অজয় নন্দী
রাজিন্দর সিং গোয়েল বা পদ্মাকর সিভালকরকে এই প্রজন্মের চেনার কথা নয়। তাঁরা বিরাট কোনও সেলিব্রিটি ছিলেন না। তাঁরা ঘনঘন টুইট করে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করেন না। তাঁরা প্রতিনিয়ত বঞ্চনা আর অভিমানের কথা বলেও শিরোনামে আসতে চাননি। খেলোয়াড় জীবনে যেমন আড়ালে থেকে গেছেন, খেলা ছাড়ার পরেও সেই একই ভূমিকায়। কোচিং টোচিং করেছেন? করে থাকতেও পারেন। শোনা যায়নি। কাগজে কখনও সেই ছবি দেখেছি বলে মনেও পড়ছে না। খুব একটা বলিয়ে কইয়ে ছিলেন না। ফলে, ধারাভাষ্যেও দেখা যায়নি। এঁকে তাঁকে ধরে বোর্ডের কমিটিতে ঢুকতে বা নির্বাচক হতেও দেখা যায়নি।
হ্যাঁ, এঁরা আড়ালেই থাকতে চেয়েছেন। হয়ত তাই মৃত্যুর পরেও অনেকটা আড়ালেই থেকে গেলেন। বছর চারেক আগে এভাবেই নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছিলেন রাজিন্দার গোয়েল। এবার চলে গেলেন ভারতীয় ক্রিকেটের আরেক ট্র্যাজিক নায়ক পদ্মাকর সিভালকার। কোনও কাগজে দায়সারা পঞ্চাশ–ষাট শব্দের কপি। কোথাও বড়জোর সিঙ্গল কলাম। এর বেশি কিছুই জুটল না বেচারা সিভালকারের। একটাই কপি। সেটাও নিতান্ত দায়সারা। নেটে পাওয়া কিছু তথ্যের সঙ্কলন। কোনও সাইড কপি নেই। অধিকাংশ কাগজে ছবির কোনও বালাই নেই। কোথাও থাকলেও এক টাকার কয়েনের মতো। আতস কাচ দিয়ে দেখতে হবে। চ্যানেলে খেলার খবর এমনিতেই বড় দুয়োরানি। আর পোর্টালেও বড়ই কার্পণ্য। এক সাইট থেকে অন্য সাইটে কপি পেস্ট। সব তথ্য, সব লাইন যেন একই গতে বাঁধা।
পদ্মাকর সিভালকার নিছক একজন গড়পড়তা ক্রিকেটার ছিলেন না। ভারতীয় ক্রিকেটে কটা রাজিন্দার গোয়েল বা সিভালকার জন্মেছেন? কোনও টেস্ট না খেলেও তাঁরা টেস্ট খেলিয়েদের চেয়ে বেশি সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা হয়তো টেস্ট খেলেননি। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে যাঁদের অবদান হিমালয়সম। তেমনই এক হিমালয়ের নাম পদ্মাকর সিভালকার। কেরিয়ারে পাঁচশোর উপর উইকেট। এই দেশে কজনের আছে! অথচ, মৃত্যুর পরেও কী উপেক্ষাই না জুটল!
আসলে, এজেন্সি যা গেলাচ্ছে, বাংলার মূলস্রোত মিডিয়া তাই গিলছে। নিজেদের মাথা খাটিয়ে কোনও আকর্ষণীয় কপির লাইনে কেউ যাচ্ছে না। গণমাধ্যমের যেসব লোকেরা এই নামটার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, বা সিভালকারদের অবদানের কথা জানতেন, তাঁদের অনেকেই অবসরের সীমার ওপারে। এ প্রজন্মের কোনও দায় নেই সিভালকারদের চেনার। বিরাট কোহলি বা ঋষভ পন্থরা ছবি দিয়ে টুইট করলে হয়তো বেচারা সিভালকার একটু কল্কে পেতেন। কিন্তু হায়! তাঁরাও ঠিকঠাক চেনেন না। বোর্ড কোনকালে একবার জীবনকৃতী সম্মান দিয়ে ধন্য করে দিয়েছে। তাও প্রাক জয় শাহ জমানায়। এখনকার কর্তাদের চিনতে বা সম্মান জানাতে বয়েই হগেছে। এঁরা দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ ফাইনালে কপিলদেবকে আমন্ত্রণ জানান না, এঁরা সম্মান দেবেন সিভালকারকে!
বলা হয়, গোয়েল বা সিভালকাররা সারাজীবন বিষাণ সিং বেদির ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেলেন। তাই তাঁদের কোনও টেস্ট খেলা হল না। যদিও এর জন্য বেদিকে বা স্বর্ণযুগের বাকি তিন স্পিনারকে (প্রসন্ন, চন্দ্রশেখন, বেঙ্কট রাঘবন) দায়ী করার কোনও মানে হয় না। এখনকার সময়ে হলে হয়তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঠিক সুযোগ এসে যেত। সে অন্য কথা। কভারেজের কথায় আসি।
বেদি না হয় এই ধরাধামে নেই। বাকি স্পিনাররাও না হয় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকলেন। কিন্তু সিভালকার বা রাজিন্দার গোয়েল বললে বাংলার কোন ক্রিকেটারের কথা সবার আগে মনে পড়ে! বাঁ হাতি স্পিনার। বছরের পর বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ সফল। পাঁচশোর উপর উইকেট। অথচ, কখনও টেস্ট খেলা হয়নি। আড়ালেই থেকে গেলেন। ঠিক ধরেছেন, উৎপল চ্যাটার্জি। দুই যন্ত্রণা কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার। সিভালকারের যন্ত্রণা তাঁর থেকে ভাল আর কে বুঝতেন! তাঁকে তো অনায়াসেই ধরা যেত। ইডেনের প্রেসবক্সে ভিড় জমানো (এবং ফেসবুকে সেই ছবি সাঁটানো) বঙ্গজ সাংবাদিকদের তো একবারও মনে হল না, এটা একটা ভাল স্টোরি অ্যাঙ্গেল হতে পারে! এটুকু ভাবার জন্য কি খুব মেধার প্রয়োজন হয়! বাংলা সাংবাদিকতার কত দুর্দিন, সেটাই যেন ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন সিভালকার।
সুমনের একটা গানের লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘মগজে কারফিউ, নিষেধ বেরোনো।’ এই কারফিউ এক মগজ থেকে অন্য মগজে কী অবলীলায় সংক্রমিত হয়ে যায়! প্রিভিউ আর ক্যাম্পের সেই চেনা কক্ষপথে ঘুরপাক। এর বাইরে বেরোনো সত্যিই নিষেধ।