একেনবাবুকে এত ঝামেলায় ফেলার কী দরকার!‌

শুভম সিংহ

বাংলা সাহিত্যে যেমন গোয়েন্দার অভাব নেই, তেমনি সিনেমাতেও অভাব নেই। তবে তাদের সঙ্গে একেনবাবুর একটা ফারাক আছে। ফেলুদা বা ব্যোমকেশের ক্ষেত্রে সেগুলো বইয়ের পাতাতেই আগে জনপ্রিয় হয়েছে। সিনেমা হওয়ার পর তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। একেনবাবু বাঙালি দর্শকের কাছে আগে পর্দায় এসেছেন। তারপর লোকে লেখার খোঁজ করেছেন।

নয়েক দশকে বার কয়েক আনন্দমেলায় বেরিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারপর অনেকদিন বন্ধও ছিল। মূলত ওয়েব সিরিজের হাত ধরেই তার ফিরে আসা। গত বছর বড় পর্দাতেও ধরা দিয়েছেন। প্রবাসী সাহিত্যিক সুজন দাশগুপ্ত নেই, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি থেকে গেছে। বাঙালিকে গোয়েন্দা কাহিনির অন্য এক ঘরানা এনে দিয়েছে।

অন্যান্য গোয়েন্দা গল্পে গোয়েন্দাকে বুদ্ধিমান মনে হয়, তুলনায় সহকারীকে কিছুটা বোকা মনে হয়। সহকারীরা হয় ভুলভাল সন্দেহ করেন, নয় কমিক রিলিফ দিয়ে যান। এক্ষেত্রে একেনবাবু নিজেই যেন কমিক রিলিফ দিয়ে যান। তুলনায় সঙ্গীদের বেশ বুদ্ধিমান–‌বিচক্ষণ মনে হয়। একেনবাবুকে দেখে মনে হয়, চারিদিকে ঘেঁটে ঘ করে বসে আছেন। তাঁকে নিয়ে অন্যরা মস্করা করে। তিনি রাগেন না। বরং বেশ উপভোগ করেন। শেষবেলায় দেখা যায়, আপাতভাবে বোকা ও সরল এই মানুষটি তলে তলে সবাইকে টেক্কা দিয়ে গেছেন। যদিও শেষমেশ কৃতিত্বটা অন্যদের দিয়েই আনন্দ পান।

বড় পর্দায় একেনবাবু পাড়ি দিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ে। মাঝে একবার রুদ্ধশ্বাস রাজস্থান হয়ে গেছে। কিন্তু বাঙালি গোয়েন্দা একবার পুরী না গেলে হয়‌!‌ তাই এবার পুরোপুরি পুরী। ইউটিউব খুললেই সেই প্রোমোশন চলছে। আসলে, একেনবাবুর নতুন সিরিজ এলে না দেখেও থাকা যায় না। হইচইয়ের সাবস্ক্রিপশন তো আছেই। কিন্তু দেখা আর হয় কই?‌ কোনও এক রাতে মনে হল, এই রাতে অন্তত খান তিনেক এপিসোড দেখে ফেলা যাক। বাকিটা দেখব পরের দিন।

সেই ভেবেই দেখতে বসা। তিনটের পর মনে হল, চার নম্বরটাও দেখে নেওয়া যাক। পরের দিনের কাজটা কমবে। চার দেখার পর মনে হল, পাঁচটাও দেখেই ফেলি। তারপর মনে হল, একটা সিরিজ বাকি রেখে আর কাজ কী?‌ তার থেকে শেষ করে ঘুমোতে যাওয়াই ভাল। ঠিক সেটাই হল। মাদকতাই বলুন, মুগ্ধতাই বলুন। একেনবাবু আর পুরী মিলিয়ে একটা রাত মন্দ কাটল না।

অনেক গোয়েন্দা গল্পেই দেখা যায়, তিনি নিছক বেড়াতেই গেছেন। তারপর কোনও না কোনও তদন্তে জড়িয়ে যান। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে, অনেকটা সেইরকম। এক্ষেত্রেও একেনবাবু, মানে একেন্দ্র সেন গিয়েছিলেন নির্ভেজাল বেড়াতে। কিন্তু জড়িয়ে গেলেন খুনের তদন্তে। গোয়েন্দা গল্পের বা সিনেমার আরও একটা কমন মিল আছে। তিনি যেখানেই যান, সবাই তাঁকে চিনে ফেলেন। অর্থাৎ, তিনিও একটা সেলিব্রিটি। এখানেও তাই। পুরী যেতেই দেখা গেল, এসপি তাঁর পরিচিত। শুধু পরিচিতই নয়। একেবারে ব্যাচমেট। তবে ওড়িশা পুলিশের কর্মী খামোখা কেন কলকাতার পিটিএসে ট্রেনিং নিতে আসবেন, সে প্রশ্ন না হয় থাক।

একটা খুন দিয়ে শুরু। দেখতে দেখতে গোটা পাঁচেক খুন হয়ে গেল। ঘেঁটে ঘ হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বেচারা একেনবাবু নিপাট ভাল মানুষ। একটু ভোজনসরিক। একটু স্বভাবরসিক। তাঁকে এই ঝামেলায় না ফেললেই চলছিল না!‌ এত কঠিন অঙ্ক দেওয়া কেন বাপু!‌ গোয়েন্দা কাহিনীকে ‘‌পোক্ত’‌ করতে পাঁচখানা খুনের কী দরকার ছিল?‌ দু–‌তিনটে খুন হলে বুঝি গোয়েন্দার মান ইজ্জত থাকত না!‌ দিকে মোড় নিচ্ছে তদন্ত, সেই সঙ্গে জন্ম নিচ্ছে নিত্যনতুন জট। একটা জট ছাড়ে তো অন্য জট এসে যায়। অতিরিক্ত সাসপেন্স আর থ্রিলার আনতে গিয়ে সহজ–‌সরল কাহিনীতে অহেতুক জটিলএকটা খুন দিয়ে শুরু। দেখতে দেখতে গোটা পাঁচেক খুন হয়ে গেল। ঘেঁটে ঘ হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বেচারা একেনবাবু নিপাট ভাল মানুষ। একটু ভোজনসরিক। একটু স্বভাবরসিক। তাঁকে এই ঝামেলায় না ফেললেই চলছিল না!‌ এত কঠিন অঙ্ক দেওয়া কেন বাপু!‌ গোয়েন্দা কাহিনীকে ‘‌পোক্ত’‌ করতে পাঁচখানা খুনের কী দরকার ছিল?‌ দু–‌তিনটে খুন হলে বুঝি গোয়েন্দার মান ইজ্জত থাকত না!‌তা আনা হয়েছে।

এভাবেই শেষমেশ কিনারা। গোয়েন্দা গল্পের আসল চমক হল শেষটা। যেখানে গোয়েন্দা পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো এক এক করে খোলসা করেন। শেষ দৃশ্যের জন্য বাছা হয়েছিল পুরীর সৈকত। সেখানে শুধু পেঁয়াজ নয়, বাড়তি পাওনা মাছ ভাজা। গল্প বলার থেকে মাছ ভাজা খাওয়ার দিকেই যেন বেশি মনযোগ। দু’‌জন নৃত্যশিল্পীকে দিয়ে শুরু। সেখান থেকে জড়িয়ে গেলেন গুরুজি। জড়িয়ে গেলেন ম্যানেজার। এমনকী এক শিল্পীর স্বামীও। একেনবাবু আছেন জেনেও নিখুঁত চিত্রনাট্যে সেই সময়েই একের পর এক খুন হয়ে গেল!‌ পুরী মানে তো নিছক পুরী নয়। বাঙালি পুরী ঘুরতে গিয়ে আশেপাশেই বেশি ঘোরে। একেনবাবুও সুযোগ পেয়ে আশপাশের সাইট সিন সেরে নিয়েছেন। তাই ছবি দেখতে দেখতে পুরী দর্শনও বাড়তি পাওনা।

সবমিলিয়ে একেনবাবুর পুরী যাত্রা মন্দ নয়। একেবারে অন্য ঘরানার এই গোয়েন্দা চরিত্রকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.