বাংলাদেশের দু–‌একটা অর্বাচীন বুঝিয়ে দিল, আমরা আরও বড় অর্বাচীন

প্রশান্ত বসু

এ কোন ভারতে বাস করছি আমরা?‌ কোনও ডাক্তার বলছেন, তিনি বাংলাদেশের রোগী দেখবেন না। কোনও হোটেলওয়ালা বলছেন, তিনি বাংলাদেশের লোকেদেরে হোটেলে রাখবেন না। ঘটা করে এই সব প্রচার করছেন। ভাবছেন, তাঁরা বোধ হয় দেশপ্রেমের দারুণ নজির রাখলেন।

এ এক অদ্ভুত সময়, যখন আমাদের যাবতীয় বিকৃত চিন্তা দেশপ্রেম হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। সারাদিন আমাদের বেশ কিছু চ্যানেলে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ হাওয়া তৈরি করা হচ্ছে। দিনভর বাংলাদেশের প্রতি, সেই দেশের মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। আর এটাকে দেশপ্রেম বলে জাহির করা হচ্ছে। আমরা নিজের অজান্তেই বাংলাদেশের আম নাগরিককে আমাদের শত্রু বানিয়ে ফেলছি।

কোনও সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে যেভাবে সংখ্যালঘু নিপীড়ন হচ্ছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কিন্তু সেই কাজের সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশকে জুড়ে দেওয়ার মতো মূর্খামি আমরা কেন করছি?‌ এটা তো আমরা সবাই জানি, বিএনপি ও জামাতের মূল পুঁজিই হল ভারত বিরোধিতা। এ তো আজকের কথা নয়। বহুকাল ধরে ভারতের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়েই তারা রাজনৈতিক জমিকে শক্ত করতে চেয়েছে। ঠিক যেমন, আমাদের দেশের শাসক। তাদের একটাই মূলধন, পাকিস্তানের প্রতি, মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ছড়াও। আমরা বুঝে হোক, না বুঝে হোক, সেই ফাঁদে পা দিই। এটাকেই দেশপ্রেম ভেবে বসি।

বাংলাদেশেও ঠিক সেটাই হচ্ছে। এই অস্থির সময়ে আরও হিংসা ছড়ানোর পথেই হাঁটছে সেই দেশের মৌলবাদী শক্তি। একদিকে যেমন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চলছে, অন্যদিকে মুক্তমনা স্বাধীন কণ্ঠস্বরের ওপরও হামলা চলছে। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার প্রগতিশীল ব্লগাররাই কি রেহাই পাচ্ছেন?‌ মোলবাদীদের এই হুঙ্কারকেই আমরা বাংলাদেশের আমজনতার হিংসা বলে ধরে নিচ্ছি। দু–‌একজন বিকৃতমনষ্ক লোকের ফেসবুক পোস্ট দেখে তার দায় একটা গোটা দেশের ওপর, গোটা জাতির ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি। আর দিনভর বাংলাদেশের নামে, সেই দেশের মানুষের নামে যা পারছি, তাই বলে যাচ্ছি। কারণ, আমাদের দেশের বেশ কিছু চ্যানেল তাতেই ইন্ধন দিয়ে চলেছে। আমাদের দেশে যেমন অর্বাচীন লোকের অভাব নেই, তেমনই তাঁদের দেশেও নির্বোধ ও অর্বাচীনের কোনও ঘাটতি নেই। যাদের সারাদিনের কাজই হল ঘৃণা ছড়ানো। আর আমরা কী সেটাকেই সেই দেশের মানুষের কণ্ঠস্বর বলে ধরে নিচ্ছি।

বাংলাদেশের কোন এক প্রাক্তন সেনা যুদ্ধের হুঙ্কার দিলেন। অমনি আমাদের চ্যানেলে সন্ধের প্রাইম টাইমে রীতিমতো গ্রাফিক্স করে দেখানো হল, আমাদের হাতে কটা সাবমেরিন, বাংলাদেশের হাতে কটা। আমাদের কটা ফাইটার প্লেন, বাংলাদেশের কটা। আমাদের নৌবাহিনিতে কজন কাজ করে, বাংলাদেশে কজন। অর্থাৎ, দু’‌ঘণ্টা ধরে বোঝানো হল, ভারত বাংলাদেশের থেকে সামরিক শক্তিতে এগিয়ে। বিস্তর গবেষণা করিয়া, গবেষকরা এই সিদ্ধান্ত উপনীত হইলেন যে, গরু ঘাস খায়। বাংলাদেশের কোন অর্বাচীন হুমকি দিল, তার ওপর এতটুকুও রাগ হয়নি। তার থেকে অনেক বেশি করুণা হচ্ছিল আমাদের দেশের এই বুদ্ধিজীবী চ্যানেলের প্রতি। সেই অর্বাচীনের একটি প্রলাপ অন্তত এই চ্যানেলকে তার স্তরে নামিয়ে আনতে পেরেছিল।

আমাদের চ্যানেলে এই যে আস্ফালন, তাতে কার সুবিধা হচ্ছে?‌ বাংলাদেশের ওই মৌলবাদী শক্তিগুলি সেই দেশের মানুষকে আরও উস্কে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সেখানকার নির্যাতিত মানুষকে আরও বিপণ্ণতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। অর্থাৎ, পাশে দাঁড়ানোর নাম করে আমরা তাঁদের জীবন আরও দুর্বিসহ করে তুলছি। কে কতখানি দায়িত্বশীল, সেটা সঙ্কটের সময়েই বোঝা যায়। যখন আগুন জ্বলছে, তখন আপনার ভূমিকা কী?‌ আপনি জল ঢেলেছিলেন, নাকি কেরোসিন ঢেলেছিলেন, এটা নিজেকে প্রশ্ন করুন।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.