‌কর্মাটাঁড়ের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার

শাক্য সেন

মংপুতে তিনবার গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। থাকতেন মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে। বাড়িতে না বলে কোয়ার্টারে বলাই ভাল। মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী চাকরি করতেন কুইনাইন ফ্যাক্টরিতে। তাঁর বাংলোতেই অতিথি হয়ে উঠতেন বিশ্বকবি। তখন জীবনের প্রান্তবেলা। ঘুরে বেড়ানোর তেমন সামর্থ্য নেই। পাহাড়ি সেই জনপদে বাঙালি প্রায় ছিল না বললেই চলে। অধিকাংশই নেপালি। ফলে, রবীন্দ্রনাথ কী লেখেন, সেসব বোঝা তাঁদের কম্ম নয়। তবু সকাল থেকেই বাড়িতে ভিড় লেগে যেত। আসলে, কবির কাছে নয়, তাঁরা আসতেন ডাক্তারের কাছে। এখানে রবি ঠাকুরের পরিচিতি ছিল হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে। তিনি এই পাহাড়ি মানুষদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন, ওষুধ দিতেন।

বিশ্বকবির সঙ্গে তাঁর পূর্বসূরী বিদ্যাসাগরের এই ব্যাপারটায় খুব মিল। তিনিও শেষ জীবনে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারই হয়ে উঠেছিলেন। সেটাও কলকাতা থেকে অনেক দূরে, কর্মাটাঁড়ে। সেই কর্মাটাঁড় দীর্ঘদিন ছিল বিহারে। রাজ্য ভাগের পর তা এখন ঝাড়খণ্ডে। বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনের সতেরোটা বছর কেটেছে এই আদিবাসী অধ্যুসিত গ্রামে। আর এখানে তিনি বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায়। কিংবদন্তি চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার (‌যিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের চিকিৎসক হিসেবেও খ্যাত)‌ বিদ্যাসাগরকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বিদ্যাসাগরও সরকার মশাইকে নানা সেবামূলক কাজে টাকা তুলে দিতেন। সেইসঙ্গে বিদেশি বই পড়ে টুকটাক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও আয়ত্ব করেছিলেন। যার ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটেছিল সেই কর্মাটাঁড়ে।

হঠাৎ কর্মাটাঁড়ে গেলেনই বা কেন?‌ বলা যায়, নিজের গ্রাম আর কলকাতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে। বিদ্যাসাগর বলতেই উঠে আসে তাঁর জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামের কথা। কিন্তু ঘটনা হল, এই বীরসিংহ গ্রামের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন ইশ্বরচন্দ্র। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এই গ্রামে আর কখনও ফিরবেন না। সেই প্রতিজ্ঞার পরেও তিনি আরও ৩২ বছর বেঁচেছিলেন। কিন্তু আর কখনই নিজের গ্রামে পা রাখেননি। কলকাতা সম্পর্কেও একইরকম বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে শহুরে শিক্ষিত সমাজের কাছ থেকে যেভাবে কটাক্ষ, বিদ্রুপ ও পদে পদে বাধা পেয়েছেন, তা তাঁকে অত্যন্ত আঘাত করেছিল। অনেকেই জানেন, বিদ্যাসাগর নিজের ছেলের সঙ্গে এক বিধবা মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গেও একসময় সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৮৭২ সাল নাগাদ ছেলেকে তাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। স্ত্রীও মারা গেলেন। অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন বিদ্যাসাগর। কলকাতায় কিছুতেই আর মন টিকছিল না। এদিকে, গ্রামের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন। ঠিক করলেন, বাংলার সীমান্ত ছাড়িয়ে একেবারে কোনও প্রান্তিক গ্রামে গিয়ে থাকবেন।

প্রথমে ঠিক ছিল, তিনি দেওঘরে থাকবেন। একটি বাড়িও দেখেছিলেন। প্রাথমিকভাবে পছন্দও হয়েছিল। কিন্তু বাড়িওয়ালা এমন দাম হাঁকলেন, তিনি পিছিয়ে গেলেন। শেষমেষ বেছে নিলেন দেওঘর থেকে কিছুটা দূরে, কর্মাটাঁড়। আদিবাসী ভাষায় টাঁড় মানে, উঁচু জমি, যেখানে জল দাঁড়ায় না। আর কর্মা নামে এক মাঝি ছিলেন। মোদ্দা কথা, কর্মা মাঝির উঁচু জমি। সেখানে এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে ১৪ বিঘা জমি কিনেছিলেন বিদ্যাসাগর। সেই মহিলার স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি সেই জমি বিক্রি করে দেন। কিনে নিলেন বিদ্যাসাগর। তখনকার দিনে খরচ পড়েছিল ৫০০ টাকা। সেই জমিতে নিজে একটি বাড়ি তৈরি করলেন। নাম দিলেন নন্দনকানন। একটি শোবার ঘর, একটি পড়াশোনার ঘর। আরেকটি বড় হল ঘর। সেখানে রাতে বয়স্কদের লেখাপড়া শেখাতেন।

কর্মাটাঁড়ে এসেই বিদ্যাসাগর বুঝলেন, এত বড় এলাকায় কোনও ডাক্তার নেই। এখানে লেখাপড়া শেখানোর চেয়েও চিকিৎসা বেশি জরুরি। তাই সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেল ডাক্তারখানা। মোটামুটি সকাল দশটা পর্যন্ত চলত এই পর্ব। ভিজিট নেওয়া তো দূরের কথা। ওষুধও নিজেই বানিয়ে দিতেন। সেই সঙ্গে কোনও কোনও রোগীর পথ্যও তৈরি করে দিতে হত। সাগু, বাতাসা, মিছরি নিয়েই বসতে হত। এখানেই ডাক্তারি শেষ নয়। বিকেল দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়েও চলত ডাক্তারি। আর সন্ধের পর গ্রামের বয়স্কদের নিয়ে স্কুল। এভাবেই দিন কেটে যেত। এই আদিবাসীদের সান্নিধ্য বেশ ভালই লাগত বিদ্যাসাগরের। এ নিছক কয়েক মাসের সমাজসেবা নয়। শেষজীবনের সতেরোটা বছর এভাবেই কেটেছে। ভাবা যায়, বিদ্যাসাগরের মতো একজন মানুষ কিনা শেষ সতেরোটা বছর (‌১৮৭৩—১৮৯০)‌ কাটিয়ে ছিলেন একেবারে আদিবাসীদের গ্রামে!‌

মাঝে মাঝে কলকাতা আসতেন ঠিকই। সেটা মূলত চিকিৎসার কাজে। তাও অল্প দিনের জন্য। ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যেতেন ওষুধ, ফল, জামাকাপড়। বিদ্যাসাগর কর্মাটাঁড়ে ফিরলেন মানেই গ্রামর মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই— ‘‌এই বিদ্যেসাগর, কী এনেছিস?‌’ পুজোর আগে গ্রামের প্রত্যেকের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যেতেন। কারও জন্য শাড়ি, কারও জন্য লুঙ্গি, কারও জন্য জামা। ‌শেষ একটা বছর অবশ্য খুবই অসুস্থ ছিলেন। ফিরে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। সেখানেই মৃত্যু (‌১৮৯১)‌। যে পুত্রকে তাজ্যপুত্র করেছিলেন, সেই নায়াণচন্দ্র এবার কর্মাটাঁড়ে এলেন সম্পত্তির দখল নিতে। বিদ্যাসাগরের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা নয়, সম্পত্তি বিক্রি করলে কত দাম পাওয়া যাবে, সেটাই তাঁর কাছে বড় প্রশ্ন। বিক্রি করলেন কলকাতার মল্লিক পরিবারকে। সেই পরিবারও জায়গাটা নিয়ে ফেলেই রাখল। অনেক পরে এগিয়ে এল বিহার বাঙালি সমিতি। স্বাধীনতার আগেই তাঁরা মল্লিক পরিবারের কাছ থেকে সেই জমি ও বাড়ি কিনে নিলেন। চালু করলেন একটি মেয়েদের স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয়। ১৯৭৮ সাল নাগাদ মূলত তাঁদের দাবিতেই কর্মাটাঁড় স্টেশনের নাম হয়ে গেল বিদ্যাসাগর। গত বছর ঝাড়খণ্ড সরকার ঘোষণা করেছে পুরো কর্মাটাঁড় থানা ও ব্লকও বিদ্যাসাগরের নামে হয়ে যাবে। সেই বাড়ি, সেই স্কুল আজও আছে। আজও আছে বিদ্যাসাগরের লাগানো সেই আমগাছ। পাশে তৈরি হয়েছে গেস্ট হাউস।

ইতিহাস বিস্মৃত জাতি হিসেবে বাঙালির বিশেষ একটা ‘‌সুনাম’‌ আছে। ইতিহাস তাঁর ভেতর রোমাঞ্চ আনে না। তাঁকে শিহরিত করে না। তাই বছরভর বাঙালি এত এত জায়গায় বেড়াতে যায়, তাঁদের কজনই বা আসেন এই কর্মাটাঁড়ে!‌ আপনার পরিচিত একশো জনের মধ্যে খোঁজ নিন। দেখুন, একজনও সেখানে যাননি। একশো জনের মধ্যে অন্তত আঠানব্বই জন ‘‌কর্মাটাঁড়’‌ নামটাই শোনেননি। যেখানে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষ সতেরোটা বছর কাটিয়েছিলেন, সেখানে বাঙালি একদিনের জন্যও যেতে পারে না!‌ ২০০ বছরের জন্মদিনে আমরা ফেসবুকে ছবির বন্যা বইয়ে দিই। কিন্তু একটা ছুটির দিন দেখে একটু কর্মাটাঁড় ঘুরে আসা যায় না!‌ ‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.