অজয় কুমার
তিনি কোনও সাহিত্যিক নন। জীবনে একটাও গল্প বা উপন্যাস লেখেননি। কবিতা বা ভ্রমণ কাহিনিও লেখেননি। গুরুগম্ভীর প্রবন্ধও লেখেননি। কিন্তু তারপরেও গত তের–চোদ্দ বছরে যে সব বইকে নিয়ে সবথেকে বেশি চর্চা হয়েছে, সেই তালিকায় নিশ্চিতভাবেই তাঁর বইয়ের নাম থাকবে। সেই বই কত কপি বিক্রি হয়েছে, বলা মুশকিল। কিন্তু যত কপিই বিক্রি হোক, পড়েছেন তার থেকে অনেকগুন বেশি লোক। একসময় পাতা ধরে ধরে জেরক্স হয়েছে। পরের দিকে যখন প্রযুক্তি আরও ডালপালা মেলল, যখন বাঙালি মোবাইলে পিডিএফ আদান–প্রদান করতে শিখল, তখন সেই পিডিএফ ছড়িয়ে গেছে এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে।
লেখকের নামটা এবার বলেই ফেলা যাক। দীপক ঘোষ। যাঁরা বঙ্গ রাজনীতির খোঁজ রাখেন, তাঁদের কাছে নামটি অপরিচিত নয়। একসময়ের দুঁদে আমলা। অবসর নেওয়ার পর তৃণমূলের বিধায়ক। পরবর্তীকালে পরিচিতি বিতর্কিত বইয়ের লেখক হিসেবে। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ কোনও চ্যানেলে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হয়নি। মূলস্রোত মিডিয়া খবরই পেয়েছে মৃত্যুর অন্তত দুদিন পর। এত বাসি খবর নিয়ে তেমন চর্চা করলে নিজেদের অক্ষমতাই প্রকট হয়। তাই চ্যানেল বা কাগজগুলি কার্যত এড়িয়েই গেছে। তাছাড়া, বেশি মাতামাতি করলে একদিকে যেমন রোষানলে পড়ার আশঙ্কা। পাশাপাশি নিন্দুকেরা বলতেই পারেন, এসব কেচ্ছাসর্বস্ব বইয়ের লেখক নিয়ে বেশি আলোচনা না করাই ভাল।
তাঁর বইয়ের সন্ধান পাই সম্ভবত ২০১৩ নাগাদ। তখনও সোশ্যাল মিডিয়ার এত রমরমা হয়নি। হলেও এই মাধ্যমে আমার হাতেখড়ি হয়নি। কিন্তু পরিচিতদের মাধ্যমে শুনলাম, দীপক ঘোষ দারুণ একটা বই লিখেছেন। একেবারে হাটের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। সব অকাট্য প্রমাণ। বইয়ের বিষয়বস্তু কী, তা অনেকেই জানেন। ইচ্ছে হল, সেই বই পড়ার। কিন্তু কোথায় পাব? মফস্বল থেকে হুট করে কলেজ স্ট্রিট যাওয়াও সম্ভব নয়। অবশেষে প্রকাশকের ফোন নম্বর পেলাম। কিছুটা সঙ্কোচ নিয়েই ফোন করলাম। দীপকবাবুর ওই বই কীভাবে পেতে পারি? প্রকাশক জানালেন, ‘ওই বই দোকানে রাখায় সমস্যা আছে। পুলিশ ঝামেলা করবে। আপনি যদি পড়তে চান, আপনার ঠিকানা দিন। পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
ঠিকানা না হয় দেওয়া যাবে। কিন্তু টাকা কীভাবে পাঠাব? তখনও গুগল পে, ফোন পে— এসব শব্দগুলোই শুনিনি। টাকা পাঠানো বলতে সেই সাবেকি মানি অর্ডার। উনি বললেন, ‘টাকা পাঠানো নিয়ে ভাববেন না। দীপকবাবু ব্যবসা করার জন্য বই লেখেননি। তিনি সত্য উন্মোচনের জন্য এই বই লিখেছেন। উনি নিজেই খরচ দিয়েছেন। উনি বলেছেন, যারা পড়তে চায়, যেন তাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকী পোস্টাল খরচও উনিই দেবেন। আপনি শুধু ঠিকানা বলুন।’ কিছুটা সঙ্কোচ নিয়েই ঠিকানা পাঠালাম। তখনও ভাবিনি বইটা আমার ঠিকানা পৌঁছে যাবে। এক কপি নয়, তিন কপি এসেছিল। পরে প্রকাশককে ধন্যবাদ জানাতে আবার ফোন করেছিলাম। জানতে চাইলাম, তিন কপি পাঠালেন কেন? উনি বললেন, একটা আপনার জন্য। যদি পড়ার পর মনে হয়, এই বই কাউকে দেওয়া দরকার, তাহলে তাঁদেরও যেন দিতে পারেন। আমি নিশ্চিত, এই বই পরে অনেকেই পড়তে চাইবে। কী জানি, হয়ত নিষিদ্ধ হয়ে যেতেও পারে। গোডাউনে পুলিশ পাঠিয়ে বই সিজ করা হতে পারে। তার থেকে বিভিন্ন জায়গায় বইটা ছড়িয়ে যাক। দীপকবাবুও তেমনটাই চান।
রাত জেগে বইটা পড়েও ফেললাম। সব যে বিশ্বাস করেছি, এমন নয়। কখনও কখনও মনে হয়েছে, নানা কারণে মুখ্যমন্ত্রীর আচরণে দীপকবাবু আঘাত পেয়েছেন। বই লিখে গায়ের ঝাল মেটাচ্ছেন। ব্ল্যাকমেলিং করছেন। কিন্তু যে প্রমাণগুলো দিয়েছেন, সেগুলোকেই বা অস্বীকার করি কী করে? এই বই তো সত্যিই ব্যান হয়ে যাওয়ার কথা। মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে এমন কথা লেখা যায়! মনে মনে নানা আশঙ্কা হল। একবার মনে হল, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। কখনও মনে হল, গ্রেপ্তার হয়তো করা হবে না। কিন্তু পুলিশ দিয়ে বা গুন্ডা দিয়ে শাসানো হতে পারে। কখনও মনে হল, নানা প্রলোভন দেখিয়ে মুখ বন্ধ করা হতে পারে। কখনও মনে হল, আইনি নোটিশ পাঠানো হতে পারে, মানহানির মামলা হতে পারে। কেন জানি না, কয়েকদিন এমন নানা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল।
একদিন লেখককে ফোনই করে বসলাম। বই পড়ে আমার অনুভূতির কথা জানালাম। পাশাপাশি আমার উদ্বেগের কথাও জানালাম। উনি বললেন, ‘এর পরিণতি খুব খারাপ হতে পারে, এটা জেনেই বইটা লিখেছি। ওরা নিষিদ্ধ করতে পারবে না। কারণ, এমন কিছু প্রমাণ আছে, যা আদালতে পেশ হলে ওরাই বিপদে পড়ে যাবে। ওরা বড়জোর নানাভাবে হেনস্থা করতে পারে।’ কিছুটা কৌতূহল নিয়েই জানতে চাইলাম, বিরোধীরা নিশ্চয় এই বই দারুণভাবে প্রচার করছেন। এমন একটা মোক্ষম অস্ত্র হাতে তুলে দিয়েছেন, কৌতূহল চেপে রাখাই তো মুশকিল। উনি রসিক মানুষ। মজা করে বললেন, ‘বিরোধীরা কতটা পড়েছে জানি না। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে তৃণমূলের লোকেরা বেশি পড়ছে। কত তৃণমূল নেতাকে যে এই বই পাঠাতে হয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। কেউ কেউ তো পঞ্চাশ–ষাট কপিও নিয়েছে। কাদের দিয়েছে, কে জানে! এখন তারাই নানারকম তথ্য দিচ্ছে। যা দিয়ে অনায়াসে দ্বিতীয় খণ্ড করা যায়। এবং সেই বইটা হবে এর থেকেও বিস্ফোরক।’
তাঁর কাছ থেকে স্নেহ পেয়েছি। প্রশ্রয় পেয়েছি। মাঝে মাঝেই ফোন করতাম। খোঁজখবর নিতাম। পরের বইয়ের ব্যাপারে জানতে চাইতাম। বইমেলায় একবার দেখাও হয়েছিল। নাম বলতেই এক চান্সে চিনতে পারলেন। জানালেন, ওরা মানহানি মামলার নোটিশ দিয়েছে। আমি প্রতিবার প্রমাণ নিয়ে আদালতে হাজির হয়েছি। কিন্তু ওরাই আর আসেনি। এলে ওরাই বিপদে পড়বে।’
একবার মজা করে বলেছিলাম, এই রাজ্যে সিবিআই যে কী করছে? আপনি এই বৃদ্ধ বয়সে একার চেষ্টায় এত এত প্রমাণ জোগাড় করছেন, সিবিআই পারছে না? উনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে যা প্রমাণ আছে, তা দিয়েই সরকার পড়ে যেতে পারে। আসলে, সিবিআইয়ের কোনও সদিচ্ছাই নেই। তারা নীচের দিকের চুনোপুঁটিদের ধরবে। আসল জায়গায় হাত বাড়াবে না।’ এই কথা দীপকবাবু বলেছিলেন অন্তত আট–নয় বছর আগে। এতদিন পর মেলাতে গিয়ে দেখছি, কী খাঁটি পর্যবেক্ষণ ছিল।
না, তিনি বিক্রি হয়ে যাননি। অন্য দলেও যাননি। নিজের মতো করে নিজের লড়াই লড়ে গেছেন। চলেও গেলেন নিঃশব্দে। তাঁর বই কতখানি প্রতিবাদ, কতখানি কুৎসা, সেই প্রশ্ন তোলা থাক। এসব কথা জনসমক্ষে আনা ঠিক হয়েছে কিনা, তা নিয়েও বিতর্ক থাকবে। কিন্তু তিনি যে তাঁর মতো করে প্রতিবাদ করে গেছেন, অনেক প্রতিবাদের অস্ত্র তুলে দিয়ে গেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তিনি থাকবেন না। বইগুলোও আর হয়তো রিপ্রিন্ট হবে না। কিন্তু পিডিএফ গুলো আপন খেয়ালে এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে ঘুরে বেড়াবে।