রোহিত, টাইমিংয়ে গন্ডগোল হয়ে গেল

স্বরূপ গোস্বামী

দৃশ্য এক
প্রায় বছর দেড়েক আগের কথা। জোহানেসবার্গে নেমে এসেছিল স্বপ্নের রাত। ১৭ বছর পর টি২০ বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছে ভারত। আনন্দে উত্তাল আসমুদ্র হিমাচল। ক্যামেরা বারবার ফোকাস করছে আপনার দিকে। অধিনায়ক বলে কথা। কিন্তু আপনার চোখে মুখে তেমন উচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তি নেই। এগিয়ে এল সম্প্রচারকারী চ্যানেলের বুম। সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে আপনি বলেই ফেললেন, এটাই ছিল আপনার শেষ টি২০ ম্যাচ। এই ঘরানার ক্রিকেটে আর নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, আর খেলতেই রাজি নন। উচ্ছ্বাসকে থামিয়ে নেমে এসেছিল নিস্তব্ধতা। একবার মনে হল, এমন দিনে এটা না বললেই হচ্ছিল না!‌ পরক্ষণেই মনে হল, বিদায় নেওয়ার এটাই তো সঠিক সময়। এর থেকে ভাল মঞ্চ আর কীই বা হতে পারত!‌‌

দৃশ্য দুই
এবার ৯ মার্চ, ২০২৫। ভারতের সঙ্গে দুবাইয়ের সময়ের ব্যবধান তেমন নয়। দেড় ঘণ্টার। মানে, আমরা দেড় ঘণ্টা এগিয়ে। এখানে রাত। সেখানেও রাত। বড়জোর সেখানে রাতের বয়স একটু কম। এবারও ঘরে এল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। এবারও ব্যবধানটা অনেকদিনের। শেষবার এসেছিল ২০১৩ তে। এটা ২০২৫। মানে ১২ বছরের ব্যবধান। টি২০ বিশ্বকাপেও ধোনির পর রোহিত। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ক্ষেত্রেও ধোনির পর রোহিত। মনে হচ্ছিল, ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আবার হয়তো বলে বসবেন, বৃত্ত সম্পূর্ণ। একদিনের ক্রিকেট আর নয়। কিন্তু আপনার মুখ থেকে তেমন কোনও ঘোষণা এল না। না টিভি ইন্টারভিউতে। না পুরস্কার বিতরনী সভায়। না প্রেস কনফারেন্সে। বরং, বলে বসলেন, অবসর নিয়ে কিছু ভাবছিই না।

আপনার এই ঘোষণায় অনেকেই হয়তো আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু আমি কিছুটা যেন হতাশই হলাম। মন থেকে চাইছিলাম, জোহানেসবার্গের মতোই দুবাই থেকেও এমনই একটা ঘোষণা আসুক। তাতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ যদি একটু ফিকে হয়, তো হোক। আচ্ছা, সত্যিই বলুন তো, একদিনের ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর এমন মঞ্চ কি আর পাবেন?‌

মাস দুই আগের কথা। সিডনি টেস্টের ঠিক আগে। জোর গুঞ্জন, শেষ টেস্টে আপনাকে নাকি বাদ দেওয়া হবে। সে কী!‌ আপনি দলের অধিনায়ক। চোট আঘাতও নেই। তাহলে বসানোর প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে!‌ বিশেষ করে শেষ টেস্টে জিতলে সিরিজে হার বাঁচানোর একটা সুযোগ। এই অবস্থায় আপনাকে বসানোর কোনও মানে হয়!‌ গৌতম গম্ভীর কি তবে গ্রেগ চ্যাপেল হয়ে গেলেন?‌ গ্রেগ সৌরভকে বাদ দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সিরিজের মাঝপথে নয়। সেখানে আপনার প্রসঙ্গ উঠতে গম্ভীর কীভাবে বলে বসলেন, ‘‌ম্যাচের দিন সকালে পিচ দেখে সিদ্ধান্ত নেব।’‌ মানে কী?‌ লোকটা কী আবোল তাবোল বকছে?‌ প্রশ্নটা ঠিকঠাক শুনেছে তো?‌ অক্ষর প্যাটেল নাকি ওয়াশিংটন সুন্দর!‌ এই জাতীয় প্রশ্ন হলে বলা যেতে পারে। তাই বলে অধিনায়ক খেলবেন কিনা, সকালে সিদ্ধান্ত হবে?‌ ভারতীয় ক্রিকেটে এমন আলটপকা মন্তব্য কখনও শোনা গেছে!‌

পরেরদিন দেখা গেল, সত্যিই আপনি মাঠের বাইরে। তার মানে, সিরিজ চলাকালীন অধিনায়ককে ছেঁটে ফেলা হল!‌ ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে এমনটা কখনও ঘটেনি। এমন অপমান কি আপনার প্রাপ্য ছিল?‌ পরে জানা গেল, নিজের খারাপ ফর্মের জন্য আপনি নিজেই নাকি বসে যেতে চেয়েছেন। হতেই পারে। তাহলে, দুদিন ধরে যখন ছড়িয়ে গেল, আপনাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, তখন নীরব রইলেন কেন?‌ আপনার নীরবতায় তো প্রকারান্তরে এই বার্তাই গেল যে, আপনাকে সত্যিই বাদ দেওয়া হয়েছে। এমন অপমান দু’‌দিন ধরে নিঃশব্দে হজম করলেন!‌

গতবছর আইপিএলের ঠিক আগে। হঠাৎ করে ঘোষণা হয়ে গেল, আপনি নন, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়ক হবেন উড়ে এসে জুড়ে বসা হার্দিক পান্ডিয়া। সবথেকে বেশিবার আইপিএল জিতেছে মুম্বই। পাঁচবারই আপনার নেতৃত্বে। আপনি দেশের অধিনায়ক। তার কয়েকমাস আগেও দেশের মাটিতে ভারতকে বিশ্বকাপ ফাইনালে তুলেছেন। সেই আপনাকে কিনা এভাবে সরিয়ে দেওয়া হল!‌ এমন অপমানও নিঃশব্দে হজম করেছেন। ভেতরে ভেতরে কি রক্তক্ষরণ হয়নি?‌ নিশ্চয় হয়েছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও বিস্ফোরক বা সেমি বিস্ফোরক পোস্ট দেখা যায়নি। এমনকী সামান্য ইঙ্গিতবাহী কোনও পোস্ট পেলেই মিডিয়া তিলকে তাল করে ‘‌বিস্ফোরক’‌ তকমা এঁটে দিত। আপনার জমাট ডিফেন্স সেই সুযোগটুকুও দেয়নি। আইপিএলের ঠিক পরেই উড়ে গেছেন টি২০ বিশ্বকাপ খেলতে। ট্রফি জিতে হাসিমুখেই ছেড়ে দিলেন রাজ্যপাট। নীরব প্রতিবাদ বোধ হয় একেই বলে।

ঠিক তেমনই, এবারও আশা করেছিলাম, দুবাইয়ে তেমন কিছু ঘটবে। সিডনি টেস্টে যেভাবে অপমানিত হতে হয়েছিল, সেই আগুন এত তাড়াতাড়ি নেভার নয়। তারপরেও আপনাকে বসানোর দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন কত দিকপাল। ব্যাটে রান নেই। আপনি নাকি বোঝা। আপনি নাকি আনফিট। দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং করছেন। কত তকমা উড়ে এল। ফাইনালে ত্রাতার ভূমিকায় সেই আপনিই। সেঞ্চুরি এল না ঠিকই, কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে ওই ৭৬ রানের ইনিংসটা সেঞ্চুরির থেকে কোনও অংশে কম মূল্যবান নয়। একদিনের ক্রিকেটে আপনার নামের পাশে তিনখানা ডাবল সেঞ্চুরি। এই মহাবিশ্বে আর কারও নামের পাশে এই রেকর্ড নেই। সর্বাধিক ২৬৪ রানের ইনিংসটাও এসেছে আপনারই ব্যাট থেকে। কত সহজে আমরা এই ইতিহাসগুলো ভুলে যাই!‌ কটা ম্যাচে রান না পেলেই কত সহজে তাঁকে ‘‌বোঝা’‌ ভাবতে শুরু করে দিই!‌

আমাদের কুয়োয় জন্ম, কুয়োতেই বেড়ে ওঠা। পাড়ার বান্টুদা, অফিসের ঘোষবাবু কী বললেন, তা নিয়েই আমরা দিন কাটাই। কেউ একটু বাঁকা কথা বললে যতক্ষণ না তাঁকে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে পারি, আমাদের ভাত হজম হয় না। আর মুখে বলতে না পারলে মনে মনে গজগজ করি। বাড়িতে নিরীহ বউয়ের ওপর বা অটোওয়ালার ওপর নিস্ফল রাগ দেখাই। সেখানে আপনি!‌ ক্রিকেট যে দেশের ধ্যানজ্ঞান, সেই দেশের অধিনায়ক। কখনও নীতা আম্বানি আপনাকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। কখনও গৌতম গম্ভীর নিদান দিচ্ছেন আপনি দলে থাকবেন কিনা। এত হেনস্থা নীরবে হজম করেন। ধীর, স্থির, শান্ত। ব্যাটে রান ছিল না। তাই হজম করতে হচ্ছিল। কিন্তু ফাইনালে তো আপনিই নায়ক। এমন মঞ্চ আর কি পাবেন?‌ ২৭ এর বিশ্বকাপ ঢের দেরি। ততদিনে বয়স আরও দু’‌বছর বেড়ে যাবে। সেই রিফ্লেক্স থাকবে না। ফিটনেসে আরও মরচে পড়বে। ততদিন আদৌ অধিনায়ক থাকবেন কিনা বা দলে থাকবেন কিনা, এমন নিশ্চয়তা নেই। তাহলে কীসের অপেক্ষা?‌

আপনাদের জয়ের পরেই ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধ মাঠের ভেতর ঢুকে নাচছিলেন। আপনাদের সেলিব্রেশন ছাপিয়ে ক্যামেরা চলে গিয়েছিল সেই বৃদ্ধের দিকে। তাঁর নাম সুনীল গাভাসকার। যিনি বলেছিলেন, ঠিক সময় থামতে জানাটাও একটা আর্ট। লোকটা এখনও কেন খেলছে, এই প্রশ্নটা যেন শুনতে না হয়। তার অনেক আগেই ব্যাট তুলে রাখো। লোকটা কেন ছেড়ে দিল?‌ এই প্রশ্নটা অনেক স্বস্তিদায়ক।

ওই লোকটা সঠিক সময়ে ব্যাট তুলে রেখেছিলেন। আজও কিংবদন্তির মর্যাদা পান। রোহিত, আপনার সামনেও সুযোগ ছিল ব্যাট তুলে রাখার। জয়ের উচ্ছ্বাসে সামিল হয়েও বলছি, টাইমিংয়ে কোথাও একটা গন্ডগোল হয়ে গেল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.