স্বরূপ গোস্বামী
দ্বিতীয় ইনিংসে শাসক দল নাকি অনেক সংযত। বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি আটকাতে নাকি কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন সভা থেকে হুংকার ছাড়ছেন। ফলাও করে ছাপা হচ্ছে কাগজে। সারা দিন ধরে দেখানো হচ্ছে চ্যানেলে।
পাশাপাশি চলছে অন্য একটা চিত্রনাট্য। বিরোধীদের হাতে থাকা একের পর এক পঞ্চায়েত, পুরসভা, জেলা পরিষদের দখল নেওয়া। সেটাও ফলাও করে ছাপা হচ্ছে কাগজে। যেন বিরাট এক সাফল্য পাওয়া গেল। কী আশ্চর্য, দল ভাঙানোর এই নোঙরা খেলাকে আমরা কেমন কৃতিত্ব হিসেবে দেখতে শুরু করেছি!
দীর্ঘদিন ধরেই মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার অবজার্ভার শুভেন্দু অধিকারী। দুটি জেলাতেই বিধানসভায় তৃণমূলের ফল অত্যন্ত খারাপ। রাজ্যব্যাপী যখন বিরাট জয়, তখন মালদায় বারোটির মধ্যে একটি আসনও পায়নি শাসক দল। এর জন্য অনুশোচনা নেই, তেমন আত্মসমীক্ষাও নেই। উল্টে গায়ের জোরে কয়েকদিন ধরেই হুংকার দেওয়া চলছিল, মালদা জেলা পরিষদ দখল করব। কী আস্ফালন! এই দখলদারির মধ্যে যে কোনও কৃতিত্ব নেই, স্রেপ একটা গাজোয়ারি আছে, এই সহজ সত্যিটা কেউ বোঝালেন না পূর্ব মেদিনীপুরের যুবরাজকে ?
তিন বছর আগে জেলা পরিষদে মালদায় ৩৮ টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল মাত্র ৬ টি আসন। ৬ টি আসন নিয়ে জেলা পরিষদ দখলের কথা একমাত্র এই দলটিই ভাবতে পারে। ওই ফলাফল না হয় তিন বছর আগের। ধরেই নিচ্ছি, তারপর প্রচুর ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। সেই উন্নয়নের জোয়ারে মানুষ ভেসে গেছেন। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস আগে হওয়া বিধানসভায় বারোটির মধ্যে শূন্য। এরপরেও দখলের আস্ফালন!
অনেকদিন ধরেই বিরোধী দলে ভাঙন ধরানোর প্রক্রিয়া চলছিল। বামেদের ৮, কংগ্রেসের ৬, সমাজবাদী পার্টির ২। সবমিলিয়ে ১৬ জনকে ভাঙানো গেল। সেই ১৬ জনকে বন্দী করে রাখা হল দিঘার সরকারি হোটেলে। কাউকে বেরোতে দেওয়া হল না। কারণ, শুভেন্দু অধিকারী এসে তাঁদের ‘বোঝাবেন’। তারপর বিশাল সেই কনভয় রওনা হল তৃণমূল ভবনের দিকে।
যথারীতি হাতে তুলে দেওয়া হল তৃণমূলের পতাকা। তৃণমূলে যোগ দিলে সবাইকেই যা বলতে হয়! ‘মমতা ব্যানার্জির আদর্শে তৃণমূলে যোগ দিলাম। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হলাম।’ একটা সহজ কথা সহজে বলাই ভাল। এঁরা কেউই আদর্শের তাড়নায় তৃণমূলে আসেননি। টাকা, চাকরি সহ নানা প্রলোভন তো ছিলই। যোগ না দিলে নানাভাবে হেনস্থা করার হুমকিও ছিল। কেউ লোভের কাছে, কেউ ভয়ের কাছে পরাস্ত হলেন। টাকার কাছে বিকিয়ে যাওয়া এই লোকগুলো বললেন মমতা ব্যানার্জি তাঁদের আদর্শ।
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, এঁদের ‘আদর্শ’ হয়ে আপনি কি খুব গর্বিত? যদি সত্যিই বিরাট উন্নয়নের জোয়ার বইছে, যদি সত্যিই এঁরা সবাই আপনার আদর্শে অনুপ্রাণিত, তাহলে পদত্যাগ করে আপনার ছবি টাঙিয়ে জিতে আসতে বলুন।
বামেদের অনেক খারাপ গুণ ছিল। কিন্তু ৩৪ বছরে একটা দৃশ্য মনে করতে পারবেন, যেখানে বিরোধী বিধায়ক বা সাংসদ বা জেলা পরিষদের সভাধিপতিকে ভাঙিয়ে এনে তাঁর হাতে আলিমুদ্দিনে পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে ? একটা দৃষ্টান্ত দেখান। সিপিএম চাইলে কি ৩৪ বছরে একজনকে ভাঙাতে পারত না ?
অতি উৎসাহে শুভেন্দু অধিকারী বা জলপাইগুড়িতে সৌরভ চক্রবর্তীরা এমন কাজ করছেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। নির্দেশটা আসছে সর্বোচ্চ স্তর থেকেই। বামেরা ভাঙছে, কংগ্রেস ভাঙছে, হয়ত আরও দুর্বল হবে। কিন্তু এই ভাঙায় আপনার কৃতিত্ব কোথায় ?
সিপিএম বা কংগ্রেস ক্ষুব্ধ হবে, সমালোচনা করবে, এটা স্বাভাবিক। খোদ তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীরা এই ‘দখল’এর রাজনীতি মন থেকে মানতে পারছেন তো ? যাঁরা উন্নয়নের কথা ভেবেই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন, তাঁরাও এই দখলদারি মন থেকে মানতে পারছেন? দল ভাঙানো আর দখলদারির এই খেলা একদিন ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে না তো ?
গ্রাম গঞ্জের লড়াকু, প্রতিবাদী মানুষের প্রেরণা ছিলেন। গ্রামে নির্যাতিত নারীদের প্রেরণা ছিলেন। সেটা যথেষ্ট গৌরবের মনে হয়নি।
কে কী শর্তে বিক্রি হয়েছেন, আপনার অজানা নয়। একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। এমন লোকেরা বলে যাবে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের প্রেরণা! ভেবে দেখুন, আপনি তাঁদের প্রেরণা হতে চান কিনা।