সুকর্ণ সিনহা
এখন সারা বছরই বইমেলা। নানারকম সাইট দেখুন। ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ দেখুন। ইচ্ছেমতো অর্ডার দিন। ঘরে বই পৌঁছে যাবে। তাই বলে কি আর বইমেলার আকর্ষণ কমে! এত এত মানুষের সমাগম দেখলে সত্যিই মন ভাল হয়ে যায়। মনে হয়, পৃথিবীতে এখনও সুস্থ চিন্তা করার লোক আছে।
বিভিন্ন স্টলে লোকেরা বই নেড়েচেড়ে দেখছেন। যে যাঁর পছন্দমতো বই কিনছেন। এর থেকে ভাল দৃশ্য আর কী হতে পারে! তবে এই বইমেলায় আমার আকর্ষণ একটু অন্যরকম। আমি বেশিরভাগ সময় কাটাই লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে।
কলেজে পড়ার সময় কয়েকজন বন্ধু মিলে লিটল ম্যাগাজিনের ভূত চেপেছিল। যতদূর মনে পড়ে, গোটা দশেক সংখ্যা বের করেছিলাম। বিভিন্ন দিকপাল লেখকদের বাড়িতে ছুটেছিলাম লেখা আনতে। অনেকেই দিয়েছিলেন। অনেকে সময়ের অভাবে হয়ত দিতে পারেননি। আবার তখনকার অনেক উঠতি কবি, লেখাকের কাছ থেকেও লেখা নিয়েছিলাম। ভাবতে ভাল লাগে, আজ তাঁরা স্বনামধন্য। আজ বড় বড় প্রকাশকের ঘর থেকে তাঁদের বই বেরোয়। তাঁদের বই থেকে সিনেমা হয়।
তারপর যা হয়! কাজের সন্ধানে যে যার মতো নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ল। নিজেদের মধ্যে ছোট খাটো ভুল বোঝাবুঝিও হল। সবমিলিয়ে উৎসাহে ভাটা পড়ল। নাম কে ওয়াস্তে দু একটা সংখ্যা বেরোলো। তারপর স্বাভাবিক নিয়মেই সেই ম্যাগাজিন একসময় ‘প্রাক্তন’ হয়ে গেল। এখনও আমার বাড়িতে সেই পুরনো সংখ্যাগুলো যত্ন করে সাজানো। এখন নানা পত্রপত্রিকায় টুকটাক লিখি। কিন্তু নিজেদের হাতে ম্যাগাজিন তৈরি করার যে আনন্দ, সেই রোমাঞ্চ এখনও যেন তাড়া করে।
নিজেরা লিটল ম্যাগাজিন করেছিলাম বলেই সেই আবেগটা আজও বুঝতে পারি। তাই বইমেলায় ওই স্টলগুলোতেই ঘুরঘুর করি। অনেক চেনামুখ। কারও বয়স পঞ্চাশ, তো কারও সত্তর। অনেকেই নিজের পকেট থেকেই বিরাট এই খরচ বহন করেন। অনেকে পেনশনের টাকার অনেকটা তুলে রাখেন ম্যাগাজিনের জন্য। অনেকের আবার ছেলে–মেয়ের প্রবল আপত্তি বাবা যেন বইমেলায় ওই লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে না বসে। এতে নাকি তাদের মানসম্মান থাকে না। কেউ আবার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে মেলায় আসেন। বই বিক্রি করেন।
মনে হতেই পারে, এঁরা কেন আসেন! কত টাকাই বা উঠে আসে! লোকে উল্টে পাল্টে দেখে। চলে যায়। অনেকে তো এদিকের ছায়াও মাড়ায় না। অনেকে আবার বলে, না বাবা, লিটল ম্যাগাজিনের দিকে যাব না। চেনা জানা কারও সঙ্গে দেখা হলেই বই গছিয়ে দেবে। এই লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের কাছেই থাকে ফুড পার্ক। খাবারের স্টলে নিমেশে লক্ষ লক্ষ টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। অথচ, এদিকটায় কেউ ফিরেও তাকায় না।
এই লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নও আসলে একটা সমুদ্র। কত বিষয় সম্ভার। কত নানা ধরনের ভাবনার সংকলন। বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা হয়তো এসব নিয়ে বই করার সাহসই দেখাবে না। কারণ, এসব বইয়ের বাজার নেই। কিন্তু এই লিটল ম্যাগের লোকগুলো নাছোড়বান্দা। তাঁরা ভাল করেই জানেন, কেউ পড়বে না। টাকা উঠে এল কিনা, তাঁরা পরোয়াও করেন না। তাঁদের যা ভাল লাগে, তাঁরা তাই করেন। এই আনন্দ তাঁদের কাছ থেকে কে কেড়ে নেবে! সব বই কিনতে পারি না ঠিকই। কিন্তু বিভিন্ন স্টল ঘুরে বইগুলো দেখতে তো পারি। যেটা আজ কিনলাম না, সেটা হয়ত পরশু কিনে নিলাম। যেটা গত বছর কিনতে পারিনি, সেটা হয়ত এবছর কিনলাম।
এই প্রজন্ম নাকি বইবিমুখ। কিন্তু ওই স্টলে তো অনেক কমবয়সী ছেলেকেও দেখছি। তারা নানা বিষয় নিয়ে বই করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে যার মতো করে প্রোমোশন করছে। নামী লেখকদের লেখা আনছে। কেউ কেউ আবার পারিশ্রমিকও দিচ্ছে। কেউ কেউ দেখলাম, স্টল থেকেই বিভিন্ন প্রবাসী বন্ধুদের ফোন করছে। ঠিকানা চাইছে। বলছে, গুগল পে–তে টাকা পাঠিয়ে দাও, কুরিয়রে বই চলে যাবে। এদের নাছোড়বান্দা আবদারে ইচ্ছে না থাকলেও অনেকে সাড়া দিচ্ছেন। মাঝবয়সে এসে তারুণ্যের এই জোয়ার দেখে বেশ ভালই লাগে। নিজের পুরনো দিনগুলোয় যেন ফিরে যাই