বুদ্ধিজীবী সমাচার

‌‌উপন্যাস

স্বরূপ গোস্বামী
রাজস্থানে পৌঁছেই ফেলুদা বলেছিল, নিশ্চিন্তে আর থাকা গেল না রে তোপসে।
কেউই বোধ হয় নিশ্চিন্ত নয়। আমাদের এই নির্জন সরকারও নয়।
এ লাইনে কম্পিটিশন খুব বেড়ে গেছে। আগে একা কুম্ভ হয়ে রক্ষা করতেন। একাই লড়ে যেতেন চারজন– ‌পাঁচজনের যুক্তির সঙ্গে। কত যুক্তির জাল সাজাতেন। যুক্তিতে পেরে না উঠলে চিৎকার তো আছেই। এখন তাঁকে দেখে অনেকেই বুদ্ধিজীবী হতে চাইছেন। অনেকেই সন্ধে হলেই চ্যানেলে চলে আসছেন। যেন বুদ্ধিজীবী হওয়াটা নেহাতই জলভাত। এর জন্য কোনও পড়াশোনা লাগে না, চর্চা লাগে না। সন্ধেবেলায় চ্যানেলে এসে গেলেই হল। চ্যানেলগুলোও বোধ হয় নতুন নতুন মুখ চায়। তাই যাকে পারে, ধরে আনে। তবু যে শর্মাই আসুক, নির্জন সরকার ইজ নির্জন সরকার। গোটা বাংলায় তিনি আজ পরিচিত মুখ। যাঁরা টিভি দেখেন, যাঁরা একটু হলেও রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন, একডাকে চেনেন।
আর এই খ্যাতিটাই কখনও কখনও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয়, ধূর, রইল তোর এই বুদ্ধিজীবী স্ট্যাটাস। তার চেয়ে আগের জীবনটাই ঢের ভাল ছিল। কেউ চিনত না, জানত না। নিজের মতো করে বাঁচা যেত। এখন যেখানেই যাও, তোমার দিকে অনেক চোখের চাউনি। ওই দেখ, নির্জন সরকার, সেই যে টিভিতে বসে। অমনি আরও একজন ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে থাকল। এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে কারও ভাল লাগে! এইজন্যই উত্তম কুমার বলতেন, লোকের চোখ থেকে দূরে দূরে থাকো। পাবলিক যদি সবসময় দেখতে পায়, তাহলে তাদের কাছে তোমার গুরুত্ব থাকবে না।

উত্তম কুমার ইজ উত্তম কুমার। তাঁকে যেটা মানায়, সেটা কি আর নির্জন সরকারকে মানায়!‌ তাঁকে তো এই নিয়েই থাকতে হবে। অটোতেও চড়তে হবে, ছেলে পড়াতে স্কুলেও যেতে হবে, পাড়ার দোকানেও বসতে হবে। আবার সন্ধে হলে টিভি চ্যানেলেও হাজিরা দিতে হবে। মুখ ফিরিয়ে তো আর থাকা যায় না। অভিনয় না করলে উত্তম কুমারকে কে চিনত? ঠিক তেমনি, টিভিতে না গেলে নির্জন সরকারকেই বা কে চিনত!‌ থাকত একটা স্কুলের পাতি মাস্টার হয়ে। ডিএ, এলআইসি, ফেসবুক, শ্বশুরবাড়ি, বড়জোর দু–‌একটা আধা পরকীয়া–এই সব নিয়েই দিনগুজরান করতে হত। তাই যত বিড়ম্বনাই আসুক, টিভির আলোচনায় তাঁকে যেতেই হবে। খ্যাতি আর বিড়ম্বনা না হয় পাশাপাশি হাত ধরাধরি করেই হাঁটবে।
**********

সাতসকালেই একটা অচেনা নম্বরের ফোন। বোধ হয় জিও–র নম্বর। এই হয়েছে এক জ্বালা। ফ্রিতে কথা বলার সুযোগ। নেটের সুযোগ। আর বাঙালি ফ্রিতে পেলে আর দেখতে হচ্ছে না। লোকে বলে, বাঙালি নাকি ফ্রিতে আলকাতরা পেলে তাও খেয়ে নেয়। সেখানে ফ্রিতে নেট পেলে তো কথাই নেই। সবাই একটা করে জিও সিম নিয়ে নিয়েছে। সারাক্ষণ খুটুর খুটুর করেই চলেছে। কত টাকার রিচার্জ করলে কত টকটাইম, এখন আর কেউ জিজ্ঞাসা করে না। সবাই জিবি আর জিবি করেই মরছে। রোজ এক জিবি, তাও বাবুদের পোষাচ্ছে না। এত জিবি নিয়ে কী যে করে, ওরাই জানে। ফোন মানেই যেন ফ্রি। আর সেই জিও নম্বর থেকে যাকে তাকে ফোন করে বেড়াচ্ছে। আগে তবু চেনা নম্বর দেখে ধরা যেত, অচেনা নম্বর এড়িয়ে যাওয়া যেত। এখন আবার সে সুযোগও নেই। কে চেনা, আর কে অচেনা, বোঝাও মুশকিল। হঠাৎ বলবে, আমি অমুক, এটা আমার নতুন নম্বর, সেভ করে নাও। কেন রে হতচ্ছাড়া। আমার ফোনটা কি গড়ের মাঠ?
যত খুশি নম্বর সেভ করলেই হল!‌ তোর একটা নম্বরে পোষাচ্ছে না, পুলকে আরও নম্বর নিয়েছিস, ভাল কথা। তাই বলে আমাকেও সব সেভ করতে হবে? কেন করব?
সবার নামের পাশে ব্র্যাকেটে লিখে রাখতে হচ্ছে জিও। কদিন পর ব্যাপারটা এমন দাঁড়াবে বাবা, বাবা জিও। বউ, বউ জিও। মাস্টারমশাই, মাস্টার মশাই জিও। কী জানি, কোনদিন মুকেশ আম্বানি হয়ত দিদিকেও একটা জিও–র নম্বর
গছিয়ে দেবে। আর দিদিও হয়ত সরকারের খরচা বাঁচাতে জিও থেকেই দেদার ফোন করতে শুরু করে দেবেন। তখন লিখতে হবে দিদি, দিদি জিও।

কী ভাবছেন, নির্জন সরকার এতই ভিআইপি যে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীও যখন তখন ফোন করেন!‌ নাই বা করলেন। নাম্বারটা সেভ রাখতে ক্ষতি কী? কখন কোন কাজে লাগে, কে বলতে পারে!‌ তাছাড়া, ওই নম্বরটা সেভ থাকলে একটা বাড়তি স্ট্যাটাস থাকে। পাড়ার লোকজন জেনে গেলে তো আর দেখতে হচ্ছে না। পল্টু তো এই আনন্দেই রটিয়ে দেবে, ‘নির্জনদার মোবাইলে দিদির নম্বর রয়েছে। দিদি তো প্রায়ই ফোন করে। টিভিতে কবে কী বলতে হবে, আগাম বলে দেয়।’ গল্পটা ছড়াতে ছড়াতে দীপক কাকার চায়ের দোকানের জটলায় পৌঁছে যাবে।
কেউ কেউ নির্জনের কাছে জানতে চাইবে, হ্যাঁ রে, সত্যিই দিদির সঙ্গে কথা হয়? আগে নির্জন বুঝে উঠতে পারতেন না, কী বলবেন। এখন বুঝে গেছেন, হ্যাঁ বা না কোনওটাই সরাসরি বলার দরকার নেই। হাওয়ায় এমন একটা হাসি ভাসিয়ে দাও, যার মানে হ্যাঁও হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। যা বোঝার, তোমরা বুঝে নাও বাপু, সব কথা সবাইকে বলা যায় না।
তা যাক গে, সেই অচেনা নম্বরটা ধরব না, ধরব না করে ধরেই ফেললেন নির্জন।
ওপার থেকে মলয়ের গলা। গুরু, চিনতে পারছো তো?
নির্জন বললেন, না ভাই, নম্বরটা সেভ নেই। গলাটাও ঠিক চিনতে পারছি না।
— আরে গুরু, আমি মলয়। প্রলয়ের ভাই। তোমাকে তো রোজ টিভিতে দেখি। হেব্বি লাগে। একটা বিপদে পড়ে গিয়েছি গুরু। আর বোলো না, সকাল সকাল গাড়িটা মামা আটকে দিয়েছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করো।
নির্জন শুরুতে বুঝতে না পেরেই বলে উঠলেন, মামা মানে? তাছাড়া, মামার সঙ্গে তোমার ঝামেলা। আমি কী করতে পারি?
— আরে গুরু, মামা বোঝো না, এদিকে টিভিতে পুলিশ নিয়ে ভাষণ দাও!‌ মামা হল পুলিশের কোড নেম। আমি বলে দিয়েছি, আমি নির্জন সরকারের মাসতুতো ভাই।
পুলিশ প্রথমে চিনতে পারছিল না। আমি ডেসক্রিপশন দিলাম, মোবাইলে তোমার ছবি দেখালাম। এখন ঠিক চিনেছে। আমি একটু আড়াল থেকে বলছি। একটু পরে ফোনটা মামাকে দিচ্ছি। একটু ভাল করে বলে দিও।
এবার নির্জন কিছুটা বিরক্ত— কী মুশকিল, কী ব্যাপার, কিছুই জানি না। আমি কী বলব?
— আরে, জানার কী আছে? তুমি আমাকে চেনো, এটুকু বললেই হবে। বাকিটুকু তো আমি ম্যানেজ করেই রেখেছি।
— কিন্তু পুলিশ কেন ধরেছে, তুমি কী করেছো, সেটা তো জানতে হবে।
— আরে গুরু, তুমিও না!‌ নেতাদের মতো হয়ে গেছ। সাতসকালে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ পুলিশ বলে কিনা হেলমেট নেই, ফাইন লাগবে। কী সব ‘‌সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ চলছে।’‌ বলো দেখি, সকাল সকাল যদি এসব বাওয়াল করে, মটকা গরম হবে না? আরে বাবা, আমি কি ভোর থেকে মাথায় হেলমেট নিয়ে বেরিয়ে যাব নাকি? এ কি টিভি সিরিয়াল নাকি, যখন দেখবে, গা ভর্তি গয়না? আমিও বলে দিয়েছি, আপনাকে সুন্দরবনে বা ভাঙড়ে ট্রান্সফার করে দিতে পারি। আচ্ছা করে চমকেছি। বলে দিয়েছি, আমার দাদার সঙ্গে সিএমের রোজ ওঠা–বসা। গুরু বাকিটা তুমি ম্যানেজ করে নিও।
বলেই একটু পরে পুলিশকে ফোনটা ধরিয়ে দিল। পুলিশও আমতা আমতা করে বলল, ‘স্যার, ও যে আপনার ভাই, জানতাম না। আপনাকে তো আমরা রোজ টিভিতে দেখি। দারুণ বলেন। আসলে কী জানেন তো, সন্ধেবেলায় যখন অনুষ্ঠানগুলো হয়, তখন তো ডিউটিতে থাকি। আমাদের কি আর ডিউটির ঠিক আছে? যত পারছে, খাটিয়ে নিচ্ছে। এদিকে ডিএ দেওয়ার নাম নেই। রাতে রিপিট টেলিকাস্টে মাঝে মাঝে দেখি। কিন্তু রাতে এত অ্যাডভার্টাইজ যে মাথা গরম হয়ে যায়। সুমনদাকে বলবেন, রাতে এত অ্যাড দেয় কেন? আর স্যার, আপনার নম্বরটা আমি নিয়ে রাখছি। আপনার তো এত জানাশোনা। আমার ট্রান্সফারের ব্যাপারটা একটু দেখবেন স্যার। ওপরওয়ালারা বলছে, টাকা লাগবে, তবে ভাল জায়গায় পোস্টিং দেবে। পুলিশ ঘুষ নেয়, এটা সবাই জানে। কিন্তু পুলিশকেও কিনা ঘুষ দিতে হচ্ছে? এগুলো তো আর টিভিতে বলা যাবে না। তবে দাদা, আমাদের ডিএ–র ব্যাপারটা যদি একটু বলতেন!‌ আর ওই ট্রান্সফারের ব্যাপারটা.‌.‌.‌মনে রাখবেন কিন্তু। আমার নাম ভৈরব দত্ত। পোস্টিং নারকেল বাগানে।
বলেই ফোনটা আবার মলয়কে ধরিয়ে দিলেন সেই অফিসার। মলয় ওপার থেকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ বস’ বলেই ফোনটা রেখে দিল।
এ আরেক উটকো ঝামেলা। ইচ্ছে হচ্ছিল, আচ্ছা করে ব্যাটাকে দু–চার কথা শুনিয়ে দিতে। দুম করে বলে দিল, আমি নির্জন সরকারের ভাই!‌ নেহাত প্রলয়ের ভাই, নইলে হয়ত শুনিয়েও দিত। ব্যাটা নিজে হেলমেট পরবি না, আর পুলিশ ধরলে নির্জন সরকারের নাম শুনিয়ে দিলি? এবার নিশ্চয় সেই পুলিশটাকে ফোন নম্বরও দিয়ে দেবে। সে এবার ট্রান্সফারের জন্য জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে। সে আরও কতজনকে বলে বেড়াবে, কে জানে!‌

********

buddhijibi sketch4

সকালে উঠে কাগজগুলো উল্টে–পাল্টে দেখছিলেন নির্জন। আগে এসব না পড়লেও চলত। কিন্তু এখন এগুলো মাস্ট। সন্ধেতে অধিকাংশ দিনই কোনও না কোনও চ্যানেলে যেতেই হয়। কী বিষয়ে কবে আলোচনা হবে, কেউ জানে না। এমন কতবার হয়েছে, ডাকা হয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশন বা টেট সংক্রান্ত আলোচনার জন্য। সকাল থেকে এটা–সেটা পড়ে, এখান–ওখান ফোন করে তৈরি হয়ে সন্ধেবেলায় স্টুডিওতে গেলেন। গিয়ে শুনলেন, আলোচনার টপিক বদলে গেছে। সারাদিন ট্রেনের যাত্রী দুর্ভোগ, নয়তো বন্যায় কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে কেন্দ্র–রাজ্য সংঘাত, নইলে যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে স্কুলে পোশাক নিয়ে ফতোয়া। নয়ত হাসপাতালে ভাঙচুর। ইস্যুর কী আর অভাব আছে!‌ হয়ত তৈরি হয়ে গেছে সারদা নিয়ে, স্টুডিও গিয়ে শুনেছেন মিষ্টান্ন শিল্পে জিএসটি–র প্রভাব নিয়ে বলতে হবে।
লে হালুয়া। এ যেন ইতিহাস পরীক্ষা দিতে গিয়ে হঠাৎ করে ফিজিক্সের প্রশ্ন হাতে পাওয়া। নাও, এবার উত্তর লেখো। লোকে তো আর বুঝবে না, লোকটা ইতিহাস পড়ে এসেছিল, ফিজিক্সের প্রশ্ন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুম করে জিএসটি নিয়ে বলতে বললেই কি বলা যায় নাকি? তিনি কি অসীম দাশগুপ্ত নাকি অমিত মিত্র যে বিলের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে বলে যাবেন!‌
প্রথম প্রথম খুব সমস্যা হত। আবার এটা জানি না, ওটা জানি না, এসব বলাও যাবে না। তাহলে চ্যানেলগুলো অন্য কাউকে ডেকে নেবে। এমনিতেই এখন বাজারে বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই। সবাই টিভিতে মুখ দেখানোর জন্য বসে আছে। সিনেমার অভিনেতারা চান্স না পেয়ে সন্ধেতে টিভিতে চলে আসছে। রোগী জুটছে না বলে ডাক্তাররা চলে আসছে। মক্কেল নেই বলে উকিলরাও লাইন দিয়েছে। সবাই বুদ্ধিজীবী হতে চায়। এই যদি অবস্থা হয়, নির্জন সরকারের মতো নিরীহ মাস্টারের কদর কমতে কতক্ষণ!‌ অতএব, বোঝো আর না বোঝো, তোমাকে সবজান্তার ভান করে যেতেই হবে। নাই বা জানলে, এমন ভান করবে, যেন তুমি সব জানো। নেহাত সময় অল্প, তাই বলছ না। বা নেহাত সরকারের ভেতরের কথা বাইরে ফাঁস করতে নেই, তাই জেনেও বলছ না। বা বিরোধীদের সব কথার উত্তর দিতে নেই, এই ভান করে দার্শনিকের মতো একটা মৌনতা আনার চেষ্টা করো।
আগে সত্যিই খুব সমস্যা হত। এখন নির্জন বুঝে গেছেন, কিছু হলেই আগে একটা ৩৪ বছর লাগিয়ে দিলেই হবে। যে কোনও অঘটন ঘটুক, বলে দাও, ‘৩৪ বছরে এমন কত হয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। আগে এত টিভি চ্যানেল ছিল না। মানুষ থানায় অভিযোগ জানানোর সাহসই পেত না। তাই কেউ জানতে পারত না। এখন মিডিয়া উন্নত। রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে। তাই মানুষ পুলিশের কাছে যেতে ভরসা পাচ্ছে। তাই এসব বেরিয়ে আসছে। খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, এর পেছনে সিপিএমের চক্রান্ত আছে।’ ইদানীং একটা নতুন ইস্যু পাওয়া গেছে— বিজেপি। বলে দিলেই হল, সিপিএম আর বিজেপি মিলে রাজ্যে অশান্তি পাকাতে চাইছে। যেভাবে হোক, সরকারকে ছোট করতে হবে, এটাই তাদের উদ্দেশ্য।’
ব্যাস, এই টুকু বলে দিলেই হল। সিপিএম বা বিজেপি–র দিক থেকে কেউ না কেউ নিশ্চয় থাকবে। তারা হইহই করে চেঁচিয়ে উঠবে। তারা নিজেরা ঝগড়া করুক। সিপিএমের লোকটি বোঝানোর চেষ্টা করুক, বিজেপির সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। বিজেপি–র লোকটিও পাল্টা বলে চলুক। নির্জন তখন মুখ টিপে টিপে হাসেন আর ওঁদের ঝগড়া উপভোগ করেন। সে মহাকাশ বিজ্ঞানই হোক আর বন্যার সময় ডিভিসি–র জল ছাড়াই হোক, রামনবমী বা হনুমান মিছিল হোক। যদি বিস্তারিত না জানো, ৩৪ বছর বা সাম্প্রদায়িক শক্তি— এসব কিছু একটা বলে ঘেঁটে দাও।
এই কায়দাটা নির্জন সরকার বেশ রপ্ত করেছেন। তবু তৈরি তো থাকতে হয়। কখন কী নিয়ে প্রশ্ন আসে, কে বলতে পারে!‌ তাছাড়া, যতই হোক, এখন নির্জন সরকার একটা নাম। কেউ কেউ বলে, নির্জন সরকার একটা ব্র্যান্ড। অধিকাংশ মন্ত্রীর চেয়ে তাঁকে বেশি লোক চেনে। ফেসবুকে তাঁর ফ্যানদের আলাদা গ্রুপ আছে। কত জায়গা থেকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাক আসে। ট্রেনে, স্কুলে, চায়ের দোকানে কত লোক তাঁর মতামত জানতে চায়। তিনি যদি চুপচাপ থাকেন, চলবে? সবটা না হোক, অন্তত কিছুটা তো বলতে হবে। তাই সকাল থেকেই কাগজে চোখ রাখতে হয়। সোশাল মিডিয়া ঘাটাঘাটি করতে হয়। নিজেকে সবসময় আপ টু ডেট রাখতে হয়। সঙ্গে অপেক্ষা, আজ কোন চ্যানেল থেকে ডাক আসে!

সকালে উঠে কর্তা যদি কাগজ নিয়ে বসে যায়, গিন্নির রেগে যাওয়ারই কথা। নির্জনের গিন্নিও ব্যতিক্রম নন। তিনিও সুযোগ পেলেই শুনিয়ে দেন, এখন যত পড়ছ, আগে যদি এত পড়তে, তাহলে হয়ত সায়েন্টিস্ট হতে পারতে। নিদেনপক্ষে কলেজে পড়াতে। এত পড়ে কী হবে? সেই তো গিয়ে কীসব আবোল–তাবোল বকবে। তোমার দল ভোটে গুন্ডামি করে যাবে। আর তুমি তোতা পাখির মতো বলে যাবে, ৩৪ বছর ধরে এসব অনেক হয়েছে। এখন যা হচ্ছে, তা বিরোধীদের অপপ্রচার। এইসব তো পাড়ার পল্টুও বলতে পারে। এই ভাঁট বকার জন্য এত পড়ার কী আছে? খুব দেশ উদ্ধার করেছো। যাও, একটু বাজারটা এনে ধন্য করো। দেখো, ওখানে আবার তোমার দীপক কাকার দোকানের আড্ডায় বসে যেও না। অজয়কে পেয়ে জ্ঞান দিতে বসে যেও না। সে তো আরেক বুদ্ধিজীবী। সারাদিন মোদি, গরু, হনুমান এসব নিয়েই মেতে আছে। শুধু ভাষণ দিয়ে চলেছে। ওকেও সঙ্গে করে চ্যানেলে নিয়ে যেও।

সকালেই গিন্নির গোলাবর্ষণ। কী অবলীলায় বলে দিল, তোমার দল!‌ তৃণমূল কি নির্জনের দল নাকি? সিপিএমের লোকেরা বলে তৃণমূলের দালাল। তাই বলে ঘরে গিন্নিও তাই বলবে? বলারই কথা। কারণ, মৈত্রেয়ীর জ্যাঠা সিপিএমের নেতা ছিলেন। জোনাল কমিটিতেও ছিলেন। কাউন্সিলর নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন। বাবা সরাসরি রাজনীতি না করলেও সরকারি চাকরির সূত্রে কো–অর্ডিনেশন করতেন। তাই কিছুটা বাম–ব্যামো মৈত্রেয়ীর মধ্যেও থেকে গেছে। সুযোগ পেলেই শোনাতে ছাড়ে না। তাই বলে পাড়ার পল্টুর সঙ্গে তুলনা? নির্জন যা পারেন, পাড়ার
পল্টুও তাই পারে? নির্জনের এত পড়াশোনার কোনও দাম নেই? রোজ যে নতুন নতুন যুক্তি সাজান, তার কোনও দাম নেই? এত নেতা–মন্ত্রীদের সঙ্গে চেনাশোনা, সেটা কি এমনি এমনিই হয়েছে!‌ সকাল সকাল এইসব গঞ্জনা শুনলে কার আর মাথার ঠিক থাকে!‌ একটু শান্তিতে কাগজটাও পড়া যাবে না? কিছুটা বিরক্ত হয়েই কাগজ রেখে থলি হাতে বেরিয়ে পড়লেন নির্জন।

*******************

চায়ের দোকানের সত্যিই কোনও বিকল্প নেই। সব দোকানে আবার বসার ব্যবস্থা থাকে না। সেখানে লোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে কেটে পড়ে। দোকানের মালিকও হয়ত চায় না লোকজন আড্ডা দিক। কিন্তু সব পাড়াতেই দীপককাকার মতো এক–দুটো দোকান ঠিক আছে। যেখানে সকাল থেকেই নানা বয়সী লোকজনের আনাগোনা।
যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে অনুব্রত মণ্ডল, রাহুল গান্ধী থেকে রাহুল দ্রাবিড়, নেহরুর বিদেশনীতি থেকে তৃণমূলের সিন্ডিকেট, মুকেশ আম্বানি থেকে হর্ষ নেওটিয়া, সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয়। এই দোকানগুলোই হল পাড়ার অক্সিজেন। এটাই যেন পার্লামেন্ট, এটাই যেন বিধানসভা। অনেকে বলে, চায়ের দোকানগুলোই নাকি এবিপি আনন্দ বা চব্বিশ ঘণ্টার স্টুডিও।

নির্জন অনেকদিন ধরেই এই দোকানে বসেন। তা প্রায় বছর পনেরো তো হবেই। আগে কেউ বিশেষ পাত্তা দিত না। এমনকী দীপককাকাও পাত্তা দিত না। দু একদিন হয়ত খুচরো নেই, নির্জন বলেছেন, বিকেলে দিয়ে দেব। কিন্তু দীপককাকা শোনেনি। বলেছে, খুচরো নেই তো জমা রেখে যান। এখানে বাপু ধার–দেনা হবে না। বিকেলে দেব বলে কত লোক হাওয়া হয়ে যায়, আমার কি এত মনে থাকে!‌
মাত্র কয়েক বছরেই ছবিটা কেমন বদলে গেছে। এখন দীপককাকা চায়ের দামই নিতে চায় না। এই নির্জন সরকারের জন্য দীপককাকার দোকানের ব্র্যান্ড ভ্যালুই যেন বেড়ে গেছে। দীপককাকাই সারাদিন গর্ব করে খদ্দেরদের শুনিয়ে যায়, ‘ওই যে টিভিতে বসেন, নির্জন সরকার, উনি তো এই দোকানেই বসেন। রোজ আসেন। আসবেন একদিন, পরিচয় করিয়ে দেব।’

নির্জনের নাম নিয়ে দীপককাকা বেশ ভাও বাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন কত খদ্দেরের সঙ্গে যে পরিচয় করিয়েছে, তার হিসেব নেই। আর নির্জনকেও প্রতিবার দাঁত কেলিয়ে হাসতে হয়েছে। কত লোককে চা খাওয়াতে হয়েছে। কত লোকের কত উটকো আবদার শুনতে হয়েছে। অনেকেই জানে, এই দোকানে নির্জন সকালের দিকে বা ছুটির দিনে সময় পেলেই আসেন। তাই অনেকেই ভিড় জমান। অনেকে হয়ত এমনিই চায়ের দোকানে এসেছিল। নির্জনকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এরপরেই সেই লোকটি কী প্রশ্ন করবেন, নির্জন জানেন। কাছে এসে আমতা আমতা করে হয়ত বলবেন, ‘আচ্ছা, আপনি সেই এবিপি আনন্দতে বসেন না? আপনার নামটা যেন কী?’
অমনি পাশ থেকে দীপককাকা ছুটে এসে বলে, ‘চিনতে পারছেন না? উনি নির্জন সরকার। দিদির খুব কাছের লোক। আমার দোকানের অনেকদিনের পুরনো খদ্দের। আগেরবার আমার দোকানটা পাড়ার কাউন্সিলর যখন তুলে দিচ্ছিল, উনিই তো ওপর মহলে বলে আটকে দিয়েছেন।’

নাও, এবার নতুন ঝামেলা শুরু। লোকটি নির্ঘাত ফোন নম্বর চাইবে। না দিলেও মুশকিল। বলবে খুব অহঙ্কারি। আবার দিলে তো মুশকিলের শেষ নেই। সে ফোন করে, হোয়াটস অ্যাপ করে পাগল করে দেবে। হয়ত বলবে, ছেলে টেট পরীক্ষা দিয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীকে একটু বলে দিন। নইলে বলবে, নার্সিংহোমে বিল বেশি নিচ্ছে। আপনি একটু ফোন করে বলে দিন।
আরে বাবা, যাকে যা খুশি বলা যায় নাকি? বললেই বা লোকে শুনবে কেন? তাছাড়া চিনি না, জানি না, যার তার হয়ে বলতে যাবেনই বা কেন? এগুলো তো লোকেরা বুঝতে চায় না। ভাবে নির্জন সরকার বললেই বোধ হয় হয়ে যাবে। মমতা ব্যানার্জি নন, তিনিই যেন সরকারটা চালাচ্ছেন।‌
তবে এই চায়ের আসরে অনেক ভাল লোককেও পেয়েছেন। যেমন মনোজবাবু। অত্যন্ত পড়াশোনা করা একজন মানুষ। নানা বিষয়ে খোঁজ রাখেন। অন্যকে সম্মান দিতে জানেন। নিজে বাম মনষ্ক। কিন্তু নির্জন শাসক দলের হয়ে কথা বললেও বেশ স্নেহের চোখেই দেখেন। আগের দিন টিভির টক শো তে নির্জন কোনও ভাল যুক্তি দিলে প্রশংসা করেন। আবার কোথাও যুক্তি দুর্বল হলে সেটাও বলেন। বাম মনষ্ক হলেও গোঁড়া বাম নন। ফলে, নিজেদের ভুল–ত্রুটি গুলোও অকপটে আলোচনা করেন। এমনকী সরকারের ভাল কাজগুলোর ব্যাপারেও তিনি খোলামনে প্রশংসা করেন। সেখান থেকেই নির্জন অনেক নতুন যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন। নির্জনও নানা সময়ে তাঁর সাহায্য নিয়েছেন। কোনও বিষয় নিয়ে হয়ত সন্ধেবেলায় বলতে হবে। অথচ বিষয়টা পরিষ্কার নয়। চায়ের দোকানেই হয়ত দেখা হয়ে গেল মনোজবাবুর সঙ্গে। সবার সামনে তো আর জিজ্ঞাসা করা যায় না। মনোজ বাবুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর বাড়ি অব্দি পৌঁছে গেছেন। যা জানার, জেনেও নিয়েছেন। এমনও হয়েছে, স্টুডিওতে বিরতির মাঝে হয়ত ফোন করেছেন। মনোজবাবু কোনওবারই কার্পণ্য করেননি। সবসময় নির্জনকে সাহায্য করেছেন।

আবার উল্টোছবিও আছে। যেমন জয়ন্ত বোস। হতাশ তৃণমূল নেতা। এমন হাবভাব যেন সব জানে। আসলে, কিছুই জানে না। অনেক চেষ্টা করেও পুরভোটের টিকিট পায়নি। সেও একসময় দীপককাকার দোকানেরই নিয়মিত খদ্দের ছিল। নির্জনকে ভালই চিনত। নির্জন টিভিতে যাওয়া শুরু করতেই গায়ে পড়ে জ্ঞান দিতে আরম্ভ করল। আজ এই নিয়ে বলবি। যে জ্ঞানগুলো দিত, সেটা চাইলে দীপককাকাও দিতে পারত। এর জন্য কোনও পড়াশোনা লাগে না, বুদ্ধিও লাগে না। নির্জন হয়ত দু–একটা কথা বলেওছেন। কিন্তু তারপরই ফাটাতে শুরু করল জয়ন্ত। সবাইকে বলে বেড়ায়, ওই যে নির্জন সরকার, ও তো আমার হাতেই তৈরি। আমিই তো চ্যানেলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। আমার সময় থাকে না, তাই আমি যাই না। ওকেই পাঠাই। কবে কী বলতে হবে, আমি শিখিয়ে দিই। রোজ স্টুডিওতে ঢোকার আগে আমাকে ফোন করে।

কে যে কীসে আনন্দ পায়!‌ জয়ন্ত বোস হয়ত এসব প্রচার করেই আনন্দ পায়।
শুরুতে নির্জন বুঝতে পারেননি। পরে অনেক লোকের মুখেই শুনেছেন, নির্জন নাকি রোজ ওকে ফোন করেন। জয়ন্ত যা শিখিয়ে দেয়, নির্জন নাকি তাই বলেন। এসব শুনতে কার ভাল লাগে!‌ নির্জনেরও ভাল লাগেনি। তবে তিনি আর ঝগড়ায় যেতে চাননি। বরং জয়ন্ত বোসকে দেখলেই এড়িয়ে চলেন। ফোন করা তো দূরে থাক, আগ বাড়িয়ে কথাও বলেন না। সেটা নিয়েও জয়ন্ত বোসের কুৎসার বিরাম নেই,
‘এখন তো সেলিব্রিটি হয়ে গেছে। এখন দেখলে এমন ভান করে যেন চেনেই না। আমি না থাকলে স্টুডিওতে যাওয়ার সুযোগ পেতিস?’
শুধু তাই নয়, আগে নানারকম বায়না নিয়ে আসত এই জয়ন্ত বোস। একবার তো উঠে পড়ে লাগল, পুরভোটের টিকিট নিতেই হবে। নির্জন যেন বিভিন্ন দাদাদের বলে ওকে টিকিট জোগাড় করে দেয়।
নির্জন বারবার বলতে থাকেন, ‘কে কোথায় টিকিট পাবে, সেটা দলের ব্যাপার। আমি বললেই আমার কথা নেতারা শুনবে কেন? তাছাড়া, এটা কোনও নেতার হাতেও নেই। দিদিমণির কোথায় কাকে পছন্দ হবে, কেউ বলতে পারে না।’
কিন্তু জয়ন্ত বোস এসব বিশ্বাস করে না। সে বিশ্বাস করে, নির্জন তার হয়ে চেষ্টা করেনননি বলেই সে বঞ্চিত। এই রাগটাও পুষে রেখেছে। কী আর করা যাবে? লোকের মুখকে তো আর থামানো যায় না। বাধ্য হয়েই এড়িয়ে চলে।

****************************

সকালের আড্ডাটা একটু বেশি সময় ধরেই গড়িয়েছিল। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টা থেকে ফোন এসেছিল। সন্ধেতে ফের ডাক পড়েছে। কিন্তু নির্জনের চিন্তা অন্য। দুপুরের আগে এবিপি থেকেও ঠিক ফোন আসবে। ঘণ্টা খানেক–এ বেশ কয়েকদিন ডাক পড়েনি। নিজেই কাল সুমনকে এসএমএস পাঠিয়েছিলেন। দাদা, ভুলে গেলে নাকি? পাল্টা মেসেজ এসেছে। সময় এলে ঠিক ডেকে নেওয়া হবে। কয়েকদিন ধরে নানা বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে চলেছেন। হোয়াটসঅ্যাপে এত লোক এতরকম টেক্সট পাঠিয়ে রেখেছে, সেগুলো উগরে দিতে হবে তো। ইস্যুগুলো যে হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাজেটের আলোচনায় গিয়ে তো আর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বলা যাবে না। বা পুরভোটের জয়ের পর তো আর কন্যাশ্রী নিয়ে বেশি ভাষণ দেওয়া যাবে না।

মাঝে মাঝেই এমনটা হয়, সকালে হয়ত একটা চ্যানেল ডাকল। নির্জন ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। অমনি দুপুর নাগাদ অন্য কোনও বড় চ্যানেল থেকে ডাক। একদিকে অন্য ছোট চ্যানেলকে কথা দেওয়া হয়ে গেছে। অন্যদিকে, বড় চ্যানেলে অনেক বেশি টিআরপি, বেশি ভিউয়ার। একদিকে কথা রাখার তাগিদ, অন্যদিকে নিজেকে আরও বেশি লোকের কাছে মেলে ধরার সুযোগ। কোনটা ছেড়ে কোন ডাকে সাড়া দেবেন, ভেবে পান না।

নির্জন অবশ্য কথার খেলাপ করতে চান না। চেষ্টা করেন, একূল ওকূল দুকূলই রাখতে। সন্ধে সাতটায় হয়ত একটা চ্যানেলে গেলেন, সেখান থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ অন্য চ্যানেলে ঠিক ঢুকে পড়লেন। কখনও জ্যামে গাড়ি আটকে গেছে। দেরি হয়েছে। আবার কখনও কারও না কারও গাড়িতে ঠিক জায়গা হয়ে গেছে।
সন্ধেতে কী বলা যায়, তা নিয়ে তৈরি হওয়ার তেমন সুযোগ নেই। কারণ, স্কুলের টাইম হয়ে গেছে। সন্ধেয় যতই চ্যানেল থাক, চ্যানেলে গিয়ে তো আর পেট ভরবে না। ভরসা এই মাস্টারির চাকরিটাই। তাছাড়া, শিক্ষকতার চাকরিটা যদি না থাকত, তাহলে তো বুদ্ধিজীবীর তকমাটাও থাকত না। এখনও চ্যানেলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলা হয়, আমাদের সঙ্গে আছেন বিশিষ্ট শিক্ষক নির্জন সরকার। বুদ্ধিজীবী কোটায় অন্যান্য যাঁরা আসেন, বেশিরভাগই অধ্যাপক। কেউ কলেজে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। সেখানে নির্জনই একমাত্র শিক্ষক। এই নিয়ে কতলোক কতরকম আওয়াজ দেয়। যেমন মিহিরবাবু। একসময় সিপিএমের জোনাল কমিটিতে ছিলেন। খুব নাক উঁচু মানুষ। তাঁর ধারনা, তিনি একাই পণ্ডিত, বাকি কেউ কিচ্ছু বোঝে না। নির্জনের টিভিতে যাওয়া, এই পরিচিতি, খোলা মনে মেনে নিতে পারেন না। নির্জনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, কী দিনকাল এল, এখন স্কুল মাস্টারও নাকি বুদ্ধিজীবী। এইসব ছোকরাগুলো যদি বুদ্ধিজীবী হয়, তাহলেই বোঝা যায়, সমাজটা কেমন চলছে।
হ্যাঁ, নির্জন অধ্যাপক নন, শিক্ষক। হলেই বা। তাতে কী? ওই অধ্যাপকদের থেকে নির্জনের বাজারদর অনেক বেশি। তাঁর গায়ে প্রেসিডেন্সির একটা তকমা আছে। ফেসবুকে সেটা লিখেও রেখেছেন। স্কুলেও কদর এখন অনেক বেড়েছে। হেডস্যার আগে দু–একটা বাঁকা বাঁকা কথা বলতেন বটে, তবে এখন নির্জনকে একেবারেই ঘাঁটান না। বরং কিছুটা তোয়াজই করেন। নির্জনের দেরি হলে বিশেষ ছাড়। এমনকী একটু আগে বেরোতে চাইলে নো প্রবলেম। খুশি মনেই ছেড়ে দেন হেডস্যার।
স্কুলের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী চাই, এম পি চাই!‌ নির্জন তো আছেন। এমনকী কয়েকবার সিরিয়ালের দুএকজন আর্টিস্টকেও ধরে এনেছেন। ডিআই অফিসে স্কুলের কাজ আটকে আছে? নো প্রবলেন, নির্জন সরকার আছেন তো। তাঁর নামটা বললেই কাজ হয়ে যায়। এমনকী বিকাশ ভবন বা ডিরোজিও ভবনের কাজও আটকে থাকে না। নির্জনকে পাঠালেই সমাধান হয়ে যায়। কী জানি, আটকে রাখলে কখন কাকে নালিশ ঠুকে দেন। কিম্বা চ্যানেলে হয়ত বলেই বসলেন। ডিআই–এসআই দেরও চাকরি বাঁচাতে হবে তো!‌
স্কুলেও অন্য একটা জগৎ। বলা যায়, মিশ্র একটা জগৎ। নির্জনের এই দ্রুত উত্থানে সবাই যে খুব খুশি, এমন নয়। অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন। আবার কেউ কেউ আগে পাত্তাই দিত না। তারা এখন গায়ে পড়ে সবকিছু জানতে চায়।
ছাত্রছাত্রীদের কাছে, এমনকী অভিভাবকদের কাছেও কদর অনেক বেড়ে গেছে। ছাত্রীরা এখন পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে চায়। ক্লাসে পড়ার চেয়েও টিভি স্টুডিওর কথা বেশি করে জানতে চায়। ক্লাস নাইনের শুভঙ্কর বলে ছেলেটা তো সেদিন বলেই দিল, স্যার আমি আপনার মতো বুদ্ধিজীবী হতে চাই। কোথায় এর কোর্স করানো হয়? এমন কত প্রশ্ন যে ধেয়ে আসে!‌
স্কুলে এলে নতুন এক জ্বালাতন। এই জ্বালাতনের নাম অরিন্দম মিত্র। হিস্ট্রির অরিন্দম দেখতে শুনতে বেশ ভাল। একসময় ভাল আবৃত্তি করত। পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে খুব সচেতন। ফেসবুকে রোজ নতুন নতুন প্রোফাইল পিকচার। সারাদিন শুধু ছবি আপলোড করেই চলেছে। আর কটা লাইক পড়ছে, নজর রাখছে। প্রতিটি পিরিয়ডের পর কমনরুমে এসেই প্রথম কাজ হল মোবাইলটা খোলা। কটা লাইক এসেছে, কটা কমেন্ট এসেছে, চেক করা। যতগুলো লাইক, সবাইকে পাল্টা মেসেজ পাঠিয়ে থ্যাঙ্ক ইউ বলা। ওই ফোনটাই যেন ধ্যান জ্ঞান সাধনা। সারাক্ষণ টেই মগ্ন।
হিস্ট্রির টিচার হলে হবে কী, দেশের ইতিহাস, রাজ্যের ইতিহাস, কোনওকিছুই ঠিকঠাক জানে না। নোট মুখস্থ করে অনার্স, এম এ হয়েছে। আর এস এস সি–র দৌলতে চাকরিও একটা জুটে গেছে। টিউশনিতে বাজার তৈরির চেষ্টা করেছিল। একেবারে সুপার ফ্লপ। নিজেও ঠিকঠাক জানে না, পড়াতেও পারে না। তার ওপর ছাত্রীদের দিকে বিশেষ কুনজর। এমনকী ছাত্রীর মায়েরাও নিরাপদ নয়। ব্যাপারটা ছড়িয়ে যেতে সময় লাগেনি। আর এসব ‘গুণ’ এর কথা একবার প্রচারিত হয়ে গেলে কোন বাবা–মা তাঁদের ছেলে মেয়েদের এমন টিচারের কাছে পাঠাবেন!‌ ফলে, টিউশনিতে তেমন পসার নেই। ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে। টিউশনি সম্পর্কে অরিন্দমের মতবাদ — আঙুর ফল টক। এখন সে প্রচার করে বেড়ায় টিউশনি খুব খারাপ জিনিস। এতে শিক্ষকের মনসংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। নিজেকে ঠিকঠাক তৈরি করে ক্লাসে আসার সুযোগ থাকে না। একটা পক্ষপাতিত্ব চলে আসে। এই কারণে সে নাকি টিউশনি করে না। যারা জানে না, তারা ভাববে অরিন্দম বোধ হয় দারুণ আদর্শবান। কিন্তু যারা জানে, তাদের হাসি পায়।

এই অরিন্দমের নতুন শখ হয়েছে, সে বুদ্ধিজীবী হবে। নির্জন স্কুলে এলেই একই ঘ্যানর ঘ্যানর। কোনও একটা চ্যানেলে তার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সে নাকি দারুণ বলবে। অথচ, নির্জন বেশ ভালই জানেন, অরিন্দমের বিদ্যের দৌড় কতদূর। একসময় এবিটিএ করত। সিপিএমের হয়ে সাফাই গাইত। যেই না সরকার উল্টে গেল, অমনি এখন তৃণমূল সাজার চেষ্টা। এখন সে নাকি তৃণমূলের হয়ে চ্যানেলে বলতে চায়। সরকারের পাশে দাঁড়াতে চায়। নির্জন ভালই জানেন, এই অরিন্দম ভাল করে খবরের কাগজটাও পড়ে না। মেখলিগঞ্জ বা রঘুনাথপুর কোন জেলায় জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। সীতারাশ কেশরী আর সীতারাম ইয়েচুরির তফাত বোঝে না। ভিপি সিং আর পিভি নরসীমা রাওয়ের তফাতটাও ভাল করে বোঝে না। তার কিনা শখ হয়েছে চ্যানেলে গিয়ে রাজনীতি নিয়ে ভাষণ দেবে!‌ নির্জন বেশ ভালই জানেন, অরিন্দম যে চ্যানেলে যাবে, সেখানে গিয়ে প্রথম কাজ হবে নির্জনের নামে কুৎসা করা। স্কুলে নানা সময়ে নানা ঝামেলা হয়। সেগুলোকে রঙ চড়িয়ে তুলে ধরবে। এমনকি মেয়েলি কেচ্ছাও টেনে আনতে পারে।
নির্জন যখন প্রথম ছোটখাটো চ্যানেলে যেতেন, তখন এই অরিন্দম কম কুৎসা করেনি। সেগুলো সবই নির্জনের কানে এসেছে। এখন নির্জনকে গোটা বাংলা চেনে, সব জায়গায় তাঁর খাতির। এসব দেখে অরিন্দমেরও শখ হয়েছে টিভিতে ভাষ্যকার হওয়ার। নির্জন স্কুলে এলেই এখন আঁঠার মতো লেগে থাকে। ‘তোমার তো এত চ্যানেলে জানাশোনা। দাও না একটা সুযোগ করে।’
নির্জন বলেন, ‘কী মুশকিল!‌ টিভি চ্যানেলগুলো কি আমি চালাই? ওরা কখন কাকে ডাকবে, সেটা কি আমি ঠিক করব? আমাকেও কি রোজ ডাকে? কোন বিষয়ে কে বলতে পারবে, কোন বিষয়ে কে এক্সপার্ট, সেটা মাথায় রেখে ডাকা হয়।’
কিন্তু অরিন্দম কিছুতেই বুঝতে চায় না, ‘ওসব বুঝি না গুরু। তুমি চাইলে হবে, এটুকু জানি। আরে বাবা, আমি তো এবিপি, ২৪ ঘণ্টায় বলছি না। নিউজ টাইম, চ্যানেল টেন, আর প্লাস এগুলোতে তো বলতে পারো। বলতে বলতে ঠিক শিখে যাব। তাছাড়া, এত জানার কী আছে? আমি তো বলব সরকারের হয়ে। সরকারের হয়ে বলতে গেলে আবার যুক্তি লাগে নাকি? ভাল কিছু হলে বলব, এমনটা সারা পৃথিবীতে কোথাও হয়নি। মমতা ব্যানার্জির জন্যই সম্ভব হল। ভারতে কোনও মুখ্যমন্ত্রী এটা করতে পারতেন না। একমাত্র মমতা ব্যানার্জিই পারেন। আর খারাপ কিছু হলে বলব, সিপিএমের ৩৪ বছরে এর থেকে অনেক খারাপ খারাপ ঘটনা ঘটেছে। তখন মিডিয়া শক্তিশালী ছিল না, পুলিশ ডায়েরি নিত না, তাই কেউ জানতে পারত না। যেটা ঘটেছে, এর পেছনেও চক্রান্ত আছে। সরকারকে বদনাম করার চক্রান্ত।’
এই পর্যন্ত বলেই মুচকি হাসল। তারপর বলল, কী গুরু, ঠিক আছে তো!‌ আরে, তুমিও তো তাই বল। এর জন্য আবার এক্সপার্ট হওয়ার কী দরকার?
নির্জন হাসলেন ঠিকই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন। আসলে, অরিন্দম যে তাঁকেই কটাক্ষ করল, এটা বেশ বুঝতে পারছেন। নির্জন যখন স্কুলে থাকেন না, তখন এভাবেই কটাক্ষ করে। বোঝাতে চায়, নির্জনের কোনও কৃতিত্বই নেই। একে তাকে ধরে চ্যানেলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, সে প্রচার করত, নির্জন নাকি চ্যানেলের কিছু লোককে টাকা দিত ডাক পাওয়ার জন্য। একেকদিন নাকি পাঁচ হাজার করে দিতে হত।
লে হালুয়া। নির্জন একজন সাধারণ স্কুল মাস্টার। একেকদিন চ্যানেলে যেতে যদি পাঁচ হাজার করে টাকা দিতে হয়, তাহলে তো তার মাইনে পাঁচ–ছদিনেই শেষ হয়ে যেত। সংসার চলে কীভাবে? এই সহজ কথাটা অরিন্দমদের কে বোঝাবে!‌ এমনকী ক্লাসে গিয়ে কথায় কথায় ছাত্র–ছাত্রীদেরও বলেছেন, নির্জন টাকা দিয়ে চ্যানেলে যায়। এই নিয়ে একজন ছাত্রী একবার নির্জনের কাছে জানতেও চেয়েছিল। ‘স্যার, শুনেছিলাম চ্যানেলে যেতে নাকি টাকা লাগে।’ নির্জন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, এটা অরিন্দমেরই কারসাজি। সে ব্যাটাই ছড়িয়েছে। সেই অরিন্দম কিনা চ্যানেলে যাওয়ার জন্য নির্জনকেই ধরছে। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!‌

*********

আজ অবশ্য সন্ধেটা একটু ফাঁকা। কোনও চ্যানেল থেকে ডাক নেই। একটা সময় ছিল, যখন ডাক পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা ছিল। এখন রোজ এক কথা বলতে বলতে হয়ত কিছুটা ক্লান্তি এসে গেছে নির্জনের। মাঝে মাঝে ডাক না পেলে ভালই লাগে। তাছাড়া, আজকে ঘণ্টাখানেক এর বিষয়টাও গোলমেলে। মিষ্টান্ন শিল্পে জিএসটি। এসব তাঁর সাবজেক্ট নয়। মিষ্টির দোকানের লোকেরা বসুন, অর্থনীতিবিদরা বসুন, সেটাই ভাল। তাছাড়া, এসব অনুষ্ঠানের কিছু কমার্শিয়াল দিকও থাকে। বিভিন্ন মিষ্টির দোকান সারা বছর ধরে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এইসব অনুষ্ঠান হল সেই কৃতজ্ঞতা ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ। সেই মালিককে, সেই দোকানের ব্র্যান্ডকে আলোচনার মাধ্যমে আরও একটু মাইলেজ দেওয়া। এতে মিষ্টি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্কটা নিবিঢ় হয়। পাবলিকও বুঝতে পারে না। ভাবে, নতুন কোনও বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান। তাছাড়া, রোজ রাজনীতির আলোচনা একঘেয়ে মনে হতেই পারে। সেক্ষেত্রে একটু স্বাদবদলও হয়ে গেল।
এদিকে, পাশের ব্লকের রতনদার মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। বারবার করে বলে রেখেছে, ‘নির্জনদা আসতেই হবে কিন্তু।’ নির্জন বলেছিলেন, ‘কথা দিতে পারছি না দাদা। কবে কী অনুষ্ঠান থাকবে, তা তো আগাম জানতে পারি না। তবে সেদিন যদি চ্যানেলে না যাই, অবশ্যই যাব।’
রতনদা বলেছিল, আরে বাবা, আমি তোমার চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখি। ওটা তো রাত এগারোটায় হয় না। নটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তুমি তারপরই না হয় এসো। রাত এগারোটা পর্যন্ত সবাই থাকবে। তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে গুরু। নইলে প্রেস্টিজে পড়ে যাব।’
এই রতনদা পাড়ায় তৃণমূল করে। কাউন্সিলরের কাছের লোক। সিন্ডিকেট করে। আরও কী সব যেন করে। থানা পুলিশে যোগাযোগ আছে। ইদানীং হাতে অনেক কাঁচা টাকাও এসেছে। একটা গাড়ি থেকে এখন তিনটে গাড়ি। আগে অবশ্য এই রতনদা নানাভাবে সাহায্য করেছে। নির্জনকে বেশ কয়েকবার নিজের গাড়ি দিয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নির্জনকে প্রধান অতিথি করে পাঠিয়েছে। ভাল ভাল গিফট দিয়েছে। রাস্তায় দেখা হলে সম্মান করে। বয়সে নির্জনের থেকে অনেক বড় হলেও ‘নির্জনদা’ বলে সম্বোধন করে।

আগেরবার মেয়ের জন্মদিন ঠিকঠাক পালন হয়নি। কী একটা ব্যবসায়িক কারণে রতনদাও একটু ঝামেলার মধ্যে ছিল। তাই আগে নেমন্তন্ন করেও পরে ফিরিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল, দাদা ঝামেলায় পড়ে গেলাম। পুলিশের লাফড়া আছে। সেন্টুটা পেছনে কাঠি করতে পারে। ব্যাটা ওইদিন পুলিশ পাঠিয়ে দিতে পারে। খুব ঝামেলার কেস হয়ে যাবে। তাই এবার অনুষ্ঠানটা করছি না। পরেরবার ভাল করে করব। কিছু মনে কোরো না গুরু।

এবার একমাস আগে থেকে রতনদা বলে রেখেছে। মাঝে অন্তত তিনবার রিমাইন্ডার দিয়েছে। এবার না গেলে সত্যিই খুব খারাপ হয়ে যাবে। বলেছে, বৌদিকে নিয়ে আসতে হবে। মৈত্রেয়ীর বেশ কিছুদিন কোথায় যাওয়া হয়নি। ভালই হল, তাকে নিয়েই যাওয়া যাবে। মৈত্রেয়ী অবশ্য রতনদাকে তেমন পছন্দ করে না। যে কয়েকবার বাড়িতে এসেছে, দায়সারাভাবে চা দিয়েছে। তারপরেই নিজের ঘরে সরে গেছে। সে বলে, এই লোকগুলো সুবিধার নয়। কালো হুঁদো চেহারা, হাতে বালা, গলায় মালা, চার পাঁচটা আঙটি। দুটো মোবাইল সবসময় হাতে। এরা মেয়েদের সম্মান দিতে জানে না। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, মোদো মাতাল।’
মৈত্রেয়ী অবশ্য পড়াশোনা নিয়েই থাকত। ছোট থেকে এমন লোক খুব একটা দেখেনি। তাছাড়া, বাম বাড়ির মেয়ে। ওর বাড়িতে যাদের যাতায়াত ছিল, তারা কিছুটা শৌখিন গোছের। রতনদার মতো লোকেদের দেখার কথাও নয়। নির্জনও যে রতনদাকে খুব পছন্দ করতেন, এমন নয়। কিন্তু এখন এদেরই রমরমা। নানা জায়গায় এদের সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়। এরকম দু–একজন দাদা হাতে থাকলে পাড়ার মস্তানদের ভয় পেতে হয় না। বিপদে আপদে এই রতনদার মতো লোকেরা যথেষ্টই হেল্প করে। আগে, যখন নির্জনকে তেমন কেউ চিনত না, বা চিনলেও পাত্তা–টাত্তা দিত না, তখনও এই রতনদা কিন্তু বেশ কয়েকবার ছোটখাটো হেল্প করেছে। এবং সেটা কোনও স্বার্থ ছাড়াই করেছে। আসলে, এইসব লোককে বাইরে থেকে দেখতে যতটা খারাপ মনে হয়, কাছে গেলে দেখা যায়, ততটা খারাপ নয়। ভেতরে একটা নরম মন আছে। যেটা বাইরে থেকে সবসময় বোঝাও যায় না। গত চার পাঁচ বছরে সম্পর্কটা কিছুটা গাঢ় হয়ে গেছে। মৈত্রেয়ী হয়ত যাবে না। সেক্ষেত্রে তাঁকে একাই যেতে হবে।

ইচ্ছে করেই একটু দেরিতে গেলেন নির্জন। কারণ, আগে গেলেও রতনদা কিছুতেই আগে ছাড়বে না। এটা ওটা বলে বসিয়ে রাখবে। ভুলভাল লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। সে আরেক বিড়ম্বনা। তাই সন্ধেতে বিভিন্ন চ্যানেল সার্ফিং করতে করতে রাত নটা বাজার পর গেলেন রতনদার বাড়ি।
গেটেই দাঁড়িয়েছিল রতনদা। এর আগেই দুবার ফোন করা হয়ে গেছে। নির্জনকে দেখতে পেয়েই প্রথমে দূর থেকে নমস্কার। তারপর কাছে যেতেই জড়িয়ে ধরল। হাত ধরে নিয়ে গেল ভেতরে। বোঝাই যাচ্ছে, অনেক অতিথিকে বলে রেখেছে, নির্জন সরকার আসবে। এমএলএ থেকে কাউন্সিলর অনেককেই নেমন্তন্ন করেছে। কিন্তু রতনদা তো সেই লেবেলের লোক নয় যে একগুচ্ছ ভিআইপি এসে ভিড় করবে। তার বাড়িতে একনম্বর ভিআইপি বলতে নির্জন সরকার। এটা নির্জন নিজেও বোঝেন। এমনকী কাউন্সিলর এলেও নির্জনকে ঘিরেই বাকি নিমন্ত্রিতদের কৌতূহলটা বেশি হবে, এটাও বোঝেন।
প্রথমেই একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
—মেশোমশাই। এই হল নির্জনদা। ওই যে টিভিতে দেখেন। এই তো টিভি থেকে বেরিয়ে সোজা এখানে আসছে। আমাকে খুব ভালবাসে।
পাশের সেই মেশোমশাইয়ের প্রশ্ন— আপনাকে তো প্রায়ই দেখি। রতনও আপনার কথা খুব বলে। আপনাদের চাকরিটা বেশ সুন্দর। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপনাদের কত জ্ঞান। আচ্ছা, এতকিছু আপনারা জানেন কী করে?
নির্জন কিছুটা লাজুক সুরে বললেন, ‘একদিনে কি আর জানা হয়!‌ সারা বছর নানা বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়।’
— আচ্ছা, এর কি কোনও কোর্স হয়? মানে, আপনি কোথা থেকে শিখেছেন?

নির্জনকে মাঝে মাঝেই এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হয়। এরা ভাবে রাইস, পাথফাইন্ডার, জর্জ টেলিগ্রাফের মতো কোনও সংস্থা হয়ত বুদ্ধিজীবী ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট খুলে বসে আছে। সেখানে গিয়ে নাম লিখিয়ে দিলেই হল। মনে পড়ে যাচ্ছে, বছর খানেক আগে বেঙ্গল টাইমসে রবি কর বলে কে একজন এই নিয়ে একটা ফিচার লিখেছিল। লেখাটার হেডিং ছিল ‘বুদ্ধিজীবী ম্যানেজমেন্ট কোর্স।’ বেশ রসিয়ে লেখা হয়েছিল। তাতে নির্জন সরকারের প্রসঙ্গও ছিল। হালকা চিমটি থাকলেও ভালই লেগেছিল। যা দিনকাল আসছে, সত্যিই এবার একটা এরকম কোর্স চালু হয়ে যেতে পারে। বাপ–মায়েরা হয়ত ছেলেদের এইসব কোর্সে ভর্তি করে দিতেও পারে।

নির্জন মেসোমশাইয়ের উত্তর দিতে যাবে। অমনি পেছন থেকে আরেকজন এসে জড়িয়ে ধরল। সামনে এসে হ্যান্ডসেক করল। কোথায় যে লোকটাকে দেখেছেন, মনে করতে পারলেন না নির্জন। পথে–ঘাটে এমন কত উটকো লোক জুটে যায়। আলাপ হয়। মনেও থাকে না। কী জানি, এই ভদ্রলোকের সঙ্গেও হয়ত তেমন কোথাও আলাপ হয়েছিল।
ভদ্রলোক নিজেই বললেন, আমি আপনার ফ্যান। আপনি একা যেভাবে লড়ে যান। বাকিরা পেরেই ওঠে না। জানেন, দিদি অনেক ভাল ভাল কাজ করছে। কিন্তু সেগুলো প্রচার হচ্ছে না। বোঝেনই তো, দলটায় অশিক্ষিত লোকেই ভর্তি। সবাই নিজেদের সিন্ডিকেট, বখরা নিয়েই ব্যস্ত। সারাজীবন বালি, সিমেন্ট ছাড়া কিছু ভাবলই না। এমনকী মেয়র, ডেপুটি মেয়র তারাও সবাই প্রোমোটারি করছে। কী দিনকাল এল বলুন তো!‌
নির্জন কী বলবেন, বুঝে উঠতে পারলেন না। লোকটা কথাগুলো হয়ত ঠিক বলছে। কিন্তু তাঁকে তো টিভিতে সরকার পক্ষের হয়েই কথা বলতে হয়। এমনকী টিভির বাইরেও সেই ইমেজটাই ধরে রাখতে হয়। তাই এইসব প্রসঙ্গ এলে কিছুটা এড়িয়েই যেতে হয়। লোকটা এবার সটান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, কী ব্যাপার বলুন তো। নারদে কি আর কাউকে ডাকবে?
নির্জন বললেন, ‘আমি কী করে বলব? এটা তো সিবিআই–ইডির ব্যাপার।’
— না দাদা। আপনাদের কাছে অনেক খবর থাকে। ভেতরে ভেতরে কি সেটিং চলছে?
— আমি এসব জানি না দাদা। তাছাড়া, আমি সরকারপক্ষের হয়ে কথা বলি বলে আমি তো আর তৃণমূলের নেতা নই।
এর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ভেতর থেকে রতনদা তার গিন্নিকে নিয়ে হাজির।
গিন্নি বিকট সেজেছে। যত গয়না আছে, সবই বোধ হয় পরে ফেলেছে। কেউ কেউ ভাবে, বেশি সাজলে বোধ হয় সুন্দর দেখায়। কিন্তু এরা বুঝতেই চায় না যে যত সাজে, তাকে তত বিকট দেখতে লাগে।
যাই হোক, রতনদার স্ত্রীকে দেখে নমস্কার করলেন নির্জন। তিনি এসে প্রথমেই চমকে দিলেন, ‘জানেন আপনাকে নিয়ে আপনাদের মাঝে রোজ ঝগড়া হয়।’
— নির্জন কিছুটা আঁচ করলেন। তবু না বোঝার ভান করেই বললেন, সে কী, আমি নিরীহ এক স্কুলমাস্টার। আমাকে নিয়ে আপনাদের ঝগড়া হতে যাবে কেন?
— আর বলবেন না। আমি সন্ধেবেলায় একটু সিরিয়াল দেখব ভাবি। তখনই আপনার দাদা এসে রিমোটটা নিয়ে নেয়। বলে, নির্জনদার অনুষ্ঠান আছে। ব্যাস, এবার রিমোট ওনার হাতে। আমার আর কুসুম দোলা, ইস্টিকুটুম এসব দেখা হয় না। ভাগ্যিস সকালে রিপিট টেলিকাস্ট হয়, তাই রক্ষে। নইলে তো দেখতেই পেতাম না। যতই সকালে হোক, আপনিই বলুন, টাটকা দেখার আনন্দই আলাদা। আমার মা রাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, দেখলি? আমি কিছু উত্তর দিতে পারি না। ওর সঙ্গে বসে আমিও আপনাদের আলোচনা দেখি। কিছুই বুঝতে পারি না।’

নির্জন পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। বউদি যে একেবারে মিথ্যে বলছে, এমনও নয়। রতনদা সত্যিই অনুষ্ঠান দেখে। রাতে ভুলভাল ইংরাজিতে মেসেজও পাঠায়। লেখে balo hoyacha… ‌আসলে, লিখতে চেয়েছিল, ভাল হয়েছে। কিন্তু রোমান হরফে লিখতে গিয়ে এই বানান। এটা অবশ্য শুধু রতনদা নয়। যারা সারাক্ষণ মোবাইল খটখট করে তারাও এই জাতীয় ভুলভাল বানানই লেখে। অনেকবার নির্জন ভেবেছেন, রতনদাকে ঠিকঠাক মেসেজ লেখা শিখিয়ে দেবেন। কিন্তু পরে গুটিয়ে গেছেন। কী জানি, এসব বলতে গেলে মানুষটা হয়ত কষ্ট পাবে। ভাববে, তাকে অশিক্ষিত বলা হচ্ছে। তার চেয়ে যা লিখছে, তাই লিখুক।
হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল। রতনদা নির্জনের অনুষ্ঠান দেখে, এটা ঘটনা। ফলে, স্ত্রীর সিরিয়াল না দেখতে পাওয়াটাও মিথ্যে নয়। বেচারা নির্জন, কী আর বলবেন!‌ রতনদাকে কিছুটা অনুযোগ করেই বললেন, ‘সে কী!‌ আমার বকবক শুনবে
বলে তুমি বৌদিকে সিরিয়াল দেখতে দাও না? খুব অন্যায়। রাতে তো রিপিট টেলিকাস্ট হয়। তখন দেখবে।’
অনেকে যা অনুযোগ করে, রতনদাও তাই করল— আর বোলো না দাদা। রাতে যা বিজ্ঞাপন হয়!‌ ওই সময় ব্যাটা সুমন মনের সুখে সব বিজ্ঞাপন ঢুকিয়ে দেয়। তখন বিরক্ত লাগে। তারপর নির্জনের কানে কানে বলল, তাছাড়া বোঝোই তো, রাতে একটু পেটে পড়ে। তখন ওই ভারি ভারি কথা বুঝতেও পারব না। মাথার ওপর দিয়ে চলে যাবে।
একে একে অতিথিরা আসছেন। রতনদা প্রায় সবার সঙ্গেই পরিচয় করাচ্ছে— এই যে নির্জন সরকার। টিভিতে নিশ্চয় দেখেছেন। বাকিরাও হাসছেন, আলাপ করছেন। কেউ অটোগ্রাফ চাইছে। কেউ সেলফি তুলতে চাইছে। একজন মা তো ছেলেকে বলেই ফেলল, ভাল করে পড়াশোনা কর। এই কাকুর মতো টিভিতে ডাক পাবি। এর মধ্যে নানা বোকা বোকা প্রশ্ন উড়ে এল। যেমন ১)‌ কীভাবে টিভিতে চান্স পেলেন? ২)‌ আপনাদের কত মাইনে দেয়? ৩)‌ টিভিতে যাওয়ার আগে তৃণমূলের নেতারা ক্লাস নেন কিনা ৪)‌ সুমন বা মৌপিয়ার বিয়ে হয়েছে কিনা বা ওদের সঙ্গে কারও গোপন প্রেম চলছে কিনা। ৫) কিছু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে কিনা। কখন খাওয়ানো হয়? শুরুর আগে নাকি অনুষ্ঠানের শেষে? ৬)‌ অন্য যারা গেস্ট হয়ে আসে, তাদের সম্পর্কেও নানা কৌতূহল। ৭)‌ কখনও সিরিয়াল বা সিনেমায় ডাক পেয়েছেন কিনা।
এমন কত প্রশ্ন ধেয়ে আসে। মোটামুটি কমন। কোথাও মুচকি হেসে এড়িয়ে যেতে হয়। ‌আবার লোক বুঝে উত্তর দিতে হয়। রাজনৈতিক প্রশ্নও কম আসে না। যেমন বামমনস্ক কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, আচ্ছা, আপনি কি আর কোনও যুক্তি খুঁজে পান না। কথায় কথায় ৩৪ বছর টেনে আনেন কেন? তৃণমূলের কোনও খারাপ দিকই কি আপনার নজরে পড়ে না? সিপিএম কি কোনও ভাল কাজই করেনি?
খোলামেলা আড্ডায় নির্জন তৃণমূলের সমালোচনা বা সিপিএমের প্রশংসা দুটোই করেন। কিন্তু সেটা একেবারেই ঘরোয়া আড্ডায়। অচেনা লোকদের সামনে মনের কথা বলতে গেলেও নানা সমস্যা। সে তখন লোককে বলে বেড়াবে, ওই দ্যাখ, টিভিতে কেমন তৃণমূলের দালালি করছে। অথচ, সেদিন মমতার নামে কত উল্টোপাল্টা কথাই না বলল। এসব কথা কোন নেতার কানে চলে যাবে, কে বলতে পারে!‌ কোথা থেকে কে কী কলকাঠি নেড়ে দেবে, অমনি টিভির দরজা বন্ধ। তাই ওই দুনিয়ার কথা বাইরের লোকের কাছে বেশি না বলাই ভাল।
‌কিন্তু এসব অনুষ্ঠানে এলে লোকের কৌতূহল একটু বেড়েই যায়। তাছাড়া রতনদার মানসম্মানের প্রশ্নও জড়িয়ে আছে। সে এত লোককে বলে রেখেছে। কেউ আত্মীয়, কেউ পরিচিত। তাদের সঙ্গে যদি কথা না বলে, সেটাও খারাপ। রতনদা যে কী করবে, খুঁজে পাচ্ছে না।
কখনও ওয়েটারকে ডেকে বলছে, অ্যাই নির্জনদার জন্য কাবাব নিয়ে আয়। কখনও হাঁক পাড়ছে, অ্যাই নির্জনদাকে কোল্ড ড্রিংকস দে। বাকি গেস্টদের তেমন পাত্তাই দিচ্ছে না। নির্জন একাই যেন তার স্ট্যাটাস বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছেন। নির্জন না এলে লোকটা সত্যিই খুব প্রেস্টিজে পড়ে যেত। অনেকেই জিজ্ঞেস করত, কই উনি তো এলেন না। তখন হয়ত এটা–ওটা বলে ম্যানেজ করত।
এর মধ্যেই রতনদা ধরে আনল এক তরুণীকে। মেয়েটি বেশ সুন্দর দেখতে। তরুণী না বলে যুবতীও বলা যায়। মেয়েদের বয়স বোঝা যায় না। মেয়েটির নাম সুদেষ্ণা। সে একান্তে নির্জনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। একজন সুন্দরী মেয়ে একান্তে কথা বলবে, এর থেকে ভাল প্রস্তাব কী হতে পারে!‌ মৈত্রেয়ী এলে নির্ঘাত ক্ষেপে যেত। তখন নির্জনও একান্তে কথা বলার সাহস দেখাত না। মেয়েটিও হয়ত একান্তে কথা বলতে চাইত না। সে যাই হোক, মেয়েটির ইশারায় প্যান্ডেলের বাইরে একটু আড়ালে গেল। এদিকটায় তেমন আলো নেই। তবে বিকট গানের আওয়াজ এদিকটায় ভেসে আসছে।
মেয়েটি রাখঢাক না রেখেই বলে ফেলল, আমি জানি, আপনার অনেক সোর্স। না বলতে পারবেন না।
— আপনি কী বলতে চান, সেটা বলুন। আগে থেকে হ্যাঁ বা না বলি কী করে?
— আমাকে সিরিয়ালে চান্স করে দিতে হবে। একজনকে বলেছিলাম। সে ফালতু ঢপ দিয়েছিল। আমি বুঝেছি, ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আপনি রোজ টিভিতে যান। এত এত লোকের সঙ্গে মেশেন। তাছাড়া, আপনার পলিটিক্যাল কানেকশনও আছে। আপনি চাইলেই পারেন।
— আমার সঙ্গে যাদের অনুষ্ঠানে দেখেন, তারা কেউ নেতা, কেউ অধ্যাপক, কেউ শিল্পী, এইসব। আমি তো মূলত রাজনীতির অনুষ্ঠানে যাই। সেখানে পরিচালক বা সিনেমার লোকজন তেমন থাকে না। তাছাড়া, আমি রিকোয়েস্ট করলেই তারা শুনবে কেন?
— ওসব আমি শুনতে চাই না। আমি জানি, আপনি চাইলেই হবে। আপনি তো আপনার বোন বলে পরিচয় করিয়ে দিতেই পারেন। নইলে সুমনদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। ওর তো অনেক জানাশোনা। এত এত ডাইরেক্টরের ইন্টারভিউ করেন। উনি নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।

এই এক মুশকিল হয়েছে। নির্জন কাটিয়ে দিতে চাইলেন। অমনি এসে গেল সুমনের কথা। এবার কী করা যায়? সুমন দে–র সঙ্গে আলাপ নেই, এটা তো আর বলা যাবে না। কারণ, অধিকাংশ অনুষ্ঠানে তিনিই সঞ্চালক।
নির্জন বললেন, সুমনদা তো এভাবে কারও সঙ্গে দেখা করেন না। তাছাড়া, এরকম পার্সোনেল রিকোয়েন্ট এন্টারটেইন করেন না। তবু আপনি যখন বললেন, আমি দু–একজনকে বলে দেখব।
মেয়েটি আগেই রতনদার কাছ থেকে নির্জনের নম্বর নিয়ে রেখেছিল। বলে উঠল, আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ‘হাই’ আর ‘‌স্মাইলি’‌ পাঠিয়ে রাখছি। আমার নম্বরটা সেভ করে রাখবেন। যখন তখন জ্বালাতন করব কিন্তু।

জ্বালাতন বলে জ্বালাতন!‌ মুশকিল হল, এই মেয়ের জন্য তেমন কিছু করাও যাবে না। দুএকজন পরিচালকের সঙ্গে টুকটাক পরিচয় হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাঁরা যে কথা শুনবেন, এমন কী গ্যারান্টি আছে? তারা হয়ত উল্টোপাল্টা প্রস্তাব দিয়ে বসবেন। তখন মেয়েটির কাছে বা রতনদার কাছে তাঁকেই কথা শুনতে হবে।
এদিকে, এ মেয়ে ছাড়ার পাত্রী নয়। হাই যখন পাঠিয়েছে, তখন কত হাই যে পাঠাবে, তার ইয়াত্তা নেই। রাতে ভিতে হাই তোলার সময় হয়ত ‘হাই’ পাঠিয়ে বসল। আর মৈত্রেয়ী যদি এসব দেখেছে, তাহলে আর রক্ষে নেই!
সেলিব্রিটি হয়েও রক্ষে নেই। বৌকে সবাই ভয় পায়, নির্জন সরকার খামোকা ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন!‌

 

buddhi jibi sketch2

*****
বছর দুই আগের কথা। সেবার হঠাৎ একটা পুজো কমিটির লোকজন এসে হাজির। তাঁকে পুজো উদ্বোধনে যেতে হবে!‌ সে কী, পুজো উদ্বোধন!‌ নির্জন হাসতে হাসতে বললেন, আমি পুজোর কী বুঝি। নাস্তিক নই ঠিকই, কিন্তু পুজোরও তো কিছু বুঝি না।
উদ্যোক্তারাও নাছোড়। ওসব বুঝতে হবে না। মাইকে মন্ত্র হবে। একজন মহারাজ থাকবেন। তিনি যা বলার বলবেন। আপনি ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি–টিতি নিয়ে যা হোক কিছু একটা বলে দেবেন। আমরা গাড়ি পাঠাবো। যেতে হবে কিন্তু।
নির্জন গিয়েছিলেন। গিয়ে বুঝলেন, এরা অনেককেই আনার চেষ্টা করেছে। ফিল্মস্টার থেকে নেতা, কাউকেই জোটাতে পারেনি। ফিল্মস্টারদের রেট শুনে মাথায় হাত। নিদেনপক্ষে টিভি আর্টিস্টরাই হাজার দশেক ডিমান্ড করছে। তখন কেউ ওদের নির্জন সরকারের নাম বলে। অবশ্য ঘটা করে নির্জনকে নিয়ে আসার আরও একটা কারণ আছে। নির্জন এলে ক্লাবের অনুদান পাওয়াটা সহজ হবে।
কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। একেবারেই মফসসলের ক্লাব। মূল রাস্তা থেকে ভেতরের দিকে। অনেকটা মাটির রাস্তা পেরিয়েও যেতে হল। এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে কোন ফিল্মস্টার আসতে যাবে!‌ নেতারাই বা কেন আসবেন? তাঁদের সময়ের দাম নেই? অগতির গতি সেই নির্জন সরকার। বিনে পয়সায় এমন সেলিব্রিটি আর কটা আছে!‌
সকাল থেকেই মাইকে ঘোষণা হয়েছে। বিকেলে পুজো উদ্বোধনে আসবেন এবিপি আনন্দ খ্যাত বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী নির্জন সরকার।
হায় রে!‌ ছোটবেলায় যাত্রায় এভাবে মাইকিং হত। আসছেন চলচ্চিত্র ও দূরদর্শনের দুষ্টুমিষ্টি নায়িকা অমুক। পরেরদিকে, যখন সিরিয়ালের বাড়বাড়ন্ত, তখন বলা হতে লাগল, আসছেন অমুক সিরিয়ালের মেজ বৌদি অমুক। বা অমুক সিরিয়ালের দুষ্টু মিষ্টি অমুক। এঁরা নির্জনকেও সেই তালিকায় ফেলে দিল!‌ একেবারে এবিপি আনন্দ খ্যাত!‌ সেবার পুজো নিয়ে ভাষণ দিতে হয়েছিল নির্জনকে। তার আগে পাড়ার এক মাতব্বর এসে বলে গেছেন, গুরু এটা কিন্তু তৃণমূলের ক্লাব। এখানে সিপিএম–কে একটু ঠুকতে হবে।
নির্জন বলেন, এর মধ্যে আবার সিপিএম আসছে কোথা থেকে? পুজোর মধ্যে ওগুলো না টানাই ভাল।
কিন্তু মাতব্বর শুনলে তো!‌ তাঁর দাবি, টিভিতে যেমন বলেন, তেমনি বলতে হবে। সিপিএম–কে শুনিয়ে শুনিয়ে দু চার কথা বলতে হবে। মুখ্যমন্ত্ররীর অনুপ্রেরণার কথা বলতে হবে। কারণ, এই ভাষণের লিঙ্ক নানা জায়গায় শেয়ার হবে, লোকাল কেবলে দেখানো হবে। ঠিকঠাক বলতে পারলে ক্লাবের জন্য ২ লাখ টাকাটা পাওয়া যাবে। আগেরবারই হয়ে যেত। মাধবদা কাঁচি করে দিল। এবার লিস্টে নামটা ঢোকাতেই হবে। আপনার ভাষণের লিঙ্কটা এম এল এ–‌র হোয়াটস্‌ অ্যাপে পাঠিয়ে দেব। দেখি ব্যাটা কেমন না দেয়!‌

অগত্যা!‌ নির্জনকেও সেই তোতাপাখি আওড়ানোর মতো বলে যেতে হল— এই রাজ্যে ৩৪ বছরে এই উৎসবের আবহটাই ছিল না। আগের যারা সরকার ছিল, তারা নিজেরাও পুজো করত না। অন্যরা করুক, সেটাকেও বাঁকা চোখে দেখত। অনেকেই ইচ্ছে থাকলেও তাদের ভয়ে পুজো করতে পারত না। সেই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অনুপ্রেরণায় এখন যে কেউ পুজো করতে পারেন। এই ছোট ছোট ক্লাবগুলিও এগিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছে। সবাই মিলে আনন্দে কাটাচ্ছে। সরকার এইসব ছোট ছোট ক্লাবগুলির পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমি অনুরোধ করব, এই ক্লাবকেও সেই অনুদানের তালিকায় আনা হোক। এরা যেন পরের বছর আরও ভাল করে পুজো আয়োজন করতে পারেন।

এটা সেটা মিলিয়ে আরও নানা কথা বলতে হয়েছিল। সেটা ছিল পঞ্চমীর দিন। অনুষ্ঠান শেষের পর শাল, ঘড়ি, মিষ্টির প্যাকেট, উত্তরীয় তো ছিলই। সেক্রেটারি মশাইয়ের আবদার, তাঁর বাড়ি একবার যেতেই হবে। নির্জন বলেছিলেন, একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আরেকটা জায়গায় যেতে হবে। কিন্তু সেক্রেটারি শুনলে তো!‌ তাঁর ওই এক কথা, এই গরিবের বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো দিতেই হবে। একটু চা মিষ্টি খেতেই হবে। অনুষ্ঠান শেষে একরকম পাকড়াও করে নিয়ে গেলেন।
মফসসলের বাড়ি হলেও বেশ সাজানো গোছানো। বোঝা গেল, গিন্নিকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন, কলকাতা থেকে গেস্ট আসবে। বিছানার চাদর নতুন পাতা হয়েছে।
অনেকেই সেজেগুজে আছেন। যেতে যেতেই এসে গেল সরবত। তারপরই এক প্লেট মিষ্টি। অন্তত পাঁচ–ছ রকম আইটেম। শেষ করাই মুশকিল। যা বোঝা যাচ্ছে, রাতে না খাইয়ে ছাড়বে না। কথায় কথায় সেক্রেটারির ভাই শুনিয়ে গেল, রাতের জন্য খাঁসি আনা হয়েছে। কিন্তু তাহলে তো অনেক রাত হয়ে যাবে।
সেক্রেটারি কিছুতেই শুনবেন না। আরে দাদা। গাড়ি আছে তো। আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে আসবে। আপনি খেয়ে যাবেন। বৌদির জন্য কিছু নিয়ে যাবেন। আপনি আমাদের অতিথি। অতিথিকে কেউ না খাইয়ে ছাড়ে!‌
তারপরই ডাকলেন নিজের মেয়েকে। ক্লাস এইটে পড়ে, নাম ঝিলিক। এতক্ষণ ধরে মেয়ের গুণের ফিরিস্তি দিয়ে চলেছিলেন বাবা। আমার মেয়ে দারুণ নাচে, পাড়ায় প্রতিবার নাচে নাম দেয়। গান করতে পারে, আবৃতি করতে পারে।
নির্জন সরকার তো আর বিয়ের পাত্র নয়। তাহলে তাঁকে মেয়ের নিয়ে এত ফিরিস্তি দেওয়ার কী আছে? তাছাড়া, এ নিতান্তই কিশোরী।
বাবার ডাকে ঝিলিক এল। বাবার আবদার, একটা রোবীন্দো সঙ্গীত গা তো। মেয়ে গাইতে শুরু করল, আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি। শেষ হওয়ার পর নির্জন বললেন, ভাল হয়েছে। মেয়েও উৎসাহ পেয়ে গেল। এবার কবিতা বলতে শুরু করল, মা গো আমায় ছুটি দিতে বল।
নির্জনেরও তখন একই অবস্থা। তাঁরও মনে হচ্ছে, কখন ছুটি পাই। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি আর মুক্তি আছে? এবার মেয়ে নাচ করবে। সিডি চালানোর তোড়জোড় চলছে। সিডি চালিয়ে নাচও হল— ঢাকের তালে কোমর দোলে, খুশিতে নাচে মন। আজ বাজা কাঁসর জমা আসর থাকবে মা আর কতক্ষণ।
কাঁসর না বাজলেও আসর যেন জমে গেছে। পাড়ার দু চারজন লোকজন হাজির। তারাও শুনে ফেলেছে, কলকাতা থেকে টিভির লোকজন এসেছে। তার ভাল লাগলেই টিভিতে চান্স পাওয়া যাবে। আরেকজন মা যেচে আলাপ করতে এল। কানে কানে বলল, আমার মেয়ে এর থেকে অনেক ভাল গায়। একবার আমাদের বাড়ি যাবেন?
নির্জনের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। মনে হতে লাগল, কেন এই সেক্রেটারির বাড়িতে এসেছিলাম। আরও কত কী হজম করতে হবে, কে জানে!‌ এরপর একে একে সবাই চলে গেল। সেক্রেটারির আবদার, সব তো নিজের চোখেই দেখলেন। নিজের মেয়ে বলে বলছি না, ওর মধ্যে একটা পোতিভা আছে। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, এখানে পড়ে থাকলে তো হবে না। আপনি যদি ওকে একটু স্টার আনন্দে ব্যবস্থা করে দিতেন।
নির্জন বললেন— এবিপি আনন্দ তো এসব অনুষ্ঠান করে না। আমাদের তো ডাকা হয় টক শোতে।
সেক্রেটারি মশাই বলতে লাগলেন, সুমনদাকে একটু ওর কথা বলবেন। আপনাদের নিয়ে যেমন অনুষ্ঠান হয়, ওদের নিয়েও তো হতে পারে। রোজ রোজ কি রাজনীতির অনুষ্ঠান ভাল লাগে? ওদের নিয়ে না হয় সকালের দিকে বা দুপুরের দিকে করুক। টিভিতে একবার গাইতে পারলেই সিনেমা বা সিরিয়ালে চান্স পেয়ে যাবে।
এবার ফোন নম্বর চাইল। এ পাবলিক তো যখন তখন ফোন করে করে জ্বালিয়ে খাবে।
আবার ভুল নম্বর দেওয়ারও উপায় নেই। এখনকার লোক খুব সেয়ানা। আগে মিসড কল দিয়ে দেখে নেয়, রিং হল কিনা। তারপর সেভ করে। এই লোকটিও সেই প্রজাতির। গাঁয়ের লোক হলে কী হবে, জ্ঞান টনটনে। নইলে কেউ পুজো উদ্বোধনের নাম করে ডেকে মেয়ের আবৃতি, গান শোনায়!‌ বাধ্য হয়ে ঠিক নম্বরটাই দিতে হল।
এ তো মহা ঝামেলা। এই মেয়ের জন্য কোথায় বলবে? কাকেই বা বলবে? আসলে, এই লোকগুলো ভাবে, নির্জন একবার বললেই বোধ হয় এবিপি বা ২৪ ঘণ্টায় ডাক পেয়ে যাবে। আরে বাবা, এসব উটকো অনুরোধ করতে গেলে কোনদিন তাঁর নামটাই কাটা যাবে। কেউ কেউ তো আবার অতি পুচ্ছপাকা। না বলে কয়ে চ্যানেলে চলে আসে। বলে নির্জন সরকারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। টক শো শেষ করে যখন বেরোতে যান, তখন দেখেন মূর্তিমান অপেক্ষা করছেন। নাও, এবার ঠ্যালা সামলাও।
একবার তো একজন এস এস সি–র অ্যাডমিট নিয়ে হাজির। টেট পরীক্ষায় তার ফেল করা ছেলেকে পাস করিয়ে দিতেই হবে। কী মুশকিল!‌ এসব আবার করা যায় নাকি? সে ছোকরাও নাছোড়বান্দা। নির্জন একবার চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলেই হয়ে যাবে। তার দু একজন বন্ধুর এভাবেই নাকি হয়েছে। চ্যানেলের লোকেদের সামনে কেউ এরকম আবদার করে! ছেলেটি এখানেই থামল না। বলে বসল, নির্জন যদি এটা করিয়ে দিতে পারেন, দু লাখ টাকা বাড়িতে পৌঁছে দেবেন।‌ বাড়িতে, পাড়ায় না হয় এটা সেটা বলে বোঝানো যায়। তাই বলে একেবারে চ্যানেলে ধাওয়া!‌ ওরা কী ভাবল? ওরা ভাবছে, নির্জন সরকার এভাবেই হয়ত চ্যানেলের নাম ভাঙিয়ে এর ওর কাছে সুপারিশ করে। সেখান থেকে কাটমানি খায়। আর একবার যদি এইসব খবর ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আর দেখতে হচ্ছে না।
এই সেক্রেটারিও আবার চ্যানেলে ধাওয়া করবে না তো? একটাই বাঁচোয়া, কলকাতা থেকে অনেকদূরে। এতটা ঝুঁকি নাও নিতে পারে। এক সেক্রেটারিকে না হয় আটকানো গেল। কিন্তু এমন কত সেক্রেটারি এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে, কে জানে!‌
*********************************
চাঁদার জুলুম সত্যিই খুব বেড়ে গেছে। পুজো কমিটিগুলো কোনও কথাই শুনতে চাইছে না। একটু চাকুরে দেখলেই পাঁচ হাজার, দশ হাজারের বিল ধরিয়ে দিচ্ছে। না দিলে নানা রকম হুমকি তো আছেই। এই অভিযোগটা মাঝে মাঝেই শুনতে হয় নির্জনকে। সেদিন গিন্নির এক মাসতুতো দিদিও বলছিল,
নির্জন, এই বিষয়টা নিয়ে কিন্তু টিভিতে বলা উচিত। একটা আলাদা অনুষ্ঠানও হওয়া উচিত। জানো, সেদিন আমাদের আবাসনের পুজোয় পাঁচ হাজার টাকার রসিদ ধরিয়ে দিল। দুদিনের মধ্যে নাকি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। নইলে নানা রকম সমস্যা তৈরি হবে। খোদ আবাসনের সেক্রেটারি মিষ্টি সুরে এমন হুমকি দিয়ে গেল। গতবারও চাঁদা ছিল তিন হাজার টাকা। একধাক্কায় সেটা পাঁচ হাজার হয়ে গেল?
নির্জন কী বলবেন, বুঝতে পারেন না। আমতা আমতা করে বললেন, এটা একটা আবাসনের সমস্যা। এটা নিয়ে সরকার কী করবে?
সেই দিদিও শোনার পাত্রী নন। বলেই বসলেন, যাই বলো, আগে কিন্তু এই জুলুমটা ছিল না। বাম জমানার কথা বলছি, তখন কিন্তু পাঁচশো–ছশো টাকা দিলেই হয়ে যেত। সেটা দিতে গায়েও লাগত না। এই সরকার আসার পর প্রথম দু–এক বছর ব্যাপারটা তেমন বাড়েনি। অথচ দারুণ জাঁকজমক হয়েছিল। মনে মনে সাধুবাদই জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর থেকেই লাগামছাড়া চাঁদা বাড়তে লাগল।
পাশ থেকে মৈত্রেয়ী ফোড়ন কাটল— প্রথম দু বছর কেন চাঁদা কম ছিল, সেটা জানো? তখন সারদা–রোজভ্যালি ছিল। পাড়ায় পাড়ায় ছোট চিট ফান্ড ছিল। তারাই টাকা জোগাত। তাই সাধারণ লোকের কাছ থেকে চাঁদা তোলার দরকার পড়ত না। এখন তো আর সেসব নেই। এরা তো হাসের ডিমে সন্তুষ্ট নয়। গোটা হাসটাকেই কেটে ফেলতে চায়। তাই, সুদীপ্ত সেনরা জেল খাটছে। আর আমার কর্তাটি বলেন, সিপিএমের আমলেই চিটফান্ডের জন্ম। ওই এক বুলি শিখেছে।

এ যেন সাঁড়াশি আক্রমণ। একদিকে শ্যালিকা, একদিকে গিন্নি। শ্যালিকা তবু ব্যক্তিগত আক্রমণ করেনি। গিন্নি তো সরাসরি তাঁকেও টেনে আনল। এমন কত গৃহযুদ্ধ যে রোজ নিঃশব্দে লড়তে হয়!‌ টিভিতে তো তবু পাল্টা তর্ক করা যায়। কিন্তু বউয়ের সঙ্গে তর্ক করে কে কবে জিতেছে?‌
তাছাড়া, কথাটা যে তাঁরা খুব ভুল বলছেন, এমনও তো নয়। চাঁদা, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট সবই একলাফে অনেকটা বেড়ে গেছে। নির্জনকে চ্যানেলে বসে বলতে হয়, ‘৩৪ বছরে এগুলো ডালপালা বিস্তার করেছে। এত তাড়াতাড়ি সমাজ থেকে এগুলো মুছে ফেলা যাবে না। তবু প্রশাসন তৎপর। আইন আইনের পথে চলবে।’ কিন্তু বাস্তবটা তো তা নয়। আইন মোটেই আইনের পথে চলে না। চলতে দেওয়া হয় না। আইনকে নিয়ন্ত্রণ করছে মাতব্বরেরা।

এ ব্যাপারে নির্জনের অভিজ্ঞতাও তো কম নয়। তখন নির্জন সদ্য চ্যানেলে যাওয়া শুরু করেছেন, তখনও সারদা কাণ্ড সামনে আসেনি। তখনও পুজো কমিটিগুলো তাকিয়ে থাকত চিটফান্ডে মালিক বা এরকম ভুঁইফোড় ব্যবসায়ীদের দিকে।
নির্জনকে হঠাৎ পাশের পাড়ার পুজো কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা করে দেওয়া হল। নির্জন জানেনও না। কার্ডে তাঁর নাম ছাপা হয়ে গেল। পরিচয় হিসেবে লেখা হল টিভি ভাষ্যকার। নির্জন মৃদু আপত্তি জানালেন। কিন্তু পটাদা শুনলে তো! ‌বলল, তোমাকে থাকতেই হবে।
নির্জন ভেবেছিলেন, তাঁকে হয়ত সম্মান দেখানো হচ্ছে। পরে বুঝেছিলেন আসল মতলবটা। একদিন সকালে পটাদা হাজির। বলল, নির্জন, আজ কিন্তু সন্ধেবেলায় দু–তিনটে জায়গায় যেতে হবে। একটু কালেকশানে বেরোতে হবে।
নির্জন বলতে চাইলেন, আজ তো একটা কাজ আছে।
পটাদা বলে বসল, ওসব কাজ অন্যদিন হবে। আজ তোমার কথা দু জায়গায় বলা আছে। তুমি আমাদের পুজোর উপদেষ্টা। দু একদিন সময় দেবে না?
— সময় না হয় দেব। কিন্তু কী করতে হবে?
— সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। দু এক জায়গায় আমাদের সঙ্গে যাবে। তাতেই কাজ হয়ে যাবে। বাকি যা বলার, আমরা বলে দেব।

সন্ধেবেলায় গাড়ি নিয়ে হাজির পটাদা। হাতে দুটো মোবাইল। এত পারফিউম লাগিয়েছে, দূর থেকে গন্ধ আসছে। নিয়ে এল ক্যামাক স্ট্রিট এলাকার একটা ঝাঁ চকচকে অফিসে। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এক কোম্পানির এমডি–র কাছে। সে তো নির্জনকে দেখেই আপ্যায়ন করতে শুরু করল। নিমেষে ঠান্ডা পানীয়, স্ন্যাক্স চলে এল। বোঝা গেল, লোকটার পেটে বিশেষ বিদ্যেবুদ্ধি নেই। নানা রকম ব্যবসার কথা শোনালো বটে, কিন্তু যা বোঝা গেল, আসল ব্যবসা মানি মার্কেটিং।
লোকটা এখন থেকেই বড় বড় স্বপ্ন দেখে। একবার বলছে, মোহানবাগান ক্লাবটা কিনে নেব। একবার বলছে, অমুক চ্যানেলটা কিনে নেব। কত টাকা দিলে এবিপি আনন্দ থেকে সুমনকে ভাঙিয়ে আনা যাবে, সেসবও ভেবে রেখেছে। কাগজও খুলতে চায়। কোন কোন সাংবাদিককে নেবে, ভেবে রেখেছে। স্পোর্টসে নাকি একসঙ্গে দেবাশিস দত্ত আর গৌতম ভট্টাচার্য। একজন ম্যাচরিপোর্ট করবে, একজন ইন্টারভিউ করবে। ফিল্ম প্রোডিউস করতে চায়। সুচিত্রা সেনকে নাকি একটা ছবির জন্য হলেও ফিরিয়ে আনতে চায়। সুচিত্রার উল্টোদিকে অমিতাভ। এখানেই থামল না, বলে ফেলল সামনের বছর আইপিএলের টিম কিনতে চায়। সেই টিমে কোন কোন প্লেয়ারকে নেবে, তাও ঠিক করে ফেলেছে। আরও নানারকম পরিকল্পনার ফিরিস্তি।
নির্জন বুঝতে পারলেন, এসব কোনওটাই হবে না। কারণ, লোকটা কোনওকিছুই বোঝে না। হাওয়ায় ভাসে, হাওয়ায় স্বপ্ন দেখে। আরে বাবা, স্বপ্ন দেখতে গেলেও যে পায়ের তলায় শক্তি জমি লাগে, একটু বিদ্যেবুদ্ধি লাগে, সেগুলো এদের কে বোঝাবে!

পটাদা এসেছে অন্য মতলবে। তাই সে সমানে তোল্লাই দিয়ে গেল। শৈবালদাকে আজকে কেউ চেনে না। একদিন আসবে, যেদিন সবাই চিনবে। ধীরুভাই আম্বানিও এভাবে ছোট করেই শুরু করেছিল। কিন্তু তারপর সে কোথায় পৌঁছে গেল। সাহারার সুব্রত রায়, এখানে কেউ পাত্তাই দিত না। কিন্তু কোথায় পৌঁছে গেল। আজ তার পেছনে নেতা, মন্ত্রী, ফিল্মস্টার, ক্রিকেটাররা লাইন লাগায়। তার টাকায় ইন্ডিয়ার ক্রিকেট চলে।
শৈবাল হাজরাও দিব্যি মুচকি মুচকি হাসছে। তারা এসব কথাই শুনতে অভ্যস্থ। এসব কথাই শুনতে চায়। আসলে, হাতে টাকা এসে গেলে প্রচুর স্তাবক জুটে যায়। তারাই এইসব উদ্ভট উদ্ভট বুদ্ধি মাথায় ঢোকায়। একেকজন একেকরকম পরিকল্পনার কথা শোনায়। আর এই হঠাৎ বড়লোক হওয়া লোকগুলোও ভাবে, একদিন সে সত্যিই এতকিছুর মালিক হবে। সেও স্বপ্নের রাজ্যে ভাসতে শুরু করে। আর এই সুযোগটাই নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ক্লাব, পুজো কমিটি।

এবার পটাদা আসল কথায় এল। আমাদের পুজো কমিটিতে আপনাকেও কিন্তু অ্যাডভাইসার রেখেছি। অনেক ফিল্মস্টারকে আনার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন চ্যানেল আসবে। এই তো, নির্জনদা এসেছে। আর নির্জনদার সঙ্গে সব চ্যানেলের কেমন সম্পর্ক, তা তো আপনি জানেন। নির্জনদা সঙ্গে থাকা মানেই এসব পুজোর কভারেজ মাস্ট। আপনিও উদ্বোধনে থাকবেন। নির্জনদাও থাকবে। সব চ্যানেলে দেখাবে। আরও নানা ব্যাপারে নির্জনদাকে পাশে পাবেন। আপনার মিটিংগুলোয় নির্জনদাকে গেস্ট করে আনতে পারেন। নির্জনদা থাকা মানেই সরকার আপনার পাশে। নেতা–মন্ত্রী কেউ ঘাঁটাতে পারবে না।
শৈবাল হাজরা বেশ মন দিয়েই কথাগুলো শুনছিল। এবার বোঝা গেল পটাদার মতলবটা। তার মানে, নির্জনকে নিছক সম্মান জানাতে উপদেষ্টা করা হয়নি। জায়গামতো নির্জনের নামটাকে ব্যবহারও করতে শুরু করেছে। নির্জনই তাদের কাছে টোপ। নির্জনকে দেখিয়ে এইসব লোকের কাছে পৌঁছতে চায়।
অবশ্য, তখন নির্জনও এর মধ্যে তেমন আপত্তির কিছু খুঁজে পাননি। যদি তাঁর পরিচিতিকে একটু কাজে লাগিয়ে দু–একটা স্পন্সর আনা যায়, মন্দ কী! ‌তাছাড়া, পটাদার মতো লোকেদের জন্য এইসব লোকের সঙ্গেও পরিচয় হয়ে যাচ্ছে। কে বলতে পারে, এই শৈবাল হাজরা হয়ত সত্যিই বড় কিছু হয়ে উঠতে পারে। সত্যিই হয়ত, আই পি এলের টিম কিনে ফেলতে পারে। তখন অন্তত টিকিট পেতে সমস্যা হবে না। এত লোক টিকিটের জন্য জ্বালাতন করে, নির্জন জানেন না, কীভাবে তাঁদের জন্য টিকিট জোগাড় করবেন। তবু একে তাকে বলে দু একটা জোগাড় হয়। কিন্তু এক লোককে তো বারবার বলা যায় না। সেখানে শৈবাল হাজরার মতো লোক যে খাতির করতে শুরু করেছে, মাঝে মাঝে টিকিটের আবদার করাই যাবে। আর এই লোক যদি সত্যিই চ্যানেল খোলে, তাহলে এক্সপার্ট হিসেবে নির্জন সরকারের কদর আরও বাড়বে। তখন কে কে চ্যানেলে আসবে, এমনকী কে সঞ্চালক হবে, সেটাও নির্জন সরকার ঠিক করবে। তাই সবমিলিয়ে শৈবাল হাজরার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নির্জনেরও বেশ ভালই লেগেছিল।

সেবার শৈবাল হাজরা ওই পুজো কমিটিকে লাখ দশেক টাকা দিয়েছিল। উদ্বোধনেও এসেছিল। নির্জনকে বলে গিয়েছিল, আপনি মাঝে মাঝে অফিসে আসুন। নানা বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু পরে নির্জনের আর যাওয়া হয়নি। তারপরই সারদা কাণ্ড। একে একে সব কোম্পানির ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল। কেউ জেলে, কেউ পলাতক।
পটাদার এই সব লোকের সঙ্গে খাতির ছিল। এটা সেটা বুঝিয়ে, টাকা আদায় করে আনতে পারত। এই কারণেই পটাদাকে সেক্রেটারি করা হয়েছিল। কিন্তু এই সব কোম্পানি যখন পাততাড়ি গোটাল, পটাদার প্রভাবও কমে এল। খবর ছড়িয়ে গেল, ক্লাবের নাম ভাঙিয়ে পটাদা এমন নানা কোম্পানির কাছ থেকে টাকা তুলেছে। কিছুটা ক্লাবকে দিয়েছে, বাকিটা নিজের পকেটে পুরেছে। এই অবস্থায় পটাদাকে রাখলে ক্লাবের বদনাম হবে, এই ভেবে পটাদাকে সরিয়ে দেওয়া হল।
পরের বছর নতুন সেক্রেটারি নিতাইদা। সেও নির্জনকে উপদেষ্টা রেখেছিল। কিন্তু এবার ফল হল উল্টো। নিতাইদার তেমন যোগাযোগ নেই। সে শিল্পপতিদের কাছ থেকে বা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তেমন টাকা আনতে পারবে না। সে নাকি মিটিংয়ে বলেছিল, লিফটে নয়, সিঁড়িতে উঠতে হবে। ব্যবসায়ীরা আজ আছে, কাল নেই। কিন্তু যারা এলাকায় থাকে, তারা প্রতিবছরই থাকবে। তাদের কাছ থেকেই টাকা তোলার অভ্যেস করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে লোকাল কালেকশন থেকেই অর্ধেকের বেশি টাকা তুলে আনতে। তাই সবার ঘরে ঘরে যেতে হবে। কে কী চাকরি করে, কত মাইনে পায়, তার একটা লিস্ট করতে হবে। সেই অনুযায়ী চাঁদার রেট ঠিক করতে হবে।
একদিন চার পাঁচজন ছোকরা হাজির রসিদ বই নিয়ে। নির্জন সরকারের নামে একটা দশ হাজার টাকার রসিদ কেটে দিল। নির্জন বললেন, আমি সাধারণ স্কুল মাস্টার। এত টাকা দেব কীভাবে?
ছেলেগুলো কিছুই শুনতে চায় না। তাদের কথা, এবার তো কোম্পানিগুলো নেই। তাই অনেক কষ্ট করে, ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলতে হচ্ছে। আপনাকেও দু একদিন আমাদের সঙ্গে বেরোতে হবে। আপনাকে অনেকে চেনে, আপনার একটা ফেসভ্যালু আছে।
নির্জন বললেন, গতবার তো আমি হেল্প করেছিলাম। কিন্তু এভাবে ঘরে ঘরে যাওয়া সম্ভব নয়।
ছেলেগুলো বলল, রোজ তো যেতে বলছি না, দু একদিন যাবেন। তাহলেই হয়ে যাবে। আর আপনাদেরও চাঁদা দিতে হবে।
— হ্যাঁ, দেব। তাই বলে দশ হাজার!‌
— টিচারদের রেট পাঁচ হাজার। আপনি তো শুধু টিচার নন। আপনি টিভি স্টার। এবিপি–২৪ ঘণ্টা থেকে অনেক মাল পান। আরও নানা দিকে অনেক কামান। এদিক ওদিক অনেক কাটমানি পান। আমরা সব খবর পাই। আপনাকে তো কম রাখা হয়েছে। ওটা পঞ্চাশ হাজার রাখা উচিত ছিল।
নির্জন বলার চেষ্টা করলেন, না ভাই, চ্যানেলে আমরা টাকা পাই না। ওরা আমন্ত্রণ জানায়। আমরা যাই। মাঝে মাঝে হয়ত গাড়ি পাঠায়। তাছাড়া, আমার কোনও সাইড ইনকাম নেই। এমনকী টিউশনিও পড়াই না।
এক ফাজিল ছোকরা বলে উঠল, পড়ালেই কে পড়বে আপনার কাছে? রোজ তো ওই একই বাতেলা ঝাড়েন। এমন আমরাও ভাঁট বকতে পারি। টিভিতে কোনও লাইন আছে, নিশ্চয় কারও সুপারিশ আছে, তাই ডাক পান। আমরা সব জানি।

নির্জনের ইচ্ছে হল, ছেলেটাকে আচ্ছা করে দুটো চড় কষাতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, ঠিক আছে ভাই, তুমিও লাইন কোরো। তুমিও চ্যানেলে গিয়ে ভাঁট বোকো। আমার শুভেচ্ছা রইল।
তখন আরেকজন ছোকরা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করল, দাদা, আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আপনি আগেরবার হেল্প করেছিলেন। এবারও একটু পাশে থাকবেন। বুঝতেই পারছেন, সবার কাছেই কালেকশন করা হচ্ছে। এবার তো সারদা, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ কোনওকিছুই নেই। তাই আপনারাই ভরসা। আপনি দশ হাজার দিলে সেটা আমরা আরও দশজনের কাছে বলতে পারব। তারাও দেবে। আপনারা যদি গুটিয়ে থাকেন, তাহলে পুজোটা করব কীভাবে?
— তাই বলে এভাবে জুলুম করে? কই, আগে তো এত টাকা লাগত না?
— কী করবেন দাদা। সবকিছুর রেট বেড়েছে। বাজেট বেড়েছে। ফিল্মস্টার আনতে কত খরচা। প্যান্ডেল, লাইট, সাউন্ড সিস্টেম, হোর্ডিং, প্রসাদ — কত খরচ বলুন তো!‌ গৌরী সেনরা তো নেই। পাবলিকের কাছেই যেতে হচ্ছে।
— সব বুঝলাম, তাই বলে এতখানি বোঝা চাপিয়ে দেবেন? আগে তো এমনটা ছিল না।
— আপনিই তো বলেন। আগে অনেককিছু খারাপ ছিল। এখন অনেককিছু ভাল হয়েছে। মানুষ উৎসবে সামিল হয়েছে। সরকারি উৎসবে কত কোটি কোটি টাকা উড়ছে, জানেন?‌ সরকার উৎসব করছে, আমরা একটু করব না?
এ ছোকরাগুলো আসলে কারা? সিপিএম নাকি তৃণমূল? কী জানি, সিপিএম থেকে কনভার্টেড তৃণমূল হতে পারে। একইসঙ্গে যুক্তিও আছে আবার জুলুমবাজিও আছে। এদের ইদানীং বলা হচ্ছে, লাল তৃণমূল।
বোঝাই গেল, এদের চাঁদা না দিলে নানারকম জুলুম চলবে। যাঁদের হয়ে নির্জন সরকার টিভিতে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের হাতেই কিনা নিগৃহীত হতে হবে? তখন তো কাউকে কিছু বলাও যাবে না। চ্যানেলে বামেরা আওয়াজ দেবে, ‘নির্জন এখানে যাদের হয়ে কথা বলছে, তাদের হাতে তাকেও মার খেতে হয়েছে। এরা এতটাই বেপরোয়া, নিজেদের লোককেও ছাড়ছে না।’
এসব কথা যখন চ্যানেলে উঠে আসবে, সেটা খুব অস্বস্তিকর ব্যাপার হবে। পাড়ার ব্যাপারটা আর পাড়ার থাকবে না। সবাই জেনে যাবে। তখন সেই সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা।
তার থেকে বাপু চাঁদা দিয়ে দেওয়াই ভাল। দশ হাজারের চাঁদা পাঁচ হাজারে রফা করেছিলেন নির্জন। অনেকটা টাকা দিয়ে শান্তি কেনার মতো। সেই থেকে নির্জনের রেট পাঁচ হাজার। দিয়ে দিলে ঝামেলা মিটে যায়। নির্জনও ওদের ঘাটান না। ওরাও নির্জনকে ঘাটায় না।
তাই জুলুম নিয়ে বড় শ্যালিকা যেটা বলছে, ভুল বলছে না। নির্জন নিজে সেটা সবথেকে ভাল বোঝে। কিন্তু মুশকিল একটাই, এগুলো স্বীকার করা যায় না।
নিঃশব্দে হজম করতে হয়।

***********************
নির্জন কি ক্রমশ একপেশে হয়ে পড়ছেন? তাঁর যুক্তিগুলো কি কিছুটা দালালির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে? মাঝে মাঝেই এগুলো ভাবায়। এর জন্য অনেকের কাছে নানা কথাই শুনতে হয়। সবাই হয়ত সামনাসামনি বলে না। সামনে ‘দারুণ বলেছেন’, ‘আপনাকে টিভিতে প্রায়ই দেখি’ এই জাতীয় খুশি করা কথাই বলেন। কিন্তু আড়ালে তাঁরা ঠিক কী বলছেন?
যেমন সেদিন অটোতে। এক সহযাত্রী চিনতে পারলেন। প্রথমে টুকটাক দু এক কথা বললেন। তারপর সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন, আচ্ছা, আপনারা কি তৃণমূল থেকে টাকা পান? আপনাদের কি উল্টোপাল্টা কথা বলার ট্রেনিং দেওয়া হয়?‌
নির্জন বললেন, টাকা দিতে যাবে কেন? আমার যেটা মনে হয়, সেটাই বলি।
সেই সহযাত্রী বলে বসলেন, আপনার মনে হয় না, আপনি দালালি করছেন! সারদা–নারদা এত কাণ্ডের পরেও মনে হয় না একটু সমালোচনা করা দরকার? একের পর এক কলেজে হামলা হচ্ছে, অধ্যাপকরা মার খাচ্ছে, তারপরেও আপনারা নিন্দা করবেন না?‌ কথায় কথায় সেই ৩৪ বছর টেনে আনবেন?‌ কলকারখানা হচ্ছে না, চাকরি–‌বাকরি নেই, এরপরেও এদের হয়ে যুক্তি সাজাতে ভাল লাগে? আপনাদের কি মেরুদণ্ড–বিবেক এসব কিছুই নেই?

রাতে বাড়ি ফিরে নির্জন নিজেও ভাবছিলেন, স্কুলের অরিন্দম না হয় তাঁকে ঈর্ষা করে। সে না হয় নির্জনকে ছোট করে আনন্দ পায়। কিন্তু অটোর এই সহযাত্রী তো ঈর্ষা করে না। তার তো নির্জনের সঙ্গে আলাপও নেই। যেটা বলল,সেটা তার মনেরই কথা। তার মানে, এটা আরও অনেকেরই মনের কথা। অনেকেই তাঁর সম্পর্কে এমনটাই ভাবে।
নির্জন মাঝে মাঝেই ভাবেন, চ্যানেলে না হয় তিনি তৃণমূলের অঘোষিত প্রতিনিধি। তাদের হয়েই যুক্তি সাজাতে হবে। কিন্তু ঘরে বা পাড়ায় তো সেই দায় নেই। সেখানে তো যেটা মন থেকে বিশ্বাস করেন, সেটা বলাই যায়। কিন্তু পরে মনে হয়, চ্যানেলে তিনি যেমন, সেই ছবিটাই ধরে রাখতে হবে। পাড়ায় বা স্কুলে আলাদা সত্ত্বা দেখাতে গেলে বিড়ম্বনা আরও বাড়বে। সেখানে যদি এমন আক্রমণ চলতে থাকে, তাহলে দুটো উপায়। হয়, যা বলছে মেনে নাও। নইলে এখানেও চ্যানেলের মতো এঁড়ে তর্ক চালিয়ে যাও। তিনি যে এঁড়ে তর্ক করেন, এটা অনেকেই অভিযোগ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে নির্জন নিজেও সেটা মানেন। কিন্তু উপায় কী? আসামীপক্ষের উকিল জানে, তার মক্কেল অপরাধী। তবু তাকে মক্কেলের হয়েই কথা বলতে হয়। খুনের আসামী জানার পরেও তার জামিনের দাবিতে লড়তে হয়। তাকে বেকসুর খালাসের জন্য যুক্তি দেখাতে হয়। নির্জনের কাজটাও তো অনেকটা সেরকমই। সরকারের ভাল কাজগুলোকে ঢাক পিটিয়ে বলা। যখন মারাত্মক কোনও খারাপ ঘটনা ঘটবে, যখন সমালোচনার ঢেউ উঠবে, তখন সেই সুরটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। হয় কন্যাশ্রী, যুবশ্রী এসব বলে সাফল্যের ফিরিস্তি শোনাও। নইলে চলে যাও সেই ৩৪ বছরের কাসুন্দিতে। মোদ্দা কথা, এটা–সেটা বলে আলোচনাটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দাও। দিদিমণি নিজেও এটাই করেন।
ফুটবলে একজন ডিফেন্ডারকে যেমন করতে হয়!‌ বিপক্ষের স্ট্রাইকার গোল করতে এগিয়ে আসছে। হয় তার পা থেকে বল কেড়ে নাও। নিজের প্লেয়ারের দিকে পাশ বাড়িয়ে দাও। নইলে, স্ট্রেট উড়িয়ে দাও। অন্তত তখনকার মতো বিপদ থেকে তো উদ্ধার পাওয়া গেল। এমনকী তাও যদি না হয়, তখন মৃদ্যু ট্যাকল বা ফাউলও চলতে পারে। বিশ্বের তাবড় তাবড় স্টপারকেই তো তাই করতে হয়। নির্জন সরকারও তো আসলে সেই ডিফেন্ডার। বিপক্ষের পা থেকে কখনও সুন্দরভাবে বল কেড়ে নাও। কখনও উড়িয়ে দাও। কখনও ট্যাকল করো। একেকদিন তোমার একেকরকম স্ট্র্যাটেজি হবে।
কিন্তু ইদানীং নির্জন ফাউল করার রাস্তায় হাঁটেন না। অর্থাৎ অন্যের কথার মাঝে ডিস্টার্ব করেন না। আগে করতে হত। অন্য কেউ বললে, মাঝখানে এমন কিছু উক্তি করতেন, যেন তার তাল কেটে যায়। সেও উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করে।
নির্জন ছাড়াও অনেকেই তো শাসকপক্ষের হয়ে নানা চ্যানেলে যায়। তারা এই রাস্তাতেই হাঁটে। এমনকী রামনারায়ণবাবুর মতো প্রাক্তন অধ্যাপক, তিনিও মাঝখানে এমন অবান্তর চিৎকার করেন, বাকিরা বলতেই পারেন না। কেউ কিছু বললেই মাথা নিচু করে ডান হাত উপরে তুলে ‘না না, এটা মানছি না’ বলে চিৎকার শুরু করে দেন। আর মুচকি মুচকি হাসেন। শাসকের তাঁবেদারি করা একটি রদ্দি কাগজ পড়ে আসেন। আর সেইসব ভুলভাল তথ্য ও যুক্তি আউড়ে যান। বোঝা যায়, প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন অধ্যাপক ওই দু একটা বাজারি কাগজ ছাড়া তেমন কিছুই পড়ছেন না।
নির্জন অন্তত তেমনটা করেন না। হ্যাঁ, যখন নতুন নতুন চ্যানেলে যেতেন, তখন তিনিও বাধা দিতেন। বয়স তাঁকে শিখিয়েছে, পরিস্থিতি তাঁকে শিখিয়েছে, এমনটা করতে নেই।
আরও একজন শিখিয়েছিলেন। সুখেন্দুকাকু। নির্জনের বাবার বন্ধু ছিলেন। একসময় শিক্ষক রাজনীতি করতেন। বামমনষ্ক। তবে অন্ধ বাম নন। গঠনমূলক সমালোচনাও করেন। বেশ পড়াশোনা করা মানুষ। তিনি একদিন নির্জনকে ডাকলেন।
একথা–সেকথার পর বললেন, ‘যত সময় এগোবে, তুমি আরও পরিণত হবে। তখন তোমার যুক্তির ধার বাড়বে। তখন নিজেই বুঝতে পারবে, এখন যে গুলো বলছ, সেগুলো খুব লঘু যুক্তির হয়ে যাচ্ছে। আজ তুমি অন্যদের থামিয়ে দিচ্ছো। বলতে দিচ্ছো না। হয়ত মনে মনে আনন্দও পাচ্ছো। কিন্তু একদিন এটা তোমার ওপর প্রয়োগ হবে। মনে রাখবে, যারা আলোচনা শুনতে চায়, তারা শুধু চিৎকার–চেঁচামেচি দেখতে চায় না। বরং বিরক্ত হয়। তারা দুটো সুন্দর যুক্তি শুনতে চায়। তুমি কাদের হয়ে বলছ? তোমাকে বামপন্থীদের হয়ে বা বিজেপির হয়ে বলতে বলছি না। নিরপেক্ষও হতে বলছি না। তুমি যেটা বলতে এসেছো, সেই পক্ষেই বলবে। কিন্তু সেটা যেন একেবারে একপেশে মনে না হয়। তার মধ্যেও যেন যথেষ্ট যুক্তি থাকে। কারা তোমার অনুষ্ঠান দেখে? যারা এসব বিষয়গুলো নিয়ে ভাবে। চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায়, স্কুলে, অফিসে আলোচনা করে। যারা ফেসবুক, টুইটারে নিজেদের মতামত তুলে ধরে। তারা তোমার যুক্তির মধ্যে নিজেদের যুক্তি খুঁজে পাবে। তারাও তোমার মতোই হয়ত তৃণমূলের পক্ষে। কিন্তু তাদের হাতের সামনে যুক্তি থাকে না। যুক্তি থাকে না বলে তারা কথা বলতে পারে না। পিছিয়ে যায়, এড়িয়ে যায়। মনে রাখবে, একটা বিরাট অংশের লোক কিন্তু তোমার কথা শুনছে। তোমার সুন্দর একটা যুক্তি তাদের মনেও ঝড় তুলছে। তারা রাতে যেটা শুনল, সকালে চায়ের দোকানে সেটাই উগরে দিতে চায়। পরেরদিন স্কুলের কমনরুমে সেই যুক্তিটাই তুলে ধরতে চায়। তাই তোমাকে যেন তারা শ্রদ্ধা করতে পারে, সেটা তোমাকেই নিশ্চিত করতে হবে।
ভারী সুন্দরভাবে কথাগুলো বুঝিয়ে ছিলেন সুখেন্দুবাবু।
বলেছিলেন, লোককে জিজ্ঞাসা করো, পার্লামেন্ট বা অ্যাসেম্বলিতে কী হয়? লোকে বলবে, ওখানে শুধু হইহল্লা হয়, চিৎকার হয়। হ্যাঁ, বিধানসভা বা লোকসভাকে এই জায়গায় আমাদের রাজনীতিকরাই নিয়ে গেছেন। কিন্তু মনে রাখবে, সেখানে খুব উচ্চমার্গের আলোচনাও হয়। চিৎকারটা সাময়িক, তাদের কেউ মনে রাখে না।
তৃণমূল যখন বিরোধী ছিল, বেশিরভাগ লোকই চিৎকার করত। কিন্তু মনে রাখবে, একজন সৌগত রায়ও ছিলেন। যাঁর কথা সবাই মন দিয়ে শুনত। কত অজানা দিক তুলে ধরতেন। কত অজানা তথ্য, কী সুন্দর যুক্তির বিন্যাস। কংগ্রেসের বেঞ্চে মানস ভুঁইয়া, জয়নাল আবেদিন। রীতিমতো পড়াশোনা করে, তৈরি হয়ে আসতেন। মনে রাখবে, জ্যোতিবাবু বা বুদ্ধদেববাবু কিন্তু চিৎকার করা লোকদের পাত্তা দিতেন না। পাত্তা দিতেন সৌগত রায়, মানস ভুঁইয়া, জয়নাল সাহেবদের। গুরুত্ব দিতেন তাঁদের যুক্তিনিষ্ঠ সমালোচনাকে। টিভিটাও তেমনই একটা মঞ্চ। এখানেও লক্ষ লক্ষ মানুষ শুনছেন। তোমার কথা তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অনেকে নাম জানছে। চিনছে। মনে রাখবে, তোমার কিন্তু দায়িত্ব বেড়ে গেল। অন্যকে থামিয়ে দেওয়া, চিৎকার করা কিন্তু তোমাকে আর মানায় না। এখন তোমার কাছে তারা অনেক বেশি দায়িত্বশীল কথাবার্তা ও আচরণ প্রত্যাশা করে। ভাল তার্কিক কারা জানো, যারা অন্যের কথা মন দিয়ে শোনে। তুমি যদি অন্যের কথা শোনো, তবেই অন্য লোক তোমার কথা শুনবে। যদি তা না শোনো, একদিন দেখবে তোমাকেও অন্যরা বলতে দিচ্ছে না।
এখানেও হোমওয়ার্ক করতে হবে। দু একটা বাজারি কাগজ পড়ে, ফেসবুকের দু একটা চুটকি উগরে দিয়ে বা দু একটা সস্তা স্লোগান আউড়ে কিছু বোকা লোকের বাহবা পাওয়া যায়। কিন্তু ধরো, তোমার মতোই কোনও শিক্ষক দেখছেন। তিনি কী ভাববেন? তিনি তো মনে করবেন, আমি এর থেকে ঢের ভাল বলতে পারি। তখন তাঁর কাছে তোমার সম্পর্কে শ্রদ্ধা থাকবে না। এমন কিছু বলো, যেটা সবাইকে ভাবাবে। মনে হবে, এটা তো আমি জানতাম না। লোকে তোমার কথা শুনতে চাইবে। মনে হবে, এই লোকটা আজ নিশ্চয় নতুন কিছু বলবে। মনে হবে, আমি কেন এরকমভাবে ভাবতে পারি না!‌
সুখেন্দুবাবুর কথাগুলো নির্জনের মনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। মন দিয়েই সবটা শুনেছেন। এমন মানু্ষেরা কাছে এলে অনেককিছুই শেখা যায়। এঁরা হলেন সত্যিকারের শুভাকাঙ্খী, যাঁরা স্তাবকতা করেন না। ভুলটাকে ধরিয়ে দিতে জানেন, ভাল হলে পিঠে হাত রেখে উৎসাহ দিতেও জানেন। সেদিন নির্জনের হাতে বেশ কয়েকটা বই তুলে দিয়েছিলেন সুখেন্দুবাবু। বলেছিলেন, আমার তো উপরে যাওয়ার সময় হয়ে এল। এই বইগুলো পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চলে গেলে এগুলো কেউ পড়বে বলে মনেও হয় না। হয়ত পরে কেজি দরে বিক্রি হবে। তোমাকে কয়েকটা দিয়ে গেলাম। তুমি পোড়ো। দেখবে যুক্তির ধার বাড়বে। আর মনে রাখবে, অহেতুক স্তাবকতা করলে তুমি কারও কাছে কোনও গুরুত্ব পাবে না। এমনকী যার স্তাবকতা করছো, সেও কিন্তু তোমাকে স্তাবক হিসেবেই মনে রাখবে।
একেবারে খাঁটি কথা বলেছেন সুখেন্দুবাবু। নির্জন নিজেও দেখেছেন, যাঁদের হয়ে তিনি গলা ফাটান, তাঁরা মোটেই তেমন গুরুত্ব দেয় না। বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করে। একদিন একটা টিভি বিতর্কে অংশ নেবেন বলে শাসক দলের এক এমপি–কে ফোন করেছিলেন। কয়েকটা পয়েন্টস নিতে চেয়েছিলেন। কীভাবে বললে ভাল হয়, পরামর্শ চেয়েছিলেন। সেই সাংসদ কী উত্তর দিয়েছিলেন, মনে আছে। সেই সাংসদ বলেছিলেন, ‘তোমার মতো ছাঁটের বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে বকবক করার সময় নেই।’ কথাটায় বেশ আঘাত পেয়েছিলেন নির্জন।
আরও এক মন্ত্রীর কাছ থেকে কিছু শিখতে চেয়েছিলেন নির্জন। সেই মন্ত্রীও ব্যস্ত আছি বলে বারবার এড়িয়ে গিয়েছিলেন। যাঁদের হয়ে লড়াই করেছেন, তাঁরা ফোন করে থ্যাঙ্ক ইউ টুকু বলার সৌজন্যও দেখায়নি। অথচ, বিরোধীদের অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন। এই তো সেদিন, উল্টোদিকে ছিলেন সুজন চক্রবর্তী। একটা বিষয় নিয়ে খুব লড়াই হল। অনুষ্ঠান শেষ হতে সুজন কাছে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘এখন তুমি সত্যিই খুব ভাল বলছ। আগের থেকে ম্যাচিওরিটি অনেক বেড়েছে।’‌
তারপর হাঁসতে হাঁসতে বললেন, এখন আর কথায় কথায় ৩৪ বছর টেনে আনো না। তোমার রোগটা নিয়েছেন রামনারায়ণবাবু। উফ্‌, যাই বলি, সেই ৩৪ বছর টেনে আনেন। আগে তোমাকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতাম। কিন্তু এখন তোমার মতামতকে গুরুত্ব দিই। কারণ, তুমি সেটা ডিসার্ভ করো।’ এসব কথা শুনলে সত্যিই বেশ অনুপ্রাণিত মনে হয়। সেদিন একটা অনুষ্ঠান চলছে। বিজেপির এক নেতা বিরতির সময় মেসেজ পাঠালেন ‘ওয়েল ডান, চালিয়ে যাও।’ ওই দলের শমীক ভট্টাচার্য। কী মার্জিত কথাবার্তা। এত সুন্দরভাবেও সমালোচনা করা যায়!‌ কতটুকু বলতে হয়, কোথায় থামতে হয়, কী নিখুঁত টাইমিং!‌ অন্য অনেকের এই টাইমিংটাই নেই। একবার বলতে শুরু করলে যা মনে আসবে, তাই বলে যাবে। থামার কালচারটাই নেই। আক্রমণ করতে করতে অবান্তর সব কথা টেনে আনবেন। কিন্তু শমীকবাবু একেবারেই অন্যরকম। সমালোচনা করেন, কিন্তু কখনই সেটা ‘‌বিলো দ্য বেল্ট’ নয়। ফলে যাঁর সমালোচনা, তিনিও রাগতে পারেন না। নির্জন মনে মনে ভাবেন, যদি সত্যিই এমন মার্জিত ভাষায় কথা বলা যেত!‌ এক–‌দুবার শমীকের কাছে জানতেও চেয়েছেন। বিজেপি–‌র মার্জিত রুচির এই মানুষটি কাঁধে হাত রেখে বলেছেন, কাউকে কখনও কপি করবে না। তুমি যেভাবে বলার, সেভাবেই বলো। ওটাই স্টাইল। শেহবাগ কি কখনও রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ব্যাট করে?‌ করার দরকারই বা কী?‌ সে তার মতো খেলেই কিন্তু টেস্টে দুটো ট্রিপল হান্ড্রেড করেছে। এর জন্য তার রাহুল দ্রাবিড় হওয়ার দরকার পড়েনি। ‌
শমীকবাবুও রসিকতা করতেন। তবে তবে কখনই হেয় করেননি। সবসময় অন্যকে মর্যাদা দিয়ে কথা বলেন।
সুজনবাবু ঠিকই বলেছেন, একসময় অনেক তাচ্ছিল্য ও উপহাস পেতে হয়েছে। বিরতিতে এমনও শুনতে হয়েছে, তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে সঞ্চালককে কেউ বলছেন, এঁদের কোত্থেকে ধরে আনেন বলুন তো!‌ যাকে তাকে ধরে এনে বুদ্ধিজীবী বানিয়ে দেবেন?‌ এরা থাকলে আমাকে আলোচনায় ডাকবেন না। আমার একটা ক্লাস আছে। পাশ থেকে এক বামপন্থী অধ্যাপক–দাদা বলেছিলেন, ‘কিছু মনে করো না। এসব কথা গায়ে মাখবে না। কেউ কেউ আছে, যারা এখনও দম্ভটা ভুলতে পারছে না। তুমি কিন্তু মেজাজ হারাবে না। এদের একটু ইগনোর কোরো। দেখবে, একদিন এরাই তোমার প্রশংসা করছে।’
হয়েওছে তাই। সেই নাক উঁচু বাম নেতাও একদিন বলেছিলেন, ‘নির্জন এখন আর উল্টোপাল্টা বলে না। যেটুকু বলে, সেটুকু ওকে বলতে হয়।’ বলেই মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন করেছিলেন। নির্জন রাগ পুষে রাখেননি। গিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে।
আস্তে আস্তে টিভিকে ঘিরেও একটা পরিবার পরিবার ব্যাপার হয়ে গেছে। অনেকের সান্নিধ্যই নির্জন খুব উপভোগ করেন। যেমন আর এস পি–র অশোক ঘোষ। ঠান্ডা মাথার মানুষ। রীতিমতো পড়াশোনা করে আসেন। টিভির দৌলতে তাঁর এতটাই পরিচিতি, অনেকে অশোক ঘোষ বললে ফরওয়ার্ড ব্লকের বর্ষীয়াণ অশোক ঘোষ নয়, আরএসপি–‌র টিভি নেতা অশোক ঘোষকেই বোঝেন। ব্রিগেডে বামেদের এক সভায় নাকি তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলার, তাঁর অটোগ্রাফ নেওয়ার লাইন পড়ে গিয়েছিল। এক সাংবাদিক দূর থেকে সেই ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিল।
তবে কথা বলেন বেশ গুছিয়ে। অনেকে ঠাট্টা করে বলে, ‘অশোকদা যদি ছাত্রাবস্থায় এত পড়তেন, তাহলে কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। তখন ফাঁকি মেরেছিলেন বলেই শ্রমিক নেতা হয়ে গেছেন।’ অশোকদাও মুচকি মুচকি হাসেন। নির্জনকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখেন।
কংগ্রেসের শুভঙ্কর সরকার। টিভির আরেক অতিথি। ছাত্র–‌যুব রাজনীতি করার সময় যত না লোকে চিনত, তার থেকে ঢের বেশি লোক চেনে টিভিতে আসার জন্য। ওমপ্রকাশবাবুও ভদ্রলোক। রসবোধ আছে। কংগ্রেসের অরুণাভ ঘোষ বেশ স্পষ্টবক্তা। কাউকে রেয়াত করেন না। সবার সঙ্গেই নির্জনের সম্পর্ক বেশ ভাল। নির্জন একবার এক মক্কেলও পাঠিয়েছিলেন। অল্প টাকাতেই কেসটা হাতে নিয়েছিলেন এই আইনজীবী নেতা।
সিপিএম নেতাদের অনেকে আগে নাক সেঁটকালেও এখন বেশ স্নেহের চোখেই দেখেন। তবে সবাই নয়। যেমন, এক তরুণ সাংসদ টিভি ফ্লোরে একসঙ্গে এতক্ষণ অনুষ্ঠান করল। কিন্তু একটা কথাও বলেনি। সারাক্ষণ একটা তাচ্ছিল্যের ভাব চোখেমুখে। একদিন এল, সেই সাংসদকে দল সাসপেন্ড করল। অনেকে অনেকরকম বিচ্যুতির কথা বলল। সেদিন নির্জন কিন্তু নোঙরা আক্রমণ করেননি। গায়ের ঝাল মেটাননি। বরং, এটা তাদের দলের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
পরে সঞ্চালক হাসতে হাসতে বলেছিল, আমি তোমাকে এত সুন্দর একটা ফুলটস দিলাম। তুমি ছক্কা মারতে পারলে না!‌
নির্জন কথাটা ঠিক বুঝতে পারেননি। সেই সঞ্চালক তরুণ সাংসদের নাম করে বললেন, ও তোমাকে এত হ্যাটা করেছে। আজ তোমার সুযোগ ছিল।
নির্জন বললেন, তিন–চার বছর আগে হলে আমি হয়ত ব্যাট চালাতাম। কিন্তু এখন বুঝেছি, ওটা ঠিক নয়। একজন মানুষ বিপদে পড়েছে বলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা উচিত নয়। তাছাড়া, আমাকে যতই হ্যাটা করুক, ও এই রাজ্যের অন্যতম সেরা সাংসদ। রাজ্যসভায় যে এই রাজ্যের মুখ উজ্জ্বল করেছে। ছোট ছোট কেচ্ছাগুলো নিয়ে বেশি আলোচনা না করাই ভাল। এই সময়ে তার পাশে থাকতে না পারি, অন্তত নোঙরা আক্রমণ করব না।
আরও অনেকেই তখন ছিল। নির্জনের কথাগুলো তাদেরও মন ছুঁয়ে গেল। একজন তো বলেই উঠলেন, নির্জন, অতীতে তোমার সম্পর্কে যা যা বলেছি, ফিরিয়ে নিচ্ছি। আজ তোমাকে নতুন করে চিনলাম।
টুকরো টুকরো এমন কত মুহূর্ত মনকে ছুঁয়ে যায়!‌

*********
ছোটবেলায় নন্দনে ‘হীরক রাজার দেশে’ দেখেছিলেন নির্জন। কয়েকটা কথা খুব মনে ধরেছিল, ‘জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।’ বাড়িতে পড়তে বললেই তিনি এই লাইনগুলো আওড়াতেন। সেই ঝলমলে স্কুলজীবন আর ফিরে আসবে না। নস্টালজিয়া হয়ে মাঝে মাঝে উকি দিয়ে যায়। কী খাঁটি কথাটাই না বলে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। সত্যিই তো, এত জানার কী দরকার। জানলেই হতাশা বাড়ে, মনে হয়, এখনও কতকিছু জানা হল না।
মাঝে মাঝে ভাবেন সুমনদার কথা। তাঁকে কতকিছু জানতে হয়!‌ কখনও মহাকাশ প্রযুক্তি নিয়ে অনুষ্ঠান করছেন তো কখনও সরকারি হাসপাতালে শিশু চিকিৎসার পরিকাঠামো। কখনও পণ্ডিত রবিশঙ্করের ইন্টারভিউ তো কখনও অ্যামাজনের জঙ্গলে অ্যানাকোন্ডার বৃত্তান্ত। কখনও বন্যা, তো কখনও আফগানিস্তানে সন্ত্রাস। কখনও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, তো কখনও পুরুলিয়ার বেগুনকোদরে ভুতুড়ে স্টেশন। কত ভ্যারাইটি। কতকিছু জানতে হয়!‌ অনেকে ব্যঙ্গ করে বলে সবজান্তা সুমন। সোশাল সাইটে তাঁকে ব্যঙ্গ করে কত পোস্ট ছাড়া হয়। নির্জনকে অবশ্য এতকিছু জানতে হয় না। তাঁকে মূলত রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই ডাকা হয়। কিন্তু সেখানেও আলোচনায় কত কিছু উঠে আসে। কতকিছু জানতে হয়। না জানলেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়।
এখনকার কথা তো কাগজে অনেকেই পড়ছেন। কিন্তু যুক্তিকে জোরালো করতে পুরনো রেফারেন্স টেনে আনতেই হয়। এখানে সবজান্তা গুগুলবাবু সম্পূর্ণ অসহায়। সুমন দে বা মৌপিয়া নন্দীদের না হয় তবু রিসার্চ টিম আছে, তারাই খোঁজখবর নেয়। কিন্তু স্কুল মাস্টার নির্জনের তো রিসার্চ টিম নেই। নিজেকেই জোগাড় করতে হয়। বড়জোর হোয়াটসঅ্যাপে কেউ কেউ লিঙ্ক শেয়ার করে। যদিও বেশিরভাগই আবোল–তাবোল।
যেমন পুজোর আগেই গোর্খাল্যান্ড নিয়ে পাহাড় ফের উত্তাল। নির্জনেরও মাঝে মাঝে ডাক পড়েছে। একসময় সরকারি হোর্ডিংগুলোর মতো চওড়া হাসিতে নির্জনও বলতেন, পাহাড় হাসছে। অন্য কোনও আলোচনাতেও টেনে আনতেন পাহাড়ের কথা, জঙ্গলমহলের কথা। তুলে ধরতেন সেই সাফল্যের কথা। এমনকী কন্যাশ্রীর কথা বলতে গিয়েও কতবার পাহাড়ের কথা টেনে এনেছেন। এখন হয়েছে উল্টোটা, একেবারে পাহাড় নিয়ে আলোচনা, তাঁকে কিনা সেই প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে অন্য প্রসঙ্গের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আশির দশকে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বেও উত্তাল হয়েছিল পাহাড়। নির্জনের তখন কতই বা বয়স। তার আগের বছরই ঘুরে এসেছিলেন পাহাড় থেকে। তারপরই শুনলেন, আর দার্জিলিং যাওয়া যাবে না। কেন যাওয়া যাবে না, কী সেই আন্দোলনের পটভূমি, শিশুমনে এত জটিল প্রশ্ন আসেনি। তখন কাগজ পড়ার রেওয়াজটাও ছিল না। এখনও পাহাড়ের কতটুকুই বা কাগজে বেরোয়। দিদিমণি রেগে যাবেন, এমন কথা লেখা বারণ। এই বারণ মেনে চলাটাই যেন মূলস্রোত। অনেকে এই অলিখিত নিষেধাজ্ঞা স্বেচ্ছায় মেনেও নিয়েছে। কাগজে যেগুলো বেরোয়, সেগুলো সমতল থেকে দুদিনের বেড়াতে যাওয়া রিপোর্টারের ভুলভাল ব্যাখ্যা। আর পুচ্ছপাকা কিছু অ্যাঙ্করের ভুলভাল বিশ্লেষণ। এগুলো শুনে বা পড়ে যদি কেউ টিভিতে পাহাড় নিয়ে বলতে যায়, তাহলে সেও ভুলভাল বকতে থাকবে। নির্জনও প্রথম প্রথম কাগজ পড়েই প্রভাবিত হতেন।
স্কুলের নির্মলবাবু সেদিন বলছিলেন, নির্জন, পাহাড় নিয়ে তোমার আরও পড়াশোনা করা উচিত। তুমি যেগুলো বলছ, সেগুলো তো আমরা সবাই জানি। যেগুলো সকালে কাগজে বেরোচ্ছে, সেগুলোই গিয়ে উগরে দিচ্ছো। তাই সেগুলো পুরনো মনে হচ্ছে।
নির্মলবাবুই সন্ধান দিলেন, তুমি এক কাজ করো। একদিন সময় করে তুষার প্রধানের সঙ্গে দেখা করো। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় পাহাড়ে ছিলেন। কীসব দুর্দান্ত লেখা পাঠাতেন। পাহাড়টাকে সত্যিই দারুণ চেনেন। অসংখ্য লেখালেখি রয়েছে। অনেক অজানা দিক জানতে পারবে।
নির্জন ফোন নম্বর জোগাড় করে গিয়েছিলেন তুষার প্রধানের কাছে। পাহাড় সমস্যা কেন হচ্ছে, আগে কী চেহারায় হয়েছে, এর পেছনে কাদের স্বার্থ কাজ করছে, গোর্খা জাতিসত্তার ইতিহাস, বাইরে থেকে কোন কোন শক্তি সাহায্য করছে, জনজাতির আবেগ কতটা, গুরুংদের উস্কানি কতটা, সমাধানের রাস্তাটাই বা কী, সবকিছু জলের মতো বুঝিয়ে দিলেন। সত্যিই এক অজানা দিক খুলে গিয়েছিল। মানুষটা এতকিছু জানেন। কেউ তাঁকে সেভাবে ব্যবহার করতেই পারল না! পাহাড় নিয়ে এত চ্যানেলে এত আলোচনা, এই মানুষটাকে কেউ কোনওদিন ডাকল না!‌ ‌
ফিরে এসে মনটা যেন ভারাক্রান্ত হয়ে এল। এভাবেই নির্জন কত মানুষের কাছে ছুটে গেছেন। কত অজানা কথা জেনে এসেছেন। আগে অনেকেই পাত্তা দিতেন না। এখন নামটা কিছুটা পরিচিত। অনেকেই তাঁকে সাহায্য করেন। কিন্তু স্কুলের চাকরি সামলে এতকিছু জানার সময়টাও পাওয়া যায় না। তাছাড়া, যেটা জেনে এলেন, সবটা মনে রাখাও মুশকিল। আবার চ্যানেলের আলোচনায় উঠে এলেও এত অবান্তর চিৎকার, নিজের কথাটা গুছিয়ে বলতেও পারেননি। আবার কত বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়েও ডাক পাননি। তৃণমূল নেতারা আগে এবিপি বা ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলে যেতেন না। দিদিমণির বারণ ছিল। কিন্তু ইদানীং যাওয়া শুরু করেছেন। নেতারা যেতেন না বলে নির্জনদের সুযোগ আসত। সরাসরি নেতারা এলে নির্জনদের কদর কমে যায়। আর যদি ডাক আসেও, বলার সুযোগ কমে যায়। সত্যিই তো, শুভেন্দু অধিকারী বা সুব্রত মুখার্জি যদি বলতে আসেন, তখন কে শুনবে নির্জন সরকারদের কথা? তখন মনে হয়, এত প্রস্তুতি তো কোনও কাজেই এল না। এই যে পাহাড় নিয়ে এতকিছু খোঁজখবর নেওয়া হল, অথচ সেভাবে বলার সুযোগ এল কই? কখনও মোর্চা নেতারা চলে আসছেন, কখনও তৃণমূলের মন্ত্রী গৌতম দেব চলে আসছেন, কখনও আবার গায়ক অঞ্জন দত্ত। এখানে নিজেদের মেলে ধরার তেমন সুযোগই আসে না। আবার কোথাও কোথাও সঞ্চালক এত পাকা, অন্যদের বলতেই দেয় না। সবজান্তার মতো নিজেই পান্ডিত্য ফলাতে শুরু করে। মনে হয়, ধুর ছাই, কীসের জন্য এতকিছু জানতে গেলাম।

আবার উল্টোটাও হয়েছে। কোনও একদিন হয়ত বলার সুযোগ পেয়েছেন। দারুণ বলেওছেন। স্টুডিওতে অনেকের পিঠ চাপড়ানি পেয়েছেন। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে দারুণ দারুণ মেসেজ এসেছে। চেনা–অচেনা লোকেদের ফোনও এসেছে। বেশ আপ্লুত মনে হয়েছে। ভেবেছেন, ফিরে এসে মৈত্রেয়ীও দারুণভাবে অভ্যর্থনা জানাবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। সে সেদিন টিভির শো দেখেইনি। ‘‌কুসুম দোলা’‌, ‘‌ইচ্ছেনদী’ বা ‘‌বধূবরণ’‌‌ দেখেছে। অথবা ফেসবুকে কারও সঙ্গে চ্যাট করেছে। অথবা, মেজ মাসিমার সঙ্গে লাও–চিংড়ির রেসিপি নিয়ে বকবক করেছে।
নিজে থেকে তো কিছু বলেইনি। উল্টে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এসেছে, আমি এতসব বুঝি না। তোমার ওই রোজ ভাঁটের প্রোগ্রাম দেখা ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে।
হয়ত রাগটা অন্য কারও ওপর। মেটানো হচ্ছে বেচারা নির্জনের ওপর। টিভিতে সুন্দর সন্ধের পর বাড়িতে রাতটা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে আসে। প্রদীপের তলায় এভাবেই কত অজানা অন্ধকার থেকে গেছে!‌ সেলিব্রিটি স্ট্যাটাসের আড়ালে কত লুকোনো দীর্ঘশ্বাস থেকে গেছে, কে তার খোঁজ রাখে!‌

***************************

পোশাক অনেক কথা বলে যায়। শার্লকহোমস নাকি একজন মানুষের পোশাক থেকে তার চরিত্র বিশ্লেষণ করতেন। লোকটির লেখাপড়া কোন স্তরের, রুচি কেমন, মানসিকভাবে ফুরফুরে আছে না চাপে আছে, লোকটি অফিস বা বিশেষ কাজে যাচ্ছে কিনা, এমনকী লোকটির ব্যস্ততা কেমন।
পোশাকের ব্যাপারে নির্জনের বিরাট কোনও পছন্দ বা খুঁতখুঁতানি ছিল না। সাধারণ রুচিসম্মত পোশাকই পরতেন। নির্জন নিজেও জানেন, তিনি খুব সুদর্শন নন। আবার তাঁকে দেখলে মেয়েরা ছুটে পালিয়ে যাবে, এতটা খারাপও নন। রোজ যে দাড়ি কাটতেন, এমনও নয়। দু–তিন দিন ছাড়া ছাড়া সেভিং করতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর কিছুটা বদলে নিতে হয়েছে। গোঁফ কখনই রাখতেন না। এখন রোজই দাড়ি কাটতে হয়। কখন ডাক পড়বে, কে বলতে পারে। এমনও হয়েছে, সন্ধে ছটার সময় হঠাৎ ফোন। অমুক বিষয়ে অনুষ্ঠান, দ্রুত আসতে হবে। ওই অবস্থাতেই তড়িঘড়ি ছুটতে হয়েছে।
স্টুডিওয় আলাদা ব্লেজার দেওয়া হয়। চাইলে সেটা পরে নেওয়া যায়। ফ্রেস হয়ে নেওয়ার সুযোগও থাকে। নির্জন মাঝে মাঝে সেই ব্লেজার গায়ে দেননি, এমন নয়। তবে নিজের পোশাক পরাই ভাল। এতে একটা মানুষের রুচিটা বোঝা যায়। তাছাড়া, স্টুডিওর ব্লেজার বা পোশাকে মৈত্রেয়ীর খুব আপত্তি। সে কিছুটা ধমকের সুরেই বলে, ঘরে কি পোশাক নেই যে তোমাকে ওই মরা সাহেবের কোট পরতে হবে!‌
মরা সাহেবের কোট!‌ ছোটবেলায় নির্জনও বুঝতে পারতেন না ব্যাপারটা ঠিক কী? ধর্মতলা চত্ত্বরে শীতকালে অনেক সস্তায় কোট পাওয়া যায়। অনেকে বলে, সেগুলো ডিফেক্ট মাল। অনেকে বলে, এগুলো বিদেশ থেকে আসে। সাহেবদের মৃত্যুর পর যেসব কোট ফেলে দেওয়া হয়, সেগুলো নাকি জাহাজে করে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। খিদিরপুর ডকে সেগুলো নামে। তারপর অল্প টাকায় বিক্রি হয়। এমন কত গল্প ছড়িয়ে আছে।
মৈত্রেয়ীও তাহলে শুনেছে। নইলে সেও বারবার মরা সাহেবের কোট বলবে কেন!‌ নির্জন চ্যানেলে কী বললেন, তা নিয়ে গিন্নির তেমন আগ্রহ নেই (‌সেই সময় সে সিরিয়াল দেখাতেই বেশি মগ্ন থাকে। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে হয়ত একঝলক দেখল)‌। তবে কী পোশাক পরলেন, সেটা নিয়ে মাঝে মাঝেই পরামর্শ দেয়। কয়েকবার তো নিজেও নির্জনের জন্য আলাদা করে জামা বা টি শার্ট কিনে এনেছে। কয়েকটা পাঞ্জাবিও এনেছে। তার জোরাজুরিতেই নির্জন মাঝে মাঝে পাঞ্জাবি পরেও স্টুডিওতে যায়। নির্জন বলতেন, পোশাকে কী আসে যায়, কী বলছি, সেটাই আসল। কিছুতেই মানতে চাইত না মৈত্রেয়ী। সে বলে, দিন অনুযায়ী পোশাক পরতে হয়। অন্য যারা যায়, তাদের দেখে শিখতে পারো না?‌ অ্যাঙ্কারদের দেখেছো, তারা কিন্তু জানে, কবে কী পোশাক পরতে হয়। তোমার ওই সুমনদা যখন স্টুডিওতে ‘‌ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমন’ করে বা সিরিয়াস ইন্টারভিউ করে, তখন একরকম পোশাক। আবার যখন মান্না দে বা রবিশঙ্করের ইন্টারভিউ করে তখন অন্যরকম পোশাক। তখন ব্লেজার নয়, সে পাঞ্জাবি পরে। যেদিন যেটা মানায়।
নির্জন সেভাবে তলিয়ে দেখেননি। তবে কথাগুলো তো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তিনি না হয় অ্যাঙ্কার নন, তাই এত সাজগোজ না করলেও চলে। পয়লা বৈশাখ বা মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানেও তাঁর ডাক পড়বে না, এটাও বিলক্ষণ জানেন। তবু দিন অনুযায়ী পোশাকটাও পরা দরকার। রোজ এক কথা, এক যুক্তি আওড়ালে তা যেমন একঘেয়ে হয়ে যায়, তেমনি একই রকম পোশাক পরলে সেটাও একসময় একঘেয়ে লাগতে পারে। এখানেও একটা বৈচিত্র‌্য থাকলে মন্দ হয় না। তবে রুচিশীল বৈচিত্র‌্য। ‌
পোশাকের তালিকায় একটা জিনিস যোগ হয়েছে। হাফ হাতা জ্যাকেট। আগে নির্জন এটা পরতেন না। সাধারণ প্যান্ট–শার্ট পরেই স্কুলে পড়াতে যেতেন। কিন্তু টিভিতে যাওয়ার পর থেকে এই জ্যাকেটটা ধরতে হয়েছে। অনেকেই বলে, এতে নাকি স্মার্ট লাগে। শুধু হাফ জ্যাকেট পরলেই নাকি কথার ওজন বেড়ে যায়। তাই স্কুলে যাওয়ার সময়েও এখন জ্যাকেট পরেই যেতে হয়। আর এটা দেখেই সবাই বুঝতে পারে, আজ নিশ্চয় টিভিতে শো আছে। ছাত্ররা জানতে চায়, স্যার, আজ কোন চ্যানেলে। নির্জন জানিয়ে দেন, কখন কোন চ্যানেলে তাঁকে পাওয়া যাবে। আবার কখনও বলেন, এখনও জানি না। তবে বিকেলের দিকেও ফোন আসতে পারে।
নির্জনদের আবাসনের সামনে একটা ছোট মাঠ। পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা রাস্তা। সেই রাস্তা গিয়ে মিশেছে বড় রাস্তায়। কিছুটা গেলেই মুন্নার দোকান। বেশ সুন্দর দোকানটা সাজিয়েছে। মুন্নাই হল নির্জনের জ্যাকেট সাপ্লায়ার। একদিন মুন্নার দোকানে একটা জ্যাকেট কিনতেই গিয়েছিল। মুন্না নিজে পছন্দ করে দিয়েছিল। কিছুতেই দাম নিতে চায়নি। বলেছিল, আপনি কত ভাল ভাল জায়গায় যান। আপনার সঙ্গে আমার দোকানের এই জ্যাকেটটাও যাবে। আপনি যখন টিভিতে বলবেন, আমি গর্ব করে বলতে পারব, এটা আমার দোকানের জ্যাকেট। তাই এর দাম নিতে পারব না। নির্জন দিতে চাইলেও মুন্না কিছুতেই নেবে না। মুন্নাও বেশ গর্ব করেই খদ্দেরদের বলে, ওই যে নির্জন সরকার, টিভিতে ইন্টারভিউ দেন, এখান থেকেই জ্যাকেট নিয়ে যান।
মুন্না বেছে দিয়েছিল নীল রঙের একটা জ্যাকেট। বলেছিল, আপনাকে নীল রঙটা ভাল মানাবে। তাছাড়া, সরকারি কাজে তো নীল রঙটাই ইদানীং বেশ ব্যবহার হচ্ছে। আপনিও তো সরকারের হয়েই বলেন। তাই নীলটাই ভাল।
একদিন নির্জন একটা হলুদ রঙের জ্যাকেট পরে স্টুডিওতে গিয়েছিলেন। মুন্নার সে কী অভিমান!‌ পরেরদিন সকালেই হাজির। আপনি আমার দোকান ছেড়ে অন্য দোকান থেকে জ্যাকেট নিয়েছেন!‌ কে আপনাকে ওই হলুদ জ্যাকেটটা গছালো? বিশ্বাস করুন, ওই জ্যাকেটে আপনাকে ভাল লাগছিল না।
নির্জন আমতা আমতা করে বললেন, ‘ওটা পুরনো ছিল। তাছাড়া, তুমি তো দাম নিতে চাও না। তাই তোমার দোকানে বারবার যেতেও কেমন লাগে।’
মুন্না বলেছিল, ‘আপনার কাছে দাম না নিলে কি আমি গরিব হয়ে যাব? আরে মশাই, শাহরুখ খান, সৌরভ গাঙ্গুলিরা মডেল হতে কোটি কোটি টাকা নেয়। আমার তো এতদূর দৌড় নেই। আমার মডেল আপনিই। ফোকটে মডেল পেয়েছি, এটাই তো অনেক। তার কাছ থেকে টাকা নেব?
বলেই হাতে একটা প্যাকেট গছিয়ে দিল। ভেতরে দুটো জ্যাকেট। সঙ্গে বলে গেল, এই সপ্তাহের মধ্যেই যেন দেখি, এই দুটো পরে টিভিতে যাচ্ছেন।
তারপরই ডাক দিল মৈত্রেয়ীকে, বৌদি, আপনাকে বলে যাচ্ছি। উল্টোপাল্টা পোশাক পরে দাদাকে চ্যানেলে যেতে দেবেন না। অনেক লোক দেখে। দাদার তো একটা প্রেস্টিজ আছে। যা খুশি পরে গেলেই হল?‌ দুটো ভাল জ্যাকেট দিয়ে গেলাম। ওগুলো পরিয়েই পাঠাবেন।
এমন আব্দারে মৈত্রেয়ীও হেসে উঠল। মুন্না চলে যাওয়ার পর বলল, ইস, আমি যদি এমন মডেল হতাম, আমাকে অন্তত শাড়ি কিনতে হত না। কত মুন্না জুটে যেত!‌
নির্জনও তাহলে মডেল? মুন্নার দোকানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর!‌ নির্জন নিজের মনেই মুচকি হাসলেন। শাহরুখ খান, সৌরভ গাঙ্গুলিদের সঙ্গে কিনা তাঁর তুলনা!‌ স্কুল মাস্টার নির্জন মনে মনে বললেন, ধন্য টিভি চ্যানেল, যুগে যুগে যেন বুদ্ধিজীবী হয়েই জন্মাই।
‌‌‌‌‌‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.