
‘তেরে বিনা জিন্দেগিসে কোই শিকওয়া’, ‘ইয়ে দিল তুম বিন’ , ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ থেকে ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ , ‘রানার’ থেকে শুরু করে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ , লতা, কিশোর, রফি, আশা, মান্না, হেমন্ত, শ্যামল, আরতি সন্ধ্যা, সবার গান একের পর এক গাওয়া হয়ে চলেছে, এমনকি রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও ইতিউতি উপস্থিতি সেখানে।
সব মিলিয়ে মিনি ফাংশন। বাড়তি পাওনা বহু পুরনো অধুনালুপ্ত গান, যা শ্রোতার অভাবে আজকাল ফাংশনে আর খাওয়া হয় না। আর সুরা কয়েক পাত্র পান করার পর সেসব গান শোনার নস্টালজিক রোমান্টিকতা আর তো কোথাও মাথা খুঁড়লেও মিলবে না।
নৌশাদ, ও পি নায়ার, শচীন কত্তা, সবার গান শুনতে চাইলে গাইবার কুশলীর অভাব নেই। ওয়ক্ত, পাকীজা, দোস্ত, তাজমহল পুরনো বিখ্যাত সব ছবির গানের ডালি।
লাইভ ব্যান্ড। চলতি কথায় সিঙ্গিং বার। বারে সুরাপান করতে গিয়ে সাথে বাড়তি পাওনা সংগীতলহরী। সন্ধ্যা হলেই উপচে পড়া ভিড়। চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, উকিলবাবু, উঠতি মস্তান, জমির দালাল, কে নেই সেই ভিড়ে। কলকাতায় নৈশ আমোদ প্রমোদের তালিকায় উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এই বিনোদন জায়গা করে নিয়েছে বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে।
মূলতঃ এই বারগুলি ছিল মধ্য কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ডেকার্স লেনের পিঙ্করুম, মেট্রোপলিটন, চাঁদনী, ওয়াটার লু স্ট্রিটের রক্স, চেরিফিক, আর হান থাই, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মনসুখ, সি আর এভিনিউয়ে ক্যালকাটা কাফে, ডিউক, চাঁদনী চকে ম্যাজেস্টিক, নিউমার্কেট এলাকায় রক্সি, প্যারিস, প্রিন্সেস, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে গালিব, এসব জায়গায় মূলত বাংলা, হিন্দি গান হত। ইংরেজি গান হত পার্ক স্ট্রিট এলাকায়।
বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত গায়ক গায়িকা একসময় এই বার গুলোতে গান করে গিয়েছেন। উষা আয়ার (তখনও উত্থুপ হননি) পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয় গেয়ে গিয়েছেন। মহম্মদ আজিজ (মুন্না) গান গাইতেন গালিব বারে।
তবে প্রদীপের নীচের অন্ধকারের কাহিনীও আছে। প্রথা অনুযায়ী, গায়িকার কন্ঠের প্রতি অনুরাগ অনেক ক্ষেত্রেই সুরার সাহচর্যে শ্রোতার মনকে কাঁচপোকার মতো টেনে নিয়ে গিয়েছে মোহের আবেশে, গান শুনে কিছু পারিতোষিক দেওয়ার সীমা ছাড়িয়ে বহু অর্থের অপচয়ের আঁধারে। মোহ যখন কেটেছে, আর ফেরা হয়ে ওঠেনি স্বাচ্ছল্যের দিনে।
আগের সোনালী দিনগুলি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শ্রোতার আসনে নতুন প্রজন্ম, অসামাজিক নানান চরিত্র। তাদের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে বিদায় নিয়েছে একে একে সুকন্ঠ শিল্পীরা, তাদের জায়গায় এসেছে চটুল নৃত্যপটু কিশোরী ও যুবতীরা, মিউজিশিয়ানদের জায়গায় ল্যাপটপে ট্র্যাকে হালফিলের লাউড মিউজিক, সাইকোডেলিক আলো, অর্থের স্রোত উপচে পড়ে পানশালার মেঝেতে।
মধ্য কলকাতার এলাকা ছাড়িয়ে সিঙ্গিং বার (বর্তমানের চলতি নাম ড্যান্সবার) ছড়িয়েছে গোটা কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলার শহর ও শহরতলিতে। বহু মানুষের জীবিকা যেমন চলে তেমনি প্রশাসনের স্থায়ী মাথাব্যথার কারণ এই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা প্রমোদকাননগুলি।
সংখ্যায় বেড়েছে অবশ্যই। সুখে বেড়েছে কি না জানি না। তবে মন বলে, ‘বাঁশি বুঝি সেই সুরে আর বাজবে না…’।
*****